বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৬১২ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। আনোয়ার হোসেন, বীর প্রতীক সাহসী এক যোদ্ধা
বরিশাল জেলার অন্তর্গত গৌরনদী।
এর অবস্থান বরিশাল সদর থেকে উত্তরে। মুক্তিযুদ্ধকালে এ এলাকার বিভিন্ন নদী দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রসদবাহী লঞ্চ কয়েক দিন পর পর চলাচল করত। লঞ্চের আগে-পিছে থাকত বিশেষ জলযান। পাকিস্তানি মিলিশিয়ারা ওই জলযানে করে লঞ্চ প্রহরা দিয়ে গন্তব্যে নিয়ে যেত।
১৯৭১ সালের জুলাই মাসের শেষ দিকে আনোয়ার হোসেনসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা গৌরনদী এলাকায় ছিলেন। এ সময় একদিন ভোরে তাঁর দলনেতা খবর পান, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য রসদবাহী একটি লঞ্চ ওই এলাকার নদী দিয়ে কোথাও যাচ্ছে। তাঁরা দলনেতার নির্দেশে দ্রুত তৈরি হয়ে নদীতীরে সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নেন। একটু পর তাঁরা দেখতে পান, লঞ্চটি এগিয়ে আসছে।
নদীতীরে আনোয়ার হোসেন ও তাঁর সহযোদ্ধারা অবস্থান নিয়েছিলেন আড়ালে। পাকিস্তানি মিলিশিয়া ও সহযোগী কেউ তাঁদের দেখতে পায়নি। নদীর ওই স্থান ছিল কিছুটা সরু। লঞ্চ অস্ত্রের আওতার মধ্যে আসামাত্র গর্জে ওঠে তাঁদের সবার অস্ত্র। পাকিস্তানি মিলিশিয়া ও তাদের বাঙালি সহযোগীরাও পাল্টা গুলি করে। তবে তারা বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধারা লঞ্চ ও বিশেষ জলযান লক্ষ্য করে দু-তিনটি মর্টারের গোলা ছোড়েন। সেগুলো লঞ্চ বা জলযানে আঘাত করেনি। কিন্তু এতে পাকিস্তানি মিলিশিয়া ও সহযোগীরা ভয় পেয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা লঞ্চ ফেলে বিশেষ জলযানে করে পালিয়ে যায়।
এর কিছুদিন পর আগস্ট মাসের একদিন, আনোয়ার হোসেন ও তাঁর সহযোদ্ধারা পাতারহাটে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি গানবোটে আক্রমণ করেন। পাকিস্তানি সেনারাও তাঁদের পাল্টা আক্রমণ করে। তখন দুই পক্ষে অনেকক্ষণ যুদ্ধ হয়। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা ব্যাপক গোলাগুলি করে তীরে নামে। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ভাঙার চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণের মুখে তিন-চারজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে তারা গানবোটে ফিরে যায় এবং গোলাগুলি ছুড়তে ছুড়তে পালিয়ে যায়।
এ যুদ্ধে আনোয়ার হোসেন ও তাঁর কয়েকজন সহযোদ্ধা যথেষ্ট বীরত্ব প্রদর্শন করেন। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের কারও কোনো ক্ষতি হয়নি।
আনোয়ার হোসেন ১৯৭১ সালে সিলেটে ওয়াপদায় (বর্তমানে পানি উন্নয়ন বোর্ড) চাকরি করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে তিনিও ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যান। পরে ৯ নম্বর সেক্টরের টাকি সাব-সেক্টরে গিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। প্রশিক্ষণ নিয়ে জুলাই মাসে বরিশাল আসেন। পরবর্তী সময় তিনি ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমরের (বীর উত্তম, পরে মেজর, বর্তমানে রাজনীতিক ও ব্যারিস্টার) নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীর অধীনে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য আনোয়ার হোসেনকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৩৮৫।
আনোয়ার হোসেন স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডে কর্মরত ছিলেন। চাকরিতে থাকা অবস্থায় মারা যান। তাঁকে পৈতৃক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। পরবর্তী সময় তা নদীভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। তাঁর পৈতৃক বাড়ি বরিশাল জেলার মুলাদী উপজেলার পাতারচর গ্রামে। বাবার নাম আমির হোসেন, মা আমেনা বেগম। স্ত্রী দেলোয়ারা বেগম। তাঁদের তিন মেয়ে, দুই ছেলে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৯।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
ৎashedtৎ@pৎothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.