রওশন হত্যাকাণ্ড-বিয়ের গয়না লুট করতেই খুন!

মেয়ের বিয়ের প্রায় সব আয়োজনই সম্পন্ন। ছাপা হয়েছে নিমন্ত্রণপত্র। গয়না, কাপড়চোপড় সবই কেনা হয়েছে। বাকি রয়েছে আনুষঙ্গিক কিছু জিনিসপত্র। একমাত্র সন্তানের বিয়ের জন্য কেনা গয়না ছিল বাসাতেই। কন্যা সম্প্রদানের সেসব সামগ্রীই প্রবীণ আইনজীবী রওশন আখতারের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াল।
রওশন আখতারের মেয়ে রেজওয়ানা আখতার মাহবুবের (মিনা) বিয়ের গয়না নিতেই বাসায় ঢুকেছিল দুই নিরাপত্তাকর্মী তাজুল ইসলাম ও রাসেল আহমেদ। মিনার কক্ষ তছনছ করে সেই গয়না খুঁজেছে দুর্বৃত্তরা। এরপর হানা দেয় রওশন আখতারের কক্ষে। রওশন বাধা দিলে তারা শ্বাসরুদ্ধ করে তাঁকে হত্যা করে।
আলামত পর্যবেক্ষণ এবং স্বজন ও পুলিশের বক্তব্য থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। গতকাল মঙ্গলবার রওশন আখতারের একমাত্র মেয়ে রেজওয়ানা আখতার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, 'আমার বিয়ের গয়না রক্ষা করতে গিয়েই আমার মা মারা গেছেন। আমার মা অসুস্থ মানুষ। তাঁকে ওরা মারল কেন? একটি কক্ষে আটকে রাখতে পারত না!...'
রেজওয়ানা জানান, পুরো বাসায় ব্যাপক তল্লাশি চালালেও খুনিরা তাঁর কক্ষ থেকে মাত্র ২০ হাজার টাকা নিয়েছে। ওই টাকা ছাড়া বাসা থেকে কিছুই খোয়া যায়নি। এতে স্পষ্ট যে নিরাপত্তাকর্মী তাজুল ও রাসেল বিয়ের গয়না লুট করতেই তাঁর মাকে হত্যা করে।
এদিকে গতকাল পর্যন্ত পলাতক তাজুল ও রাসেলের হদিস পাননি তদন্তকারীরা। তারা যে প্রতিষ্ঠানের হয়ে চাকরি করত সেখানে গিয়েও তাদের বিস্তারিত পরিচয় মেলেনি। তবে অ্যামিকন সিকিউরিটি সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেড নামের ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'দুজনের যে ঠিকানা আমাদের কাছে আছে তা পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। ওদের পাওয়া গেলেই প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে। আমরা এ ব্যাপারে সাহায্য করছি।'
পরিকল্পিত হত্যার ধারণা : রওশন আখতারের স্বামী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহবুব-ই-সাত্তার জানান, আগামী ২৫ জানুয়ারি রেজওয়ানার বিয়ের দিন নির্ধারিত হয়েছে। কেনাকাটাও প্রায় শেষ। নিমন্ত্রণপত্র ছাপানো হয়েছে। ব্যাপারটি বাড়ির এবং আশপাশের প্রতিবেশীরা জানে। নিরাপত্তাকর্মীরাও সহজেই জেনেছে। তাজুল ও রাসেল সমবয়সী। তাদের বয়স ২০ বছরের নিচে বলে ধারণা নিহত রওশন আখতারের স্বজনদের। সম্প্রতি কাজে যোগদানের পরই তারা রেজওয়ানা, তাঁর বাবা ও মায়ের সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা বলত। বাজার থেকে কোনো সামগ্রী কিনে আনলে তা বাসায় পৌঁছে দিত। তবে নিরাপত্তার ব্যাপারে সতর্ক রওশন আখতার অপরিচিত লোকজনকে বাসায় ঢুকতে দিতেন না। স্বজনদের ধারণা, কোনো কাজের অজুহাতে দুজন তাঁদের বাসায় ঢোকে। পরে লুটপাট চালায় এবং এক পর্যায়ে রওশন আখতারকে হত্যা করে পালিয়ে যায়। রেজওয়ানা বলেন, তাজুল ও রাসেল একই সঙ্গে রাত জেগে ডিউটি করত। সাধারণত একজন জাগলে অন্যজন ঘুমায়। তারা সব সময়ই একসঙ্গে চলত। এসব দেখে রওশনের স্বজনদের ধারণা, পরিকল্পিতভাবে লুট করতেই নিরাপত্তাকর্মীর বেশে ওই দুজন বাড়িতে আসে। এ ধরনের অপরাধীরা উদ্দেশ্য সফল করতে হত্যাও করতে পারে।
হদিস নেই ওদের : গতকাল মিরপুরের ৬ নম্বর সেকশনের 'এ' ব্লকে রওশন আখতারের বাড়ির (৩/সি) নিচতলায় নিরাপত্তাকর্মীর কক্ষে গিয়ে দেখা গেছে মেঝেতে ছাড়ানো-ছিটানো কিছু কাপড়চোপড়। টেবিলে একটি কাগজে নিরাপত্তাকর্মী সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা এবং ফোন নম্বর লেখা আছে। একটি কাগজে রাসেলের বিস্তারিত ঠিকানাও আছে। রাসেলের বাবার নাম আবদুস সোবহান জোমাদ্দার। তার বাড়ি পটুয়াখালীর ইটবাড়ী ইউনিয়নের পূর্ব চন্দ্রাপুর গ্রামে। আর তাজুলের বাড়ি পঞ্চগড় বলে উল্লেখ করা আছে ওই কাগজে। রাসেলের একটি মোবাইল ফোন নম্বর লেখা থাকলেও নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
গতকাল বিকেলে রাজধানীর কুড়িলে অ্যামিকন সিকিউরিটি সার্ভিস অফিসে গিয়ে দায়িত্বশীল কাউকে পাওয়া যায়নি। সেখানকার নিরাপত্তাকর্মীরা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল ইসলাম মোবাইল ফোনে কালের কণ্ঠকে জানান, তিনি দুজনের ঠিকানা দেওয়ার পর তাদের ধরিয়ে দিতেও পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও র‌্যাবকে সহায়তা করছেন। গতকাল বিকেলে নারায়ণগঞ্জে যান আমিরুল; সেখানে রাসেলের ভাই মাহবুব একটি গার্মেন্ট কারখানায় চাকরি করেন। তাজুল ও রাসেল ডিসেম্বরে তাঁর প্রতিষ্ঠানে যোগদান করে বলে জানান আমিরুল। এর চেয়ে বেশি তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।
মিরপুর থানায় গেলে ডিউটি অফিসার এসআই আনোয়ার হোসেন জানান, সোমবার রাতে মামলা হলেও গতকাল বিকেল পর্যন্ত তদন্ত কর্মকর্তা নির্ধারিত হয়নি। থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মঈনউদ্দিন মঈন বলেন, 'বিভিন্ন কৌশলে দুই নিরাপত্তাকর্মীকে ধরার চেষ্টা চলছে। তাদের পেলেই রহস্য বের হবে।'
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি : হাইকোর্টের আইনজীবী রওশন আখতারের নিহত হওয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। গতকাল এক বিবৃতিতে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন সংগঠনটির সভাপতি আয়শা খানম ও সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু।

No comments

Powered by Blogger.