মার্কিন সমাজে সহিংসতা বাড়ছে সকালবেলাটা ছিল আর দশটা সাধারণ সকালের মতো । স্যান্ডি হুক এলিমেন্টারি স্কুলের ছোটবেলার ছাত্র এডাম ম্যানজার মাথায় কেন যে শয়তান এসে ভর করেছিল কে জানে। ঐ দিন সাতসকালে সে তার মা ন্যান্সি ল্যানজাকে গুলি করে মারে।

গত বছরের ডিসেম্বরে আমেরিকার এক স্কুলে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ বিশ্ববাসীকে স্তম্ভিত ও শোকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। এডাম ল্যানজা নামে ২০ বছরের এক তরুণ কানেকটিকাটের নিউ টাউনের একটি প্রাথমিক শিক্ষালয়ে ঢুকে ২০ শিশু ও ছয় প্রাপ্তবয়স্ককে গুলি করে হত্যা করে শেষে আত্মহত্যা করে। স্কুলে আসার আগে সে তার মাকেও হত্যা করে এসেছিল।
সেদিন ছিল ১৪ ডিসেম্বর শুক্রবার। বড়দিনের ছুটি শুরু হতে আর মাত্র ক’টা দিন বাকি। সকালবেলাটা ছিল আর দশটা সাধারণ সকালের মতো । স্যান্ডি হুক এলিমেন্টারি স্কুলের ছোটবেলার ছাত্র এডাম ম্যানজার মাথায় কেন যে শয়তান এসে ভর করেছিল কে জানে। ঐ দিন সাতসকালে সে তার মা ন্যান্সি ল্যানজাকে গুলি করে মারে। তারপর মায়ের কয়েকটা বন্ধুক ও রাইফেল নিয়ে গাড়িতে চেপে ছুট লাগায় ৫ মাইল দূরের ঐ স্কুলটির দিকে, যে স্কুলে তার মা একসময় শিক্ষকতা করত। বলাবাহুল্য মা ছিল একজন ভাল শূটার এবং তার কয়েকটা বন্দুক ও রাইফেল ছিল।
সমৃদ্ধ শহর নিউটাউনের ঐ স্কুলটির ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৭শ’। বয়স ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে। এডাম গাড়িটি বাইরে পার্ক করে জোর করে স্কুলে ঢুকে পড়ে। জানা যায়, সে গুলি ছুড়তে ছুড়তে ঢুকে পড়েছিল। স্কুল তার বেশ আগেই শুরু হয়ে গেছে। স্কুল ভবনে ঢোকার পথে সে প্রধান শিক্ষয়িত্রী ও স্কুলের সাইকোলজিস্টকে গুলি করে মারে। তারপর দুটি ক্লাসরুমে ঢুকে গুলির পর গুলি চালাতে থাকে। গুলিতে ১৮ শিশু ও আরও ৪ স্টাফ তাৎক্ষণিকভাবে মারা যায়। পরে আহত আরও ২ শিশুর মৃত্যু হয় হাসপাতালে। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে এই পৈশাচিক ও স্নায়ু অসার করে দেয়া ঘটনাটি ঘটে যায়। এই হত্যাযজ্ঞ ঐ তল্লাটে তথা গোটা দেশে শোকের ছায়া ফেলে। বড়দিনের সমস্ত আনন্দ শুষে নেয়। একই সঙ্গে তা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
আমেরিকার মতো উন্নত ও সুসভ্য সমাজের বুকে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। আগেও নানভাবে হয়েছে এবং এখনও ঘটে চলেছে। নিউটাউনের ঘটনার কিছুদিন আগে পোর্টল্যানন্ডে ১১ বছরের এক বালক তার বাবার লাইসেন্সবিহীন বন্দুক নিয়ে বাড়ির পেছনের আঙ্গিনায় গিয়ে চার রাউন্ড গুলি ছুড়ে। তার বোন জখম হয়। মিসৌরিতে ১২ বছরের এক ছেলে তার বন্ধুর বন্দুকের গুলিতে মারা পড়ে। বন্ধুটি তার দাদার বন্দুক নিয়ে খেলছিল। এরই কাছাকাছি সময় হিউস্টনে ৪ বছরের এক শিশু বাবার পিস্তল বের করে গুলি ছুড়লে তার নিজের মাথায় লেগে মারা যায়। আমেরিকায় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। তবে নিউটাউন স্কুলে যা ঘটে গেল এক কথায় তা ভয়াবহ এবং এমন হত্যযজ্ঞ অহরহ না হলেও মাঝে মধ্যে ঘটেই থাকে। একজন কলাম লেখক পত্রিকায় লিখেছেন: “প্রতিবার এমন হত্যাযজ্ঞের পর আমরা বিলাপ করি। তারপর অঙ্গীকার ঘোষণার সুরে বলি এমন ঘটনা আর ঘটতে দেয়া যায় না। অতপর যথারীতি সব ভুলে যাই যতক্ষণ পর্যন্ত না নতুন কোন হত্যাযজ্ঞ হয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এসব হচ্ছে আমেরিকার মতো সমাজে? এর কি কোন ব্যাখ্যা নেই? এর কি কোন প্রতিকার নেই? বিভিন্নজন অস্ত্র নিয়ে এই হানাহানি ও রক্তারক্তির বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কেউ কেউ বলেন, মার্কিন সমাজে ভায়োলেন্সের বিস্তারের জন্য হলিউডের ছায়াছবি ও ভিডিও গেম কোম্পানিগুলো দায়ী। আবার অন্যদের মতে, আমেরিকায়র অস্ত্র অতি সহজলভ্য। এর জন্য কোন লাইসেন্সের প্রয়োজন হয় না। যে কেউ দোকানে গিয়ে সহজেই অস্ত্র কিনে নিতে পারে। এসবের কারণেন কথায় কথায় আজ অস্ত্রের ভায়োলেন্স ঘটছে। এই ভায়োলেন্স একটা ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। ওয়েন লাপিয়ারের মতে, স্কুলে গিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালানোর এই যে উন্মাদনা এর বীজ বপন করে দেয় হলিউড ও বিনোদন কোম্পানিগুলো। জনস্বার্থের ব্যাপারে নির্লিপ্ত ও দুর্নীতিবাজ এসব শিল্প নানা ধরনের হিংস্র ও বিষাক্ত ভিডিও গেম ও ছায়াছবির মাধ্যমে নিজ জনগণের বিরুদ্ধে ভায়োলেন্স বিক্রি করে এবং ভায়োলেন্সের বীজ বপন করেÑ যেমন বুলেটস্টর্ম, গ্র্যান্ড থেফট্ অটো, মর্টাল কমব্যাট ও সø্যাটার হাউজ। তারপর আছে ‘আমোরিকান সাইকো’ ও‘ন্যাচারাল বর্ন কিলার’ নামে এমন ছায়াছবি যেখানে মারদাঙ্গা ও রক্তের ছড়াছড়ি ছাড়া আর কিছু নেই। এসব ছায়াছবি ও ভিডিও গেম ছাড়াও রয়েছে হাজার হাজার মিউজিক ভিডিও; যেখানে জীবনকে একটা তামাশা এবং হত্যাকে একটা জীবনধারা হিসাবে চিত্রিত করা হয় এবং বিনোদনের নাম দিয়ে পরিবেশন করা হয়। আর এভাবেই প্রতিবছর, প্রতিমাস, প্রতিঘণ্টা, প্রতিমিনিটে লাগামহীন আচরণন ও ক্রিমিনালসুলভ নিষ্ঠুরতা আমেরিকানদের ঘরে প্রবেশ করছে। এসব বিকৃত আচরণ ও ভায়োলেন্স পরিবেশন করতে গিয়ে বিনোদন ও মিডিয়া কনগ্লোমারেটগুলো নিজেদের মধ্যে হিংস্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে।
মার্কিন সমাজে বেড়েওঠা কোন শিশু যখন ১৮ বছর বয়সে পৌঁছে ততদিনে সে এসব ভিডিও গেম, ছায়াছবি ও টিভি সিরিয়ালের বদৌলতে ১৬ হাজার হত্যাকা- এবং দু’লাখ ভায়োলেন্সের ঘটনা প্রত্যক্ষ করে ফেলেছে। কিছু কিছু দৃশ্য আছে যেগুলো তাদের মনোলোকে স্থায়ী ছাপ রেখে যায়। তাদের অবচেতন মনে তা থেকে নানা ধরনের বিকারের জন্ম দেয়। ফ্যান্টাসিও তৈরি করে। আর এসবের চরিতার্থ করার জন্য তারা হাতের কাছে পেয়ে যায় অস্ত্র । এই অস্ত্র যেমন সস্তা তেমনি সহজলভ্য। এর জন্য কোন কড়াকড়ি নিয়ন্ত্রণ নেই। অস্ত্র হচ্ছে হাতিয়ার যা দিয়ে সে তার অবচেতন মনের বিকার ও ফ্যান্টাসিকে চরিতার্থ করে। আর সেই বিকার ও ফ্যান্টাসির জন্ম হচ্ছে আমেরিকার বিনোদন শিল্প থেকে; যা নিয়ন্ত্রণ করছে বিশাল বিশাল শিল্পগোষ্ঠী।
চলমান ডেস্ক

No comments

Powered by Blogger.