নতুন বছরে নতুনের আবাহনপ্রস্তুত।

১৯৯৯ সালে প্রথমবার ব্রাজিলের হলুদ জার্সি গায়ে চাপানোর পর থেকেই নিজের জাত চেনান রোনাল্ডিনহো। অভিষেকের মাত্র তিন বছরের মাথায় ২০০২ সালের বিশ্বকাপের মধ্য দিয়েই মূলত উত্থান বিশ্বখ্যাত এ ফুটবলারের।
এশিয়ার কোরিয়া-জাপানে অনুষ্ঠিত ওই আসরের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে তাঁর সেই ঐতিহাসিক ফ্রিকিক থেকে গোল ব্রাজিলকে সেমির টিকেট পাইয়ে দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপও জিতে নিয়েছিল পেলের উত্তরসূরিরা। ওই সময়ে জাতীয় দল এবং ক্লাব দল বার্সিলোনার হয়ে দাপটের সঙ্গে মাঠ মাতিয়েছিলেন। কিন্তু গত কয়েক বছর থেকেই তাঁর পড়তি ফর্ম। যে কারণে ছিলেন না ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে ডুঙ্গার দলে। ওই বছরেই ইতালির এসি মিলান ছেড়ে নিজে দেশের ক্লাব ফ্লেমেঙ্গোতে যোগ দেয়ার পর আবারও পুরনো বিধ্বংসী ফর্মে প্রত্যাবর্তন করেন সাবেক ফিফা বর্ষসেরা এই ফুটবলার। কিন্তু বিদায়ী বছরে (২০১২ সাল) ফের বন্দী হয়েছেন ব্যর্থতার খোলসে।
গত মৌসুমে ফ্লেমেঙ্গোতে রীতিমতো দুরন্ত, দুর্বার ছিলেন রোনাল্ডিনহো। দলের হয়ে ৩৩ ম্যাচে করেন ১৫ গোল। এ কারণেই তৎকালীন ব্রাজিল কোচ মেনেজেস তাঁকে আবারও দলে ডাকেন। মূলত কোপা আমেরিকার ব্যর্থতা এবং জার্মানির কাছে প্রীতি ম্যাচে ৩-২ গোলে হারের কারণেই অভিজ্ঞ এই ফুটবলারের শরণাপন্ন হন মেনেজেস। ২০১০ সালের নবেম্বরে সর্বশেষ জাতীয় দলের হয়ে খেলার পর ফের সুযোগ পান এ্যাটাকিং এই মিডফিল্ডারের। কিন্তু মাঠে খেলার সুযোগ পাননি ইনজুরির কারণে। সোলারি দায়িত্ব নেয়ার পর ফের দলে সুযোগ পাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। ২০১২ সালে নিজ দেশের ক্লাব এ্যাটলেটিকো মিনেইরোতে যোগ দেয়া রোনির স্বপ্নপূরণ হয় কিনা সেটাই দেখার। এখন পর্যন্ত ব্রাজিলের হয়ে ৯৪ ম্যাচে ৩৩ গোল করেছেন রোনাল্ডিনহো। মানো মেনেজেসের চোখে বাতিলের খাতায় পড়ে গিয়েছিলেন রোনাল্ডিনহো। কিন্তু মেনেজেসকে বরখাস্ত করে ব্রাজিল নতুন কোচ হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে লুইস ফিলিপ সোলারিকে। দায়িত্ব নিয়েই সোলারি বলেছেন, প্রয়োজন হলে রোনাল্ডিনহোর মতো সিনিয়র খেলোয়াড়দের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাবেন। কোচের এমন মন্তব্যের পর থেকে স্বপ্ন দেখছেন রোনি। ব্রাজিলিয়ান এই তারকাকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন সালমান খানের ভাই সোহেল খান। সিনেমাটির নামও আর-১০। ২০১৪ সালের মে মাসে মুক্তি দেয়া হবে এই লক্ষ্য নিয়েই এগিয়ে চলেছে চলচ্চিত্রটির কাজ। এরই অংশ হিসেবে সম্প্রতি ভারতে এসেছিলেন ব্রাজিলিয়ান তারকা। সেখানেই তিনি মেলে ধরেন স্বপ্নের ডাল। ২০০২ সালে ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ জেতাতে ২২ বছরের রোনাল্ডিনহো রেখেছিলেন অসামান্য অবদান। ২০০৪ ও ২০০৫ সালে টানা দু’বারের ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার ২০০৬ জার্মান বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েছিলেন সর্বকালের সেরা হওয়ার হাতছানি নিয়ে। কিন্তু ওই বিশ্বকাপ থেকেই হারিয়ে যাওয়ার শুরু রোনির। এরপর থেকে হেঁটেছেন শুধু পেছন দিকে। তবে এজন্য অবহেলায় বেশি দায়ী। বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে দেখেছে স্রেফ অবহেলায় ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা প্রতিভার অপচয়! একসময় যাঁর পায়ের জাদু দেখার জন্য বুঁদ হয়ে থাকত ফুটবলপ্রেমীরা, ফুটবলকে গৌণ করে সেই রোনাল্ডিনহো নাকি অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে মত্ত হয়ে ওঠেন। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অবশেষে সুসময়ে ফিরেছেন রোনাল্ডিনহো। এ্যাটলেটিকো মিনেইরোর হয়ে মৌসুমটি ভালই কাটছে। ২০০৬ বিশ্বকাপ থেকে খেই হারিয়ে ফেলার পর দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর অফ ফর্ম, ইনজুরি, পরকীয়া, নাইট ক্লাবে জীবনযাপনসহ নানাবিধ বিতর্কের সঙ্গী হয়ে ফুটবল ক্যারিয়ারটাই প্রায় ধ্বংস করতে বসেছিলেন রোনাল্ডিনহো। সেই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রোনির উত্তরণ শুরু হয় ২০০৮ সালের শেষভাগ থেকে। এ সময় স্পেন ছেড়ে ইতালির এসি মিলানে এসে নিজেকে খুঁজে পেতে থাকেন শৈল্পিক ছন্দের কারিগর। এসি মিলানে নিজের প্রথম মৌসুমটা বেশ সার্থকতার সঙ্গেই খেলেন। কিন্তু ২০১০ মৌসুমটা শুরু করেন আরও দুর্দান্তভাবে। ওই সময়ে রোনির খেলায় দেখা মেলে সেই ড্রিবলিং, সেই হেডার, সেই চিরচেনা ছন্দ। মাঠে ফের আল্পনা আঁকতে থাকেন মাথার আঁচড়ে কিংবা পায়ের তুলিতে। কিন্তু ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে ব্যর্থ হন। বার্সিলোনায় থাকাকালীন তৎকালীন কোচ ফ্রাঙ্ক রাইকার্ড তাঁকে ইচ্ছাকৃতভাবেই সাইডলাইনে বসিয়ে রাখতেন। বার্সাও তাঁকে যোগ্য প্রতিদান দেয়নি। কিন্তু এই বার্সারই চরমতম দুর্দিনে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন রোনাল্ডিনহো।
নিজের পায়ের মন্ত্রমুগ্ধতে একের পর এক শিরোপা উপহার দেন। এত কিছুর পরও সেসময় রাইকার্ড রোনাল্ডিনহোকে বলেছিলেন, বার্সিলোনার দরজা তোমার জন্য খোলা। তুমি ইচ্ছা করলেই যেতে পার। রোনির বার্সা ছাড়ার গুজব অনেকদিন থেকে চললেও রাইকার্ডের এই ধৃষ্টতাপূর্ণ কথার পর নিশ্চিত হয় বিষয়টি। অবশ্য এরপর কিছুটা নমনীয় হয়েছিলেন রাইকার্ড। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। কেননা রোনাল্ডিনহোর আগেই বার্সিলোনা থেকে বিদায়ঘণ্টা বাজে রাইকার্ডের। এরপর নয়া কোচ পেপ গার্ডিওলা দায়িত্ব নেয়ার পর রোনির ক্যারিয়ারে প্রগাঢ় অমানিশা নেমে আসে। কারণ দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই গার্ডিওলা সাফ জানিয়ে দেন একাদশে জায়গা হবে না রোনাল্ডিনহোর! এরপরই ন্যুক্যাম্প ছাড়ার বিষয়ে মানসিকভাবে প্রস্তুত হন সাম্বা ছন্দের অন্যতম সেরা তারকাটি। অনেক ভেবেচিন্তে ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটিকে পেছনে ফেলে এ তারকা নাম লেখান এসি মিলানে। ২০০৮ সালের ১৫ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে মিলানের পতাকাতলে হাজির হন এ ব্রাজিলিয়ান প্লে-মেকার। ২০০৩ সালে ক্যাটালন শিবিরে যোগ দিয়েছিলেন রোনাল্ডিনহো। সেসময় প্রচ- দুঃসময় চলছিল ন্যুক্যাম্পে। চারদিকে বিরাজ করছিল হতাশা আর ঘোর অমানিশা। স্প্যানিশ এ জায়ান্টের দুঃখ ঘোচাতেই যেন ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হন রোনি। তাঁর আবির্ভাবেই আমূল পাল্টে যায় দুর্দশাগ্রস্ত বার্সার চেহারা। বার্সিলোনায় যোগ দেয়ার প্রাথমিক সময়গুলো বেশ সুখে কাটতে থাকে ২০০২ বিশ্বকাপের পার্শ্ব নায়কের। স্বপ্নের ফর্ম দেখিয়ে ২০০৫ ও ২০০৬ সালের স্প্যানিশ লা লীগা জেতানোর পাশাপাশি জয় করেন ২০০৬ সালের ইউরোপ সেরা ট্রফি চ্যাম্পিয়ন্স লীগের শিরোপা। দুর্দান্ত এই ফুটবল নৈপুণ্যের সময় পরপর দু’বার ফিফা বর্ষসেরা খেলোয়াড়ও নির্বাচিত হন। কিন্তু দুঃসময়টা তাঁর ভর করে জার্মান বিশ্বকাপ থেকে। অসাধারণ ফর্ম নিয়ে বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে পুরো দলের মতো নিজেও খেই হারিয়ে ফেলেন। সেইসঙ্গে ইনজুরি আর বেপরোয়া জীবন ধীরে ধীরে তলানিতে ফেলে দেয় তাঁকে। এর ফলে টালমাটাল হয়ে ভুলের সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকেন।

No comments

Powered by Blogger.