অবসরে ‘অসি মি. ক্রিকেট’- হঠাৎ অবসরের সিদ্ধান্তের নেপথ্যে পরিবারকে সময় দেয়ার কথাই বললেন মাইক হাসি by মোঃ এনামুল হাসান

 আধুনিক ক্রিকেটে ভদ্রতার চূড়ান্ত নিদর্শন উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে যে দুই ক্রিকেটার অঘোষিত ‘মি. ক্রিকেট’ উপাধি লাভ করেন অস্ট্রেলিয়ার মাইক হাসি তাদের অন্যতম। অপরজন ভারতীয় রাহুল দ্রাবিড়। সেই ‘অসি মি. ক্রিকেট’ আচমকাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
কালে কালে ক্রিকেটার তো অনেকেই আসেন, কিন্তু মাঠ ও মাঠের বাইরে এমন নিপাট ভদ্রলোক আর ক’জন হন? মাইক হাসির অবসর তাই অস্ট্রেলিয়া ছাড়িয়ে গোটা বিশ্বের ক্রিকেটপ্রিয় মানুষের বিবেক-অনুভূতিতে নাড়া দেয়া। রিকি পন্টিং তবু ফর্মহীনতায় কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু ব্যাট হাতে বেশ ভালমতোই ফর্মে ছিলেন। তারপরও নিখাঁদ ভাল মানুষটি সসম্মানেই টেস্ট ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। অস্ট্রেলিয়া মিডল অর্ডারের অন্যতম সফল ব্যাটসম্যান মাইক হাসি। বৃহস্পতিবার সিডনিতে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে চলমান তিন ম্যাচ সিরিজের শেষ টেস্টই হতে যাচ্ছে ‘মি. ক্রিকেটের’ ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট ম্যাচ। পাশাপাশি চলতি মৌসুমেই ওয়ানডে ও টি২০ থেকেও অবসর নেবেন তিনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করলেও, অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি আরও কিছুদিন খেলবেন।
হঠাৎ করে অবসরের সিদ্ধান্ত ঘোষণার নেপথ্য কারণ হিসেবে পরিবারকে সময় দেয়ার কথাই বলেছেন তিনি। গত শনিবার স্থানীয় টিভি চ্যানেলে কিছুটা মজা করেই মাইক বলেন, ‘সকালে পরিবারের সদস্যদের যখন অবসরের সিদ্ধান্তের কথা জানালাম, তখন আমি নিজেও খুব উত্তেজিত ছিলাম। কিন্তু পরিবারের সবার মধ্যে সেই উত্তেজনাটা দেখলাম না। মনে হলো তারা ব্যাপারটিকে স্বাভাবিকভাবেই নিচ্ছে। তাদের এই নির্লিপ্ততাটাই বরং আমাকে ধাক্কা দিয়েছে বেশি!’ ‘সিডনিতে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে সিরিজের শেষ টেস্টটাই হবে আমার ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট। ভাল লাগছে এই ভেবে যে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলতে গিয়ে পারফর্ম করার যে চাপ প্রত্যেক খেলোয়াড়কে নিতে হয়, সেই চাপ থেকে আমি মুক্ত। সিডনিতে জীবনের শেষ টেস্ট ম্যাচে আমি মাঠে নামব চাপমুক্ত হয়ে, যতটা সম্ভব উপভোগ করার উদ্দেশ্যে।’ এরপর মজা বাদ দিয়ে সিরিয়াসলি যোগ করেন তিনি। রিকি পন্টিংয়ের পর অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের সবচেয়ে অভিজ্ঞ মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান মাইক হাসি। ক’দিন আগে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সিরিজের মাঝপথে ৩৭ বছর বয়সে অবসরে গেছেন রিকি পন্টিং। হাসির অবসরের ফলে নিজেদের ব্যাটিং নিয়েই নতুনভাবে ভাবতে বসতে হবে অস্ট্রেলিয়ার টিম ম্যানেজমেন্টকে। মাইক অবশ্য সিদ্ধান্তটি নিতে পেরেই দারুণ খুশি। তিনি বলেন, ‘আমি অস্ট্রেলিয়ার হয়ে অনেকদিন খেললাম। বহু ম্যাচে দলকে জিততে দেখেছি। বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব অস্ট্রেলিয়ার সাফল্যের স্মৃতিগুলো রোমন্থন করেই। এ এক অসাধারণ অনুভূতি।’ অন্যদের মতো নয়, সাধারণ হিসাবের অনেক দেরিতেই ৩০ বছর বয়সে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিল মাইক হাসির। ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ওয়ানডে অভিষেক হওয়ারও দেড় বছর পর ২০০৫ সালের নবেম্বরে তাঁর ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ পরে টেস্ট ক্রিকেটে মাঠে নামার সুযোগ হয়। মজার বিষয় হলো, প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ১৫,৩১৩ রান করার পরই অস্ট্রেলিয়ার হয়ে টেস্টে মাঠে নামার সুযোগ হয়েছিল তাঁর! অভিষেকের পর এ পর্যন্ত খেলেছেন ৭৮টি টেস্ট। ৫১.৫২ গড়ে তাঁর সংগ্রহ ৬,১৮৩ রান। সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন ১৯টি, হাফ সেঞ্চুরি ২৯টি। ওয়ানডে ক্রিকেটেও সমান সফল হাসি। ১৮৫টি ম্যাচে ৪৮.১৫ গড়ে তাঁর সংগ্রহ ৫,৪৪২ রান। সেঞ্চুরি তিনটি হলেও হাফ সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন ৩৯টি। তিরিশ বছর বয়সে অভিষেক হওয়া সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এমন রেকর্ড একজন ক্রিকেটারের জন্য সত্যি অভাবনীয়, ঈর্ষণীয়ই বলতে হবে। মাইক হাসির অবসরের সিদ্ধান্তকে দেশটির ক্রিকেটের, বিশেষ করে টেস্টের জন্য ‘অনেক বড় ভাইটাল’ বলে উল্লেখ করেছেন ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার (সিএ) ব্যবস্থাপনা প্রধান জেমস সাদারল্যান্ড। টেস্টে মাইকের অভাব বোধ করবে অস্ট্রেলিয়াÑ এমনটা মনে করছেন সাবেক অসি পেস তারকা ডেনিস লিলিও। তবে হাসি তা মনে করেন না। তাঁর মতে, তাঁকে ছাড়াই অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট সদর্পে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। ফেব্রুয়ারিতে ভারতে কঠিন সিরিজ খেলতে যাবে অসিরা। আর ওই সফরের আগেই দুই বড় ব্যাটিং স্তম্ভের (পন্টিং-হাসি) বিদায়। এ কারণে অনেক ক্রিকেটবোদ্ধাই বলছেন, ভারত সফরে চরম দুর্ভোগে পড়বে অসিরা। কিন্তু এ বিষয়ে ৭৮ টেস্ট খেলা হাসি বলেন, ‘আমি কোনভাবেই দল নিয়ে শঙ্কিত নই। আমরা বেশকিছু উপযুক্ত ক্রিকেটার খুঁজে পেয়েছি যারা দলে ঢোকার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। এমন অসংখ্য নাম আছে যাঁরা আমার জায়গায় খেলতে পারেন। হয়ত এখানে ডেভিড হাসি আসতে পারে এবং বেশ ভাল রানও পেতে পারে। এক হাসি চলে যাবে, আরেক হাসি ঢুকবে। ইতিহাসও বলে যুগে যুগে খেলোয়াড়রা আসে আর যায়। কিন্তু খেলাটা কিন্তু ঠিকই চলতে থাকে। কাজেই একজন খেলোয়াড় এখানে ভিন্নতা আনতে পারে না।’ ইতোমধ্যে পন্টিংয়ের জন্য ফিল হিউজেসকে দলে নিয়েছে অসিরা। ধারণা করা হচ্ছে, হাসির পরিবর্তে দলে আসতে পারেন পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত তরুণ উসমান খাজা। যদিও সিডনি টেস্টের জন্য ঘোষিত ১৩ সদস্যের দলে আছেন অলরাউন্ডার গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। তিনি ইনজুরি আক্রান্ত শেন ওয়াটসনের পরিবর্তে স্কোয়াডে জায়গা পেয়েছেন। এছাড়াও হাসির জায়গা পূরণের জন্য আছেন ভিক্টোরিয়ার ক্রিকেটার রব কুইনি, এ্যালেক্স ডুলান ও কালাম ফার্গুসন। তবে হাসির বিদায় নেয়ার ঘোষণাটি পুরোপুরি বিমূঢ় করে দিয়েছে কোচ মিকি আর্থার ও অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্ককে। এ বিষয়ে তরুণ পেসার মিচেল স্টার্ক বলেন, ‘ব্যাট হাতে তিনি এখনও দুর্দান্ত ফর্মে আছেন। এ গ্রীষ্মেও তাঁর ব্যাটে রানের কমতি দেখিনি আমরা। এখন তাঁর চলে যাওয়াটা দলে বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি করবে। রিকি পন্টিংয়ের অভাব পূরণ করা অনেক কঠিন বিষয়। আমরা চেষ্টা করছি সে সময় হাসির বিদায় বিশাল একটা অভাব তৈরি করবে দলে।’ তবে হাসি জানিয়েছেন পারিবারিক কারণেই তাঁকে অবসরে যেতে হচ্ছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি এখনও ক্রিকেটকে অনেক ভালবাসি। কিন্তু এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের রং, রূপ ও চাপ নিয়ে এগিয়ে যাওয়া আমার জন্য কঠিন। যে সময় ক্রিকেটারদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে খেলতে পরিণত অবস্থা চলে আসে ওই সময় যাত্রা শুরু করেছেন হাসি। ৩০ বছর বয়সে একজন পরিণত ও অভিজ্ঞ ক্রিকেটার হিসেবেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যাত্রা শুরু করেছিলেন তিনি। টানা খেলে গেছেন ৭ বছর। ধরে রেখেছেন আশ্চর্য ফর্ম। অনেকবারই দলকে রক্ষা করেছেন ধস নামতে থাকা ইনিংসে হাল ধরে।

No comments

Powered by Blogger.