কান্না-হাসির দোল দোলানো ২০১২

২০১২ সালে নারীদের যেমন অর্জন ছিল, তেমনি নানা দুর্ঘটনার খবরও ছিল পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনজুড়ে। বাংলাদেশের প্রথম নারী হিসেবে নিশাত মজুমদার, তাঁর পর পরই আরেক নারী ওয়াসফিয়া নাজরীনের এভারেস্ট বিজয়; রিজওয়ানা হাসানের ম্যাগসাইসাই পুরস্কার জয়—ব্যক্তিগত এমন অর্জন সবার জন্যই ছিল অনুপ্রেরণা।
নতুন বছরে হিসাবনিকাশের খাতাটা বের করে মিলিয়ে নেওয়া যাক ২০১২ সালে নারীদের সাফল্য-ব্যর্থতা।

তাঁরা ১০ জন
২০১২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ১০ জন ছাত্রী ডিন সম্মাননা অর্জন করে তাঁদের মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। গত বছরের ৩০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ডিন সম্মাননা পদক ও ডিন পদক পেয়েছেন ১৩ জন। এর মধ্যে ১০ জনই ছাত্রী।তাঁরা হলেন তাওহিদা জাহান (ভাষা বিজ্ঞান), সৈয়দা ইফাত আরা (নাট্যকলা বিভাগ), সিরাজুম মুনীরা (ইসলামীশিক্ষা), শামিমা নাসরীন (উর্দু), শারমিন নাহার (ফারসি ভাষা ও সাহিত্য), সোমা দে (সংস্কৃত), জাফরিন রেজওয়ানা (ইতিহাস), তানজিনা মেনোজ (দর্শন), নাজমা (ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি) ও শামিমা ইয়াসমিন (তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা)।

পোশাক শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড
২০১২ সালের সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা ছিল আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। গত বছরের ২৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় অগ্নিকাণ্ডের শুরু হয়। পরদিন ভোর পাঁচটার দিকে আগুন নেভানো সম্ভব হয়। আগুনের ভয়াবহতায় প্রাণ হারান নারী শ্রমিকসহ ১১১ জন। বহু লাশ আত্মীয়স্বজনেরা শনাক্ত করতে পারেননি। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ২৭ নভেম্বর দেশে এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়।

আরেকটি অর্জন
গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার আবিদা সুলতানা ‘আইএডব্লিউপি-২০১২ ইন্টারন্যাশনাল স্কলারশিপ অ্যান্ড রিকগনিশন’ পুরস্কার অর্জন করেন। পুরস্কারটি প্রদান করা হয় কানাডার নিউফাউন্ডল্যান্ডে এসটি জোনস শহরে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব উইমেন পুলিশের ৫০তম বার্ষিক সম্মেলনে। এ পুরস্কারের জন্য সারা বিশ্ব থেকে ২৯ জন নারী পুলিশ সদস্যের আবেদন গ্রহণ করা হয়, যাঁদের মধ্য থেকে আবিদা নির্বাচিত হন। তিনি এর আগে বাংলাদেশের প্রথম নারী পুলিশ ইউনিট-১১ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক ছিলেন।

বাজেটে নারী উদ্যোক্তাদের অর্জন
২০১২-১৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সুখবর নিয়ে এসেছে। বাজেটে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ১০০ কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ টাকায় নারী উদ্যোক্তাদের পণ্য বিক্রয়ের জন্য সুনির্দিষ্ট স্থান, আলাদা তথ্য সংগ্রহের স্থান, উদ্যোক্তাদের তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষতা বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ খাত নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিটি ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে স্বতন্ত্র নারী উদ্যোক্তাদের জন্য নির্দিষ্ট ডেস্ক স্থাপনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয়, ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বন্ধকবিহীনভাবে ঋণ নেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে এ বাজেটে।

জেএসসি ও পিএসসিতে ভালো ফলাফলে মেয়েরা এগিয়ে
সারা বছরের নানা দুর্ঘটনার খবরের বাইরে বছর শেষে ছিল আনন্দের খবর। ২০১২ সালের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিএসসি) ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় (জেএসসি) জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার দিক থেকে মেয়েরা ছিল এগিয়ে। এমনকি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে ছেলেদের থেকে মেয়েদের সংখ্যা ছিল বেশি।

হাওয়া আক্তারের ভালো ফলাফল
নরসিংদীর হাওয়া আক্তার যেন সব নারীর জন্য অনুপ্রেরণা। ২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর তাঁর স্বামী রফিকুল লেখাপড়া করতে চাওয়ার কারণে হাওয়ার ডান হাতের চার আঙুল কেটে নেন। কিন্তু থেমে থাকেননি অদম্য এই নারী। গত বছরের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে তিনি এ গ্রেড (জিপিএ ৪ দশমিক ৩) পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন।

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি
গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটির পরিপত্র জারি করেছে সরকার। কর্মরত শিক্ষক বা নারী কর্মী কর্মজীবনে সর্বোচ্চ দুবার এ ছুটি পাবেন। গর্ভধারণের পরে যেদিন থেকে ছুটির আবেদন করবেন, সেদিন থেকেই তাঁকে তাঁর প্রাপ্য ছয় মাস ছুটি দিতে হবে। দুই বছর আগে সরকারি প্রতিষ্ঠানের নারী কর্মীদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম নারী ডেপুটি গভর্নর
নারীর অর্জনের তালিকায় আরেকটি বড় সফলতা এনে দিয়েছেন নাজনীন সুলতানা। গত বছরের জানুয়ারিতে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম নারী ডেপুটি গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত হন। এর আগে নাজনীন সুলতানা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম নারী মহাব্যবস্থাপক ও প্রথম নারী নির্বাহী পরিচালক হিসেবেও কাজ করেন। এ ব্যাংকে কম্পিউটার উপবিভাগে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি।

বন সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক পুরস্কার
গত বছর কক্সবাজার জেলার টেকনাফের কেরোনতলী গ্রামের খুরশিদা বেগম ওয়াংগারি মাথাই পুরস্কার অর্জন করেছেন। বিনা বেতনে কঠোর পরিশ্রম করে বন বিভাগের বিশাল সংরক্ষিত বনাঞ্চল রক্ষা, বন্য প্রাণীসহ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং পরিবেশ রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য এ পুরস্কারটি অর্জন করেন। ২০১১ সালে কেনিয়ার নোবেলজয়ী পরিবেশবিদ ওয়াংগারি মাথাই মারা যান। তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে সম্মান জানাতে জাতিসংঘের বন ও পরিবেশবিষয়ক বিভিন্ন সংস্থার উদ্যোগে গঠিত ‘দ্য কোলাবরেটিভ পার্টনারশিপ অব ফরেস্ট (সিপিএফ)’ পুরস্কারটি চালু করে। এটি এ বছর প্রথম অর্জন করেন খুরশিদা বেগম। টেকনাফ নিসর্গ বনরক্ষা সহব্যবস্থাপনা কমিটিতে তিনি ২০০৪ সালে যোগদান করেন। এরপর খুরশিদা ২৮ জন নারীকে নিয়ে গঠন করেন কেরোনতলী মহিলা বন পাহারা দল।

No comments

Powered by Blogger.