ইউরোপের জানালা- শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বনাম সমরাস্ত্রের সম্ভার by সরাফ আহমেদ

বড়দিনের উৎসব আর নতুন বছরের প্রারম্ভে ইউরোপজুড়ে দেশে দেশে সাজ সাজ রব পড়ে, আলো ঝলমল শহর-নগর, বড়দিন ঘিরে বিশেষ বাজার আর উপহারসামগ্রী কেনার ধূম, সব মিলিয়ে চমৎকার আমেজ।
এ বছর ইউরোপের বেশ কিছু দেশে, সেই উৎসবের আমেজ ততটা নেই, কারণ রাজনীতি আর ইউরো সংকট ঘিরে নানা আশঙ্কা। ২০১২ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তিতে ইউরোপের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতারা খুশি হয়েছেন। পুরস্কারপ্রাপ্তির পর ইউরোপীয় পার্লামেন্টের স্পিকার মার্টিন সুলজ তাঁর প্রতিক্রিয়াই বলছিলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন যুদ্ধকে পেছনে ফেলে শান্তির সন্ধান আর ঘৃণার বিপরীতে সহমর্মিতার নিদর্শন হয়ে রইবে। এ কথা সত্য, শত বছরের উপমহাদেশীয় যুদ্ধবিগ্রহ পেছনে ফেলে বিগত ৬০ বছরে শান্তির পথে এগিয়েছে ইউরোপ।
বড়দিন উৎসবের ঠিক আগে আপাতসংকটময় দুই দেশ গ্রিস আর স্পেনের পার্লামেন্টের ভেতর আরও অধিক ব্যয়-সংকোচন, বিপুলসংখ্যক সরকারি কর্মচারীকে ছাঁটাইনীতি এবং স্বাস্থ্যসহ আরও কিছু সেবা খাতে সরকারি ভর্তুকি কমিয়ে দেওয়ার আইন প্রণীত হয়েছে পার্লামেন্টের বাইরে। তখন বিক্ষোভে ফুঁসে উঠছেন সাধারণ কর্মচারী, হাসপাতালের নার্স, স্কুলশিক্ষক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ।
ইতালির অবস্থাও তথৈবচ, অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে গত বছরের নভেম্বর মাসে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী মারিও মোন্তি ইতালির ২০১৩ সালের বাজেট অনুমোদিত হওয়ার পরপরই প্রেসিডেন্ট গিওর্গিও নাপোলিতানোর কাছে পদত্যাগপত্র পেশ করেন। তাঁর পদত্যাগের পর পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট গিওর্গিও নাপোলিতানো আগামী ২৪-২৫ ফেব্রুয়ারি ইতালিতে আবার জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তবে প্রেসিডেন্টের অনুরোধে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন মারিও মোন্তি। ইতালিতে এই সংকটের মুখে দেশটির অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে অর্থনীতিবিদ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাবেক কমিশনার মোন্তির গৃহীত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের বর্তমান কমিশনার হোসে মানুয়েল বারোসো, জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল এবং আরও কিছুসংখ্যক ইউরোপীয় নেতা।

দুই.
অভ্যন্তরীণ উৎসগুলো থেকে আয় বাড়ানোর চেষ্টায় বিভিন্ন সেবা খাতে সরকারি অনুদান হ্রাস, আয়কর বৃদ্ধি ও ব্যয় সংকোচনের মুখে গ্রিস, স্পেন বা পর্তুগালের মতো অর্থনৈতিক সংকটে পড়া দেশগুলোর সাধারণ জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন। প্রশ্ন উঠছে, প্রায় ১০ বছর আগে ইউরো মুদ্রা চালু হলেও সময় থাকতে ক্ষমতাসীন দলগুলো নিজেদের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক সংস্কারের ধার ধারেননি, তা ছাড়া দুর্নীতির কথাও উঠছে, সম্প্রতি গ্রিসের সংবাদপত্র টো ভিমা এবং পর্টো থেমা-তে দুই হাজার ধনকুবেরের তালিকা প্রকাশিত হয়েছে, তালিকাতে গ্রিসের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গিওর্গিওস পোম্পিন্ডোর মা মার্গারেট পোম্পিন্ডোর নামও এসেছে, যাঁরা বিগত ১০ বছরে নিজের দেশ গ্রিসে আয়কর ফাঁকি দিয়ে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে অঢেল বিত্তের পাহাড় গড়ে তুলেছেন।
আগামী ফেব্রুয়ারিতে ইতালির নির্বাচনে আবারও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাইছেন ১৩ মাস আগে পদত্যাগকারী ৭৫ বছর বয়স্ক সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বেরলুসকোনি। ইউরোপের রাজনীতিতে সার্কাসের ক্লাউন আর মেয়েবাজ বলে পরিচিত হলেও, শুধু অর্থ আর ইতালিজুড়ে মিডিয়া ধনকুবের বলে বারবার ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করছেন।
ইতালির তিনটি টেলিভিশন চ্যানেলের স্বত্বাধিকারী, যাঁর বিরুদ্ধে যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ রয়েছে। আর সম্প্রতি নতুন বাগ্দত্তা হিসেবে ২৮ বছর বয়স্ক ফ্রান্সসিসকা প্যাসকালের সঙ্গে সম্পর্কের কথা প্রকাশ করেছেন। ক্ষমতায় পুনর্বার আসার জন্য তিনি সদ্য পদত্যাগকারী প্রধানমন্ত্রী মারিও মোন্তিকে জার্মান চ্যান্সেলর ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে নতজানু হয়ে ইতালিতে আয়কর বৃদ্ধির সমালোচনা করেছেন। প্রকৃত সত্য হলো, ইতালির অর্থনৈতিক সংস্কার ছাড়া বিকল্প পথ নেই জেনেও শুধু ক্ষমতার লোভে সিলভিও বেরলুসকোনি তাঁর নিজস্ব মিডিয়া শক্তি দিয়ে প্রচারণা শুরু করেছেন। তাই তিনি ইতালির রাজনীতিতে আবারও ক্ষমতাসীন হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

তিন.
একদিকে মানবিকতা, মানবাধিকার, সহমর্মিতা অন্যদিকে দেদার অস্ত্র ব্যবসা। আধুনিক প্রযুক্তির অস্ত্র অর্থই হলো আরও সুচারুভাবে, মানবিকতাকে হত্যা, মানুষকে হত্যা। যেহেতু নিজ অঞ্চলে এই মারণাস্ত্রের প্রয়োগ নেই, তাই এই মারণাস্ত্র বানাতে আর বেচতে অসুবিধা কোথায়। এই দ্বিমুখী আচরণ নিয়ে কথা উঠেছে। ২০১২ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির পর এই আলোচনা আরও জোরদার হয়েছে। নিজেদের যুদ্ধ করার বদলে অন্যদের কাছে অস্ত্র বিক্রি আর অর্থ উপার্জন—এই নীতিতে চলেছে ইউরোপের অনেক অস্ত্র বিক্রেতা দেশ। জার্মান এ মুহূর্তে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ। জার্মানে অস্ত্র প্রস্তুতকারী কারখানাগুলোতে কাজ করছে ৮০ হাজার মানুষ, যেখানে তৈরি হচ্ছে সাবমেরিন, লিওপোর্ড ট্যাংক, মেশিনগান, যুদ্ধবিমান প্রভৃতি। ক্রেতারা হচ্ছে কিছু ইউরোপের এবং ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলোর বাইরে ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও লিবিয়ার।
জার্মানের সংবাদপত্রগুলোতে ইদানীং মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরশাসিত দেশ, সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাতে জার্মানি অস্ত্র বিক্রয় নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এসব দেশের স্বৈরশাসকেরা ওই অস্ত্র গণতন্ত্রকামী মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছেন। শুধু গত বছরেই জার্মানি থেকে ভারত ১২৬টি অতি আধুনিক যুদ্ধবিমান আর সৌদি আরব ২৭০টি লিওপোর্ড ট্যাংক ক্রয় করেছে। ইউরোপে প্রধান চার অস্ত্র বিক্রেতা দেশগুলো হলো: রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স ও ব্রিটেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির জোর সমালোচনা হচ্ছে। যে মুহূর্তে অর্থনৈতিক সংকট ও দেউলিয়া কিছু নেতার কারণে হাজার হাজার মানুষ বেকার হচ্ছেন, বিভিন্ন জনকল্যাণমুখী সেবা হ্রাস পাচ্ছে বা নৈতিকতা আর মানবিকতার কথা শুধু নিজ মহাদেশে সংরক্ষণ করে, অর্থনৈতিক লাভের আশায় অস্ত্র বিক্রয়ের মাধ্যমে অন্যত্র পরোক্ষভাবে যুদ্ধের ইন্ধন দেওয়া হচ্ছে, সেই মুহূর্তে এ পুরস্কারের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।
ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে বা উত্তর আফ্রিকার যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়া, সিরিয়া, মরক্কো, তিউনিসিয়ার মতো দেশগুলো থেকে আসা হাজার হাজার শরণার্থী যাঁরা দক্ষিণ ইতালির লাম্পডুসা বা স্পেনের উপকূলে ছোট ছোট নৌকায় করে দুস্তর সাগর পেরিয়ে ইউরোপে রাজনৈতিক আশ্রয় পেতে চেয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে অমানবিক ব্যবহার করা হচ্ছে। জার্মান অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাধারণ সম্পাদক ভল্ফগ্যাং গ্রেনজস বলেছেন, ‘ভূমধ্যসাগর দিয়ে সাগরভাসা ক্ষুধার্ত ও অসহায় মানুষের ছবি আমরা টেলিভিশনে দেখেছি, এই অসহায় মানুষগুলোর ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কোনো মানবিক সিদ্ধান্ত না নিয়ে দূর সাগরে ঠেলে দিয়েছে।’
এ কথা সত্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিগত ৬০ বছরে নিজেদের মহাদেশে ইউরোপ শান্তির পথে অনেকটাই এগিয়েছে, কথায় কথায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধনীতিতে সমর্থন দেওয়ার মানসিকতাটাও পাল্টিয়েছে। তবে বিশ্বশান্তিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভবিষ্যতে আরও দূরদৃষ্টি দিলে, ইউরোপ তাদের পুরোনো উপনিবেশবাদী পরিচয়ের খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে আর বিশ্বের মানুষের কাছে গড়ে উঠবে ইউরোপের নতুন ইমেজ।

হ্যানোভার, জার্মানি
সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর হ্যানোভার (জার্মানি) প্রতিনিধি।
Sharaf.ahmed@gmx.net

No comments

Powered by Blogger.