সাগর-রুনীর খুনীদের ২০ জানুয়ারির মধ্যে গ্রেফতারের দাবি- সাংবাদিকদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচীতে সচিবালয় প্রায় ২ ঘণ্টা অবরুদ্ধ

 সাগর-রুনী হত্যার বিচারের দাবিতে মঙ্গলবার টানা প্রায় দুই ঘণ্টা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে বাংলাদেশ সচিবালয়। এই প্রথম কোন কর্মর্সূচীতে সচিবালয় অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এ সময় প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্রের সব গেট বন্ধ রাখা হয়। মোতায়েন থাকে শতাধিক নিরাপত্তা কর্মী।
সঙ্গে থাকে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যবৃন্দ। এ সময় সচিবালয়ের ভেতরে ও বাইরে আটকা পড়ে কয়েক শ’ লোক। রাস্তা বন্ধ হয়ে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয়। সচিবালয়ে দর্শনার্থী প্রবেশ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনীসহ সব সাংবাদিক হত্যার ‘প্রকৃত’ আসামিদের ২০ জানুয়ারির মধ্যে গ্রেফতারের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে সময় বেঁধে দিয়েছেন সাংবাদিক নেতারা। এদিকে মঙ্গলবার বই বিতরণ কর্মসূচীতে গিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেছেন, সাগর-রুনীর হত্যাকা-ের তদন্ত যাতে সুষ্ঠু ও সুচারুভাবে সম্পাদিত হয়, তার প্রতি আমরা মনোযোগ দিয়েছি। সেই মনোযোগ অনুযায়ী কাজটি সম্পাদিত করার জন্য সবার সঙ্গে আলোচনায় বসেছি। তিনি বলেন, আপনারা আপনাদের দাবি করে যান, আপনাদের দাবি চেতনাবোধের পরিচায়ক। তাকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু দাবির মোড়কে এমন কিছু করবেন না, যাতে তদন্ত কাজ বাধাগ্রস্ত কিংবা প্রভাবিত হয়।
সাগর-রুনী হত্যার বিচার দাবিতে আরও একবার সচিবালয়ের সামনে সাংবাদিকরা অবস্থান কর্মসূচী পালন করলেও তখন সচিবালয়ের গেট বন্ধ করে অবরুদ্ধ রাখা হয়নি। কোন কর্মসূচীতে সচিবালয় অবরুদ্ধ থাকার ঘটনা এটিই প্রথম। সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যবৃন্দ বুঝে ওঠার আগে সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ মিছিল নিয়ে সচিবালয়ের সামনে ঢুকে পড়ে। আগেরবারও একই ঘটনা ঘটেছিল।
মঙ্গলবার দুপুরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচীতে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফজেইউ) একাংশের সভাপতি ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, আগামী ২০ জানুয়ারি সাংবাদিকদের মহাসমাবেশের আগেই সাগর-রুনীসহ সব সাংবাদিক হত্যার ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করতে হবে। এই দাবিতে ২০ জানুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মহাসমাবেশ এবং সারাদেশে প্রেসক্লাবগুলোতে একই কর্মসূচী রয়েছে সাংবাদিকদের প্রধান চার সংগঠনের। ২০ জানুয়ারির মধ্যে দাবি আদায় না হলে মহাসমাবেশ থেকে যে কর্মসূচী দেয়া হবে- তা ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিদায়ের কর্মসূচী’ হবে বলে মন্তব্য করেন বিএফইউজের আরেক অংশের সভাপতি রুহুল আমীন গাজী।গত ২৩ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সাংবাদিকদের প্রতীকী অনশন থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘেরাও ও ২০ জানুয়ারি মহাসমাবেশ কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়। সে অনুযায়ী মঙ্গলবার বেলা ১২টার দিকে জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে মিছিল নিয়ে সাংবাদিকরা ঘেরাও কর্মসূচী পালনে সচিবালয় এলাকায় প্রবেশ করেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘেরাও করে চাপ দেয়া যাবে নাÑ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পাল্টা বক্তব্যে ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, আমরা চাপ দিতে চাই না। আমরা আমাদের আন্দোলন করতে চাই। সে আন্দোলনে কে কোথায় ছিটকে পড়বে তা সময়ই বলে দেবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে তিনি বলেন, এমন একটি সময় আসবে যখন টিভি, পত্রিকা ও সংবাদ সংস্থাগুলো আপনাদের খবর ছাপবে না। এ পর্যন্ত কোন সাংবাদিক হত্যার বিচার হয়নি অভিযোগ করে এই সাংবাদিক নেতা বলেন, সরকার বলছে দেশে আইনের শাসন চলছে। সরকারের এ কথাটি কি প্রশ্নবিদ্ধ নয়? তিনি বলেন, সাগর-রুনী হত্যার বিচার না হলে তাদের একমাত্র সন্তান মেঘ ক্ষোভ নিয়ে বড় হবে। এটা যেন না হয়, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকার ও সাংবাদিকদের।
সাংবাদিকরা সচিবালয়ের দর্শনার্থী গেটের সামনে অবস্থান নেন এবং দুপুর দেড়টা পর্যন্ত ঘেরাও কর্মসূচী পালন করেন। সাংবাদিকদের এই কর্মসূচী চলাকালে সচিবালয়ের সব গেট বন্ধ করে দেয়া হয়। টানা প্রায় দুই ঘন্টা গেট বন্ধ থাকায় কেউ সচিবালয়ের ভেতরে-বাইরে যেতে পারেননি। এ সময় ভেতরে-বাইরে কয়েক শ’ লোক জড়ো হয়। বৈঠক বা সরকারী কাজে বাইরে থাকা অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দেখা গেছে সচিবালয়ের গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে। অনেক দর্শনার্থীও এ সময় সচিবালয়ের গেটে অবস্থান করেন। এতে সচিবালয়ের সামনে মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। রাস্তায় ভয়াবহ যানজট শুরু হয়। অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী ব্যক্তিগত প্রয়োজনে বাইরে এসে সচিবালয়ে ঢুকতে না পেরে দাঁড়িয়ে থাকেন পুরো সময় ।
দুপুর দেড়টায় কর্মসূচীর সমাপ্তি ঘোষণা করা হলেও ভিড় থাকায় গেট খুলতে বিলম্ব করে নিরাপত্তারক্ষীরা। বেলা পৌনে দুইটায় একবার তিন নং (গাড়ি প্রবেশের) গেটটি খোলা হলেও জনরোষে মুহূর্তে আবার বন্ধ করতে বাধ্য হয় নিরাপত্তা কর্মীরা। গেট খোলার সঙ্গে সঙ্গে এই গেট দিয়ে দর্শনার্থী প্রবেশ করার চেষ্টা করলে শেষ পর্যন্ত আবারও গেট বন্ধ করে দেয়া হয়। এর প্রায় ১০ মিনিট পর দর্শনার্থী গেট খুলে দিয়ে লোক সরিয়ে পরে ৩ নং গেটটি খুলে দেয়া হয়।
বই বিতরণ অনুষ্ঠানে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেন, সাগর-রুনী হত্যাকা-ের তদন্ত যাতে সুষ্ঠু ও সুচারুভাবে সম্পাদিত হয়, তার প্রতি আমরা মনোযোগ দিয়েছি। সাংবাদিকদের উদ্দেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আপনারা আপনাদের দাবি করে যান, আপনাদের দাবি চেতনাবোধের পরিচায়ক। তাকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু দাবির মোড়কে এমন কিছু করবেন না, যাতে তদন্ত কাজ বাধাগ্রস্ত কিংবা প্রভাবিত হয়। মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর মিরপুরে মনিপুর স্কুল এ্যান্ড কলেজের ব্রাঞ্চ-৩ এ পাঠ্যপুস্তক বিতরণ উৎসবে যোগ দিয়ে উৎসব শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি একথা বলেন।
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যার দ্রুত বিচার কাজ শেষ করা নিয়ে সাংবাদিকদের তাঁর কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচী প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, এ ধরনের কোন কর্মসূচীর কথা আমার জানা নেই। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, আগের বছরের তুলনায় মানবাধিকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনকÑ এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কিত যেসব প্রতিবেদন উপস্থাপিত হয়, তা আগের তুলনায় সুচারু ও বিস্তৃতভাবে সকলের দৃষ্টিগোচর হয়। যখন বাংলাদেশে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ছিল, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে স্বৈরশাসকরা রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা অধিকার করেছিলেন, তখন মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কিত তেমন কোন প্রতিবেদন সবার নজরে আসেনি। এখন আসছে, তাকে স্বাগত জানাই। এছাড়া সকল ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো জনসাধারণ ও সরকারের গোচরীভূত হওয়া প্রয়োজন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা যাতে কোন ক্রমে না ঘটে সেদিকে নজর দেয়া প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করেন মন্ত্রী।
তিনি বলেন, ১৯৭২ সালে দেশে জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। সে সংখ্যার ক্ষেত্রে যেসব অপরাধমূলক ঘটনা ঘটেছে এবং তার আপেক্ষিকতায় ১৬ কোটি লোকের ক্ষেত্রে যে অপরাধ ঘটছে তা কেবল সংখ্যার নিরিখে বিবেচনা করলে সঠিক তথ্য প্রকাশিত হবে না। সাড়ে সাত কোটি মানুষের সময় যেসব অপরাধ ঘটেছে, সে তুলনায় বর্তমান ১৬ কোটি অধ্যুষিত মানুষের গণতান্ত্রিক শাসনামলে তা অনেক কমে গেছে।

No comments

Powered by Blogger.