আমার দেখা কথাশিল্পী শওকত ওসমান by রফিকুন নবী

কিছু মহৎ মানুষ থাকেন যাঁদের শ্রদ্ধা করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে হয়। তাঁদের সৃষ্টিশীল-সৃজনশীল কর্ম, সাধনা, দেশপ্রেম, নির্লোভ জীবনাচার সবাইকে সহজেই কাছে টানে। তাঁদের সান্নিধ্য আলোকিত করে। সমাজ-সংসারে এমন মানুষ ক’জনই বা থাকেন। সংখ্যাটা নিহায়তই গোনাগুনিনতর।
কথাশিল্পী শওকত ওসমান তেমনই একজন পরম শ্রদ্ধেয় কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব। তাঁর সঙ্গে আমার সরাসরি পরিচয় ১৯৬৪ সালের শেষ ভাগে। মাধ্যম তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র বুলবন ওসমান। আমরা দু’জন প্রায় একই সময়ে আর্ট কলেজে শিক্ষতায় ঢুকি। অবশ্য পিতা-পুত্র দু’জনের লেখালেখির সঙ্গে পরিচয় বহু আগে থেকেই ছিল। শুধু পরিচয়ই নয়, আমি তাঁদের ভক্তই ছিলাম।
শওকত ওসমান নিজে সাহিত্যের মানুষ খ্যাতিমান কিংবদন্তি কথাশিল্পী। শিক্ষকতার পেশায় ছিলেন দীর্ঘকাল। পাশাপাশি শিল্পকলার ইতিহাস, পরস্পর এবং আধুনিকতার গতি-প্রকৃতি নিয়েও জ্ঞান ছিল অপরিসীম। প্রসঙ্গ উপস্থিত হলে আলাপ করতেন। আমাকে একনিষ্ঠ শ্রোতার ভূমিকাটি নিতে হতো তখন।
গল্পের বিষয় হতো কলকাতার সাহিত্যাঙ্গন এবং এসব শিল্পীকে নিয়েই বেশি। ১৯৪৭ এর আগে শিল্পী জয়নুল আবেদিন কেমন ছিলেন। তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষকে নিয়ে কেমন করে জয়নুল তাঁর বিখ্যাত চিত্রমালা রচনা করেছিলেন। কামরুল হাসান, সফিউদ্দিন আহমেদ, আনোয়ারুল হক কেমন ধারার কাজ করতেন এবং যেমন ছিলেন তাঁরা তাই নিয়ে স্মৃতিচারণ করতেন।
স্মৃতি খুঁড়ে উপস্থিত হতে বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষদের সঙ্গে তাঁর সান্নিধ্যের কথাও। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নাট্যকার ও নট শম্ভুমিত্র। কলেজে শিক্ষকতার প্রথম পর্যায়ে পাওয়া ছাত্র, পরবর্তীকালের চলচ্চিত্রের মহানায়ক উত্তম কুমারের কথাও বাদ থাকত না। বাদ থাকতেন না মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাশ, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্রের মতো আরও খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বরাও। যাঁদের সাহচর্যে তিনি কলকাতার রুচির হাটে নিজের সাহিত্যচর্চায় মগ্ন হতে পেরেছিলেন। বিশ্বসাহিত্যের এবং শিল্পকলার দিকপালদের কথাও বলতেন অকপটে।
তাঁর কিছু গল্পের ইলাস্ট্রেশান করার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেসব করতে গিয়ে মহা দুর্ভাবনায় পড়তাম এই ভেবে যে পছন্দ না হলে শেষে গালাগাল না খেতে হয়। কিন্তু তেমনটা আর ঘটেনি কোনদিন। এরপর তাঁর কিশোর গ্রন্থ ‘মসকোন’-এর ছবি আঁকতে হয়েছিল। গল্পের ঘটনা এবং চরিত্রগুলোর চিত্রণ সহজ ছিল না। তা ছাড়াও সেই আমলের ‘ব্লক’-এ ছাপার উপযোগী করে আঁকা। ছাপার পরে কেমন অবস্থা দাঁড়ায় তা নিয়ে শঙ্কায় ছিলাম। কিন্তু শেষতক প্রশংসাই করেছিলেন অসুবিধাগুলোকে মেনে নিয়ে। পরে বুঝতে পেরেছিলাম যে ছবি, ইলাস্ট্রেশন, কার্টুনÑ যা কিছুই করি না কেন, চোখে পড়লে প্রশংসাই করতেন। এক সময় তো ‘টোকাই’-এর ভক্ত হয়ে গেলেন। প্রায়ই সাতসকালে টেলিফোন করে অভিনন্দন জানাতেন। অত শিল্পকলা বিষয়ক বোদ্ধা আর বিশাল মাঝের গুণী ব্যক্তিত্বের প্রশংসায় চিরকালই আমি উজ্জীবিত থাকতে পেরেছি এবং তাতে পরবর্তী কাজ যেন আরও ভাল হয় তার চেষ্টা করেছি। নব্বইয়ের শুরুর দিকে তিনি গণতন্ত্রহীনতা এবং সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী লেখালেখিতে বিশিষ্ট হন। সে সময় তিনি ছড়া মতো করে রসালো অথচ সমালোচনাধর্মী কিছু ধারাবাহিক লেখা শুরু করেন। নাম দিয়েছিলেন ‘শেখের সম্বরা’। তো প্রতি রাতে যা লিখতেন পরদিন সাতসকালে টেলিফোনে তা পড়ে শোনাতেন। এটা নিয়মমতো হয়ে গিয়েছিল। আমাকে পড়ে শোনাবার এমনটাই অন্যতম কারণ ছিল সে সবের বই হলে আমাকে কার্টুন করে দিতে হবে।
আবার ১৯৯৭-এর ২৪ জুন তাঁর শেখের সম্বরা’-এর আরও কিছু লিমেরিক মতন লেখার সঙ্গে আমাকে উদ্দেশ করে লিখেছিলেন- ‘স্নেহাস্পদেষু রফিকুন নবী ছবি আঁকে না লেখে সংশয় যায় রেখে। Ñশওকত ওসমান।
১৯৯৬ সালে তৎকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে লেখা একটি খোলা চিঠি তিনি নিজ উদ্যোগে ছেপেছিলেন ছোট পুস্তিকামতন করে। সেটা পড়ার জন্য আমাকে দিয়েছিলেন পুরোটা মনোযোগ দিয়েই পড়তে হয়েছিল। কারণ কেমন হয়েছে তা পড়ার পর যেন জানাই, কড়া করেই দিয়েছিলেন বলা যায়। পড়ে অবাক হয়েছিলাম বক্তব্যের উপস্থাপনা এবং রাজনীতির খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ দেখে। পুরোটাই সমীক্ষা মতন এবং একটি সুলিখিত গুরুত্ববাহী প্রবন্ধও বটে।
খোলাচিঠিতে মহাকবি দান্তের লেখা থেকে একটি অংশ উদ্ধৃত করেছিলেন। ছ’শ’ বছর আগের কথাতে একালের হুবহু মিল খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি আমাদের দেশের সার্বিক অবস্থাকে নিয়ে ভাবতে গিয়ে। উদ্ধৃতির কারণটিও তিনি উল্লেখ করে দিয়েছিলেন সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা মতন করে।
উদ্ধৃতিটি হলো-
অহফ ঁঢ়ংঃধৎঃ সঁষঃবহফ ধহফ ংঁফফবহ ঢ়ৎড়ভরঃং/ঢ়ৎরফব ধহফ বীপবংংবং, ঙ ভষড়ৎবহপব, যধাব রহ ঃযবব/ ঊহমবহফবৎবফ, ংড় ঃযধঃ হড়ি রহ ঃবধৎং ঃযড়ি সড়ঁৎহবংঃ.
তিনি বাংলায় তর্জমা করেছিলেন। তবে তার আগে শুরুতে লিখেছিলেন, ‘মৎকৃত দুর্বল বাঙলা তর্জমা’- এই কথাটি।
এখানে তর্জমাটি উদ্ধৃত করলাম।
“একদঙ্গল হঠাৎ- গজানো ধনদৌলতের অধিকারী/তাদের আকস্মিক মুনাফা, রাশি-রাশি দম্ভ, অনাচার/তোমার বুকে উৎপন্ন তাই অশ্রুসিক্ত, হে ফ্লোরেন্স, তুমি মাতমে মত্ত।’
এরপর এটি উল্লেখ করার মূল প্রয়োজনটির কথা লিখেছিলেন এইভাবে- ‘মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা, ফ্লোরেন্সের জায়গায়, বাংলাদেশ বসিয়ে নিয়ে আপনি এই ভূখ-ের পটভূমি চিত্র পেয়ে যাবেন।’ পরবর্তী লাইনগুলোতে তিনি যাদের জন্য ওই উদ্ধৃতি তাঁদের অর্থাৎ কারা সেথায়, কী দুষ্কর্ম করেছে রাজনীতির পাত্র-পাত্রীদের সেসব উল্লেখ করেছিলাম। সেগুলো এতোটাই দুঃসাহসী যে, আমি এত বছর পরও তা লেখা থেকে বিরত থাকলাম। বলতে দ্বিধা নেই যে, তাঁর মতো সাহসী হওয়ার মতো সাহস অর্জন সহজ নয়।
মানসিকভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল বলে দেশের দুরবস্থা দেখে যেমন বিচলিত হতেন তেমনি আপনজন এবং পরিচিতজনদের জন্যও। মনে আছে নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে তাঁর সঙ্গে মাইক্রোবাসে চেপে চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম। আসলে ত্রি-তরঙ্গ নামের একটি সংগঠনের আমন্ত্রণে সম্ভাবনার ব্যাপারে ছিল সেই যাওয়া। গাড়িতে মোট ৪ জন ছিলাম। কবি শামসুর রাহমান, সঙ্গীতশিল্পী আবদুল লতিফ প্রমুখ ছিলেন সহযাত্রী। এই চার পুরস্কারপ্রাপ্তর মাঝে আমি ছিলাম সর্ব কনিষ্ঠ। অতএব, গাড়িতে খুব সঙ্কোচ নিয়ে বসেছিলাম। তিনি অবশ্য শুরুতেই সহজ হয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘বুঝলে, কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক-সঙ্গীতজ্ঞদের বয়স সব সমান। তারুণ্য নিয়ে থাকাই স্বভাব। অতএব, সহজ হয়ে যাও। তা না হলে একসঙ্গে অতদূর যাবে যে তাতে আমরাও সহজ হতে পারব না।
নানান হাস্যরসাত্মক গল্পগুজবে মেতে উঠেছিলেন তাঁরা। তবে শেষতক শিল্পসাহিত্য থেকে শুরু করে রাজনীতির হালচাল সংক্রান্ত বিষয়াদিতেই ঝুঁকে পড়েছিলেন বেশি। তাঁদের উদ্দীপনা দেখে মনেই হয়নি যে বয়স তাঁদের ধরতে পেরেছে। একসময় কুমিল্লা পার হলাম। শওকত ওসমানকে দেখলাম বেশ বিচলিত হয়ে পড়তে, চালককে বললেন চৌদ্দগ্রামে থামতে হবে। একটি গ্রামে কাজ আছে। বাসস্ট্যান্ডে লোক থাকবে চিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
তাই হলো। চৌদ্দগ্রামে পৌঁছাতেই সেই আরাধ্য গ্রামের একজন মাঝবয়সী লোককে অপেক্ষমাণ দেখে তিনি ছেলে মানুষের মতো হৈ চৈ করে গাড়ি থামাতে বললেন এবং নেমে গিয়ে হাত মেলালেন। তারপর তাকেও গাড়িতে উঠিয়ে নিলেন। এপথ সেপথ করে একটি গেরস্ত-বাড়িতে গিয়ে থামলাম। ঘরবাড়িতে দারিদ্র্যের ছাপ, কিন্তু সাজানো-গোছানো। তিনি ভেতরে চলে গেলেন। এদিকে কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রামের সব বয়সী মানুষের ভিড় বাড়ল। স্কুল-কলেজে পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা নিজ নিজ খাতায় সবার অটোগ্রাফ নিচ্ছে যখন তখন সবাইকে ভেতরে যাওয়ার ডাক পড়ল।
সেসব তো বুঝলাম, কিন্তু এখানেÑ এই গাঁয়ের গ্রামীণ দরিদ্র মানুষগুলোকে দেখতে আসলেন কেন তা বোধগম্য হতে সময় লাগল। খাওয়া শেষে তিনি বাড়ির কর্তাকে কোথাও নিয়ে যাওয়ার কথা বললেন। অবশেষে তাঁর অনুরোধে সবাইকেই যেতে হলো। সবাই গিয়ে দাঁড়ালাম বাড়ির কাছেই থাকা নতুন একটি কবরের কাছে। বুঝলাম কবর জিয়ারতের ব্যবস্থা হয়েছে এবং এও জানলাম যে, এই কারণেই তাঁর এখানে আসা। একজন মৌলভী উপস্থিত ছিলেন আগে থেকেই। দোয়া-কালাম এবং মোনাজাত শেষে সবাই ফেরত আসছি। ঠিক তখনই আবিষ্কার করলাম, শক্তিধর আর দারুণ মনোবলের কথাশিল্পীর নরম মনটিকে। দেখলাম, তিনি একা দাঁড়িয়ে আছেন কবরের পাশে এবং অঝোরে কাঁদছেন। মনে প্রশ্ন জাগল, কার কবর যে তিনি এত ইমোশনাল হয়ে পড়লেন? কে সেই আপনজন?
গাড়িতে বসে তিনিই ব্যাপারটা খুলে বললেন। একটি ছেলে কিশোর বয়সে তাঁদের বাড়িতে এসেছিল কাজ করতে। খুব ভাল ছেলে ছিল বলে একসময় সবার স্নেহে আপনজনের মতো পরিবারের সদস্য মতনই হয়ে গিয়েছিল এবং বহু বছর রয়ে গিয়েছিল। তারপর কিছুদিন আগে তার এই চৌদ্দগ্রামের বাড়িতে এসে হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে মারা যায়। পুরো ঘটনাটায় সবাই খুব ব্যথিত এবং মর্মাহত। প্রায়শই ছেলেটি তাঁকে তার গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাত। কিন্তু তা আর ঘটতে পারেনি। শেষে সুযোগটি হলে ছেলেটির মৃত্যুর পর এই চট্টগ্রামে যাওয়ার সুবাদে।
তো এই মহান ব্যক্তিত্বকে অনেক কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। তাঁর ব্যঙ্গধর্মী কাজ এবং অত্যাধুনিক অসাধারণ জগতটিকে প্রত্যক্ষ করেছিলাম নৈকট্যের সুবাদে। এসবের জন্য আমি নিজেকে ভাগ্যবান তো মনে করিই, সেই সঙ্গে তাঁর কিছু কাজে আমাকে সম্পৃক্ত করার সুযোগ তিনি দিয়েছিলেন তাতে গর্বিত। তিনি আমার কাছে পিতৃতুল্য চির স্মরণীয় একজন কাছের মানুষ। তাঁর ৯৬তম জন্মবার্ষিকীতে রইল শ্রদ্ধাঞ্জলি। (সংক্ষেপিত)আ

No comments

Powered by Blogger.