পাশ্চাত্যের প্রকৃত শত্রু কে ॥ মূল : আল সায়ীদ আমিন শালাবি অনুবাদ : by এনামুল হক

স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের ঠিক পর পরই এক প্রাক্তন সোভিয়েত বিশেষজ্ঞ আমেরিকানদের বলেছিলেন ‘আমরা আপনাদের শত্রু থেকে বঞ্চিত করেছি।’ তাঁর বক্তব্য ছিল এই যে, টিকে থাকার জন্য, যুদ্ধের চাকা সচল রাখার জন্য, আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে বিশ্বজয়ের যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য আমেরিকার একটা শত্রুর প্রয়োজন। সেই শত্রুর আবির্ভাব ঘটতে অবশ্য সময় লাগেনি।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটার সময় ইরান ছিল আমেরিকার শত্রু তালিকার দ্বিতীয় স্থানে। ইরানের মোল্লারা আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রকে মহাশয়তান হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। এখন তাদের কণ্ঠে কণ্ঠ মেলাল সারা বিশ্বের বিভিন্ন জিহাদী সংগঠন ও উগ্রবাদী ইসলামপন্থী গ্রুপ।
খুব বেশি দিনের কথা নয় যে, অধ্যাপক স্যামুয়েল হান্টিংটন তাঁর ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন বা ‘সভ্যতার সংঘাত’ বইটি হাজির করেছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন যে, চীন ও ইসলাম আমেরিকার জীবন ধারার প্রতি প্রধান হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হবে।
হান্টিংটনের এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন এসপোজিটো। “দি ইসলামিক থ্রেট : মিথ্্ অব্ রিয়েলিটি” গ্রন্থে তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে, ইসলামের চরমপন্থী অভিপ্রকাশটা ইসলামী বিশ্বের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যের অনুসৃত নীতির প্রতিক্রিয়ামাত্র।
নাইন ইলেভেনের হামলার সময় কেউ কেউ এ ঘটনাকে হান্টিংটনের বক্তব্যের যথার্থতার প্রমাণ হিসেবে দেখেছিল। অচিরেই জর্জ বুশের প্রশাসন সন্ত্রাসবাদ দমনের এক বিশ্বব্যাপী স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করে। সেই স্ট্র্যাটেজি থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, তারা যে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়ছে তা একান্তভাবেই মুসলিম সন্ত্রাসবাদ। সাধারণভাবে বলতে গেলে ইসলাম চরিত্রগতভাবে একটা সহিংস ধর্ম এবং গণতন্ত্র বিরোধীÑ এ রকম একটা ধারণা আফগানিস্তান ও ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বুদ্ধিবৃত্তিক পটভূমি তৈরি করে।
জন এসপোজিটো আবারও এ ধরনের চিন্তাধারাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। “দ্যা ফিউচার অব ইসলাম” গ্রন্থে তিনি ইসলামী সহিংসতা মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যÑ এমন বক্তব্যকে খ-ন করেছেন। মুসলিম বিশ্বে নাইন ইলেভেনের হামলার ব্যাপক নিন্দা ও ধিক্কারের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেছেন, মুসলমানদের মধ্যে যেমন ধর্মোন্মাদ আছে, তেমনি আছে উদার ও সংস্কারপন্থীরাও।
এসেপোজিটো যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র নতুন করে নির্ধারণের এক নতুন সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনায় নিয়োজিত। বিনা বিচারে আটক এবং জঙ্গীদের প্রতি দুর্ব্যবহারসহ আমেরিকা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যেসব সহিংস কার্যকলাপ চালিয়েছে তিনি দৃষ্টান্ত সহকারে তা তুলে ধরেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, প্যাট্রিয়ট এ্যাক্টের দ্বারা আমেরিকার মুসলমানদের নাগরিক অধিকার ক্ষুণœ করা হয়েছে।
এসপোজিটো বলেন, ইসলাম একই সঙ্গে এখন একটা রাজনৈতিক মত ও ধর্মবিশ্বাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসলাম একটা বৈশ্বিক মতাদর্শে পরিণত হয়েছে, যার প্রভাব সমাজ ও নীতির ওপর এসে পড়ছে। তিনি উল্লেখ করেন যে, আরব-ইসরাইলী সংঘাত, লেবানন ও গাজা প্রশ্নে আমেরিকার ভূমিকা এ অঞ্চলে মার্কিনবিরোধী মনোভাব বাড়িয়ে দিয়েছে।
তিনি বলেন, আমেরিকানরা অনেক সময় অবাক হয়ে ভাবে “ওরা আমাদের ঘৃণা করে কেন?” এর জবাব ধর্মে বা সাংস্কৃতিক পার্থক্যের মধ্যে পাওয়া যাবে না। আমেরিকার প্রতি মৌলবাদীদের যে অন্ধ ঘৃণা বিদ্যমান এবং সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে যে নিরবচ্ছিন্ন ক্ষোভ জাগ্রত, তার মধ্যে পার্থক্য আছে। সাধারণ মুসলমানরা আমেরিকার মূল্যবোধ ও অর্জনসমূহের প্রশংসা করে থাকে। তবে তারা মার্কিন নীতির বিরোধী। মৌলবাদীরা হয়ত আমেরিকানদের হত্যা করতে চায়। তবে সাধারণ মুসলমানরা চায় আমেরিকা এই বিশ্বকে বিপজ্জনক স্থানে পরিণত করা বন্ধ করুক।
এসপোজিটো মার্কিন নীতিনির্ধারকদের ইসরাইলী লবির কথায় কম কান দেয়ার এবং মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার এমন এক সমাধান সক্রিয়ভাবে খুঁজে বের করার পরামর্শ দিয়েছেন যার ফলে একটা নিরাপদ ও টেকসই ফিলিস্তিনী রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটতে পারে। তিনি আরও বলেন, যতক্ষণ তা না হচ্ছে ততক্ষণ আমেরিকাকে শুধুমাত্র ফিলিস্তিনীদের সহিংস কার্যকলাপের নিন্দা করা চলবে না। তাদেরকে ইসরাইলী সামরিক বাহিনীর হিংসাত্মক কর্মকা-েরও নিন্দা করতে হবে।
দ্যা ফিউচার অব ইসলাম’ ২০১০ সালে আত্মপ্রকাশ করে। তারপর থেকে এসপোজিটো ইসলামপন্থীদের ক্ষমতায় উত্থানের ঘটনাগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি এখনও বলে চলেছেন যে, পাশ্চাত্যের শত্রু ইসলাম নয় বরং ধর্মান্ধদের উন্মাদনা। তিনি ইসলামপন্থীদের মডারেট অংশ ও ধর্মোন্মাদ অংশের মধ্যে পার্থক্য টানার জন্য পাশ্চাত্যের রাজনীতিকদের পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন যে, ইসলামপন্থীরা ক্ষমতায় আছে কি নেই তার ওপর নয় বরং গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারছে কি না তার ওপর এ অঞ্চলের ভবিষ্যত নির্ভর করছে। তিনি বলেছেন, গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় বিপদের উৎস হলো সামরিক বাহিনী, গোয়েন্দা সার্ভিস ও আমলাতান্ত্রিক এলিটরা।

লেখক ইজিপশিয়ান কাউন্সিল ফর ফরেন এফেয়ার্সের ম্যানেজিং ডিরেক্টর

No comments

Powered by Blogger.