নিউ ইয়র্ক টাইমসের বাছাই ১২ খবরে তাজরীন ট্র্যাজেডি

ইংরেজি বছরের প্রথম দিনে গতকাল মঙ্গলবার নিউ ইয়র্ক টাইমসে আবার পড়ার মতো বাছাই করা ১২ প্রতিবেদনের তালিকায় উঠে এলো বাংলাদেশের তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের খবর।
প্রতিবেদনটি শুরু হয়েছে এভাবে-
আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গেই বেজে ওঠা সংকেতে (অ্যালার্ম) তাজরীন পোশাক কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের মনোযোগ গেল ভেঙে। শত শত শ্রমিক তাঁদের মেশিন থেকে চোখ সরিয়ে আতঙ্কিতভাবে তাকালেন এদিক-সেদিক। ভবনটির চতুর্থ তলায় একটি জ্যাকেটের ঢাকনা সেলাই করছিলেন নারী শ্রমিক সীমা আখতার পাখি। দ্রুত তিনি ছুটে গেলেন সিঁড়ির দিকে। কিন্তু বাদ সাধলেন দুই কর্মকর্তা। বললেন, ওটা একটা পরীক্ষামূলক সংকেত। আতঙ্কিত না হয়ে সবাই কাজে ফিরে যান।
স্বস্তির হাঁফ ছেড়ে পাখিসহ অন্য শ্রমিকরা আবার ফিরলেন কাজে। কিন্তু আনুমানিক ৯০ সেকেন্ড পর আবারও বাজল সংকেত। তখনো পাখিরা চালিয়ে যাচ্ছেন কাজ। পার হলো আরো ৯০ সেকেন্ড। এবার ছাইরঙা ধোঁয়ার কুণ্ডলী শোঁ শোঁ করে এসে ছড়িয়ে পড়তে লাগল ঘরজুড়ে। শ্রমিকরা দেখলেন, ওই দুই কর্মকর্তা উধাও। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় মুহূর্তেই আটতলা ওই ভবনে নেমে এলো অন্ধকার। এরপর আর্তচিৎকার আর প্রাণ বাঁচাতে ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল শ্রমিকদের।
প্রতিবেদনে এরপর একে একে কয়েক শ শ্রমিকের পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া এবং আগুনে দগ্ধ হয়ে আহতদের বর্ণনা ও আগুনের ঘটনার মর্মস্পর্শী কাহিনী উঠে এসেছে।
নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার এবারের বাছাই ১২ প্রতিবেদনের প্রথমেই রয়েছে আফ্রিকার কঙ্গোয় শিশুদের খাবারের জন্য যুদ্ধের খবর। শিরোনামে বলা হয়েছে, কঙ্গোর শিশুদের এক দিন খাবার জুটলে পরের দিন জোটে না। এভাবেই চলছে তাদের জীবন। পুরো সংবাদে উঠে এসেছে কঙ্গোর মাথাপিছু আয় সম্পর্কিত তথ্য। কঙ্গোর মাথাপিছু আয় এতই কম যে, একটি পরিবারের তিন থেকে ১৫ বছরের শিশুদের প্রতিদিন খাবারের যোগান দিতে পারেন না তাদের অভিভাবকরা।
দ্বিতীয় প্রতিবেদনটির নাম দেওয়া হয়েছে 'টাকার বাড়ি'। এতে আইরিশ শিল্পী ফ্রাঙ্ক বাকলির গড়া মুদ্রায় নির্মিত বাড়ির খবর রয়েছে। আধুনিক আইরিশের অবস্থানকে প্রতীকীরূপে প্রকাশ করা হয়েছে এখানে। ৫০ হাজার পরিত্যক্ত, ছেঁড়া ও অননুমোদিত আইরিশ মুদ্রা ইউরো দিয়ে নির্মিত হয়েছে ওই বাড়ি। সংবাদের ছবিতে দেখা যায়, শিল্পী নিজে বেকার বাস করছেন সেখানে। ইউরো আচ্ছাদিত দেয়ালে সাঁটানো পেইন্টিংয়ে প্রকাশ পেয়েছে একটি অবয়ব। মুখাবয়বে হা-করা ক্ষুধার্ত মুখবিবর অর্থনৈতিক মন্দায় বিধ্বস্ত দেশের বর্তমান অবস্থা ছাড়াও অন্য এক গভীর তাৎপর্যময় অর্থ প্রকাশ করছে।
তৃতীয় প্রতিবেদনটিতে উঠে এসেছে নতুন স্থান ও নতুন পরিবেশে মার্কিন শিশুদের জীবনযাপনে নানা সমস্যার কথা। মা-বাবার চাকরিতে বদলি বা বিভিন্ন কারণে বহু মার্কিন শিশুর পরিবারের সঙ্গে মেক্সিকোতে বাস করতে হচ্ছে। মার্কিন সংস্কৃতি থেকে হঠাৎ করে এই শিশুরা নতুন দেশের ভিন্ন সংস্কৃতি ও পরিবেশে এসে স্কুলে যাচ্ছে, সেখানকার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশছে। ভাষাগত সমস্যা এমনকি বসতবাড়ির পরিবেশও এদের কাছে অদ্ভুত ঠেকছে।
চতুর্থ প্রতিবেদনটিতে মিসরের বর্তমান প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির সহধর্মিণী নাগলা আলীর বিষয়টি উঠে এসেছে। এই নারী নিজের নামের আগে ফার্স্ট লেডি শব্দটি ব্যবহার করতে রাজি নন। সাধারণ নারীর মতোই তাঁকে প্রায়ই হাঁটতে দেখা যায় রাস্তায়। অনেকের মতে, ফার্স্ট লেডির সাধারণ বেশভূষা যেন মিসরে গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থান ও পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করছে।
পঞ্চম প্রতিবেদনটি পাকিস্তানের এক টিভি উপস্থাপকের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা। ৪১ বছর বয়সী ওই উপস্থাপকের নাম আমির লিয়াকত হুসেন। অসাধারণ সংবেদনশক্তির জন্য তিনি ইতিমধ্যে বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন। লিয়াকত বিরামহীন উপস্থাপনা করতে পারেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। গত রমজান মাসে প্রতিদিন তিনি একটানা ১১ ঘণ্টা করে উপস্থাপনা করেছেন।
ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোতে হাতি নিধনের এক বর্বরোচিত করুণ কাহিনী উঠে এসেছে ষষ্ঠ প্রতিবেদনে। ২২টি হাতির মৃতদেহ পড়ে রয়েছে গারাম্বা ন্যাশনাল পার্কের হাতিদের এক নিরাপদ বিচরণ এলাকায়। অনেকগুলোকে হত্যা করা হয়েছে মাথায় গুলি করে। কারা এ হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না। তবে পার্কের কয়েকজন গার্ড একদিন দেখলেন, ওই এলাকায় উগান্ডার সেনাদের একটি হেলিকপ্টার উড়ছে। এর মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ বুঝল, উগান্ডার ওই সেনারা হাতির বহুমূল্য দাঁতের জন্যই এই নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। যদিও উগান্ডার পক্ষ থেকে তা অস্বীকার করা হয়।
সপ্তম প্রতিবেদনটিতে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন আর তালেবানি উন্মাদনার শিকার যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের এক স্বজনহারা পরিবারের বিয়োগান্তক কাহিনী স্থান পেয়েছে।
ইতালির দক্ষিণাঞ্চলে একটি সেতু তৈরিতে দুর্নীতির মহোৎসবের চিত্র অষ্টম প্রতিবেদনটিতে উঠে এসেছে। নবম প্রতিবেদনে স্থান পেয়েছে আফগানিস্তানে আমেরিকার যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট অবস্থায় সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা শীর্ষক খবরটি। চীনের রাজনীতিতে ধনীদের দৌরাত্ম্যের বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে দশম প্রতিবেদনে। একাদশ প্রতিবেদনটিও চীনের রাজনীতি নিয়ে। আর ১২ নম্বর প্রতিবেদনটি গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের তাজরীন ফ্যাশনসের আগুন ঘিরে।

No comments

Powered by Blogger.