প্রেমিকের মাদকাসক্তির জন্যই কি মরতে হলো জেরিনকে by গাফফার খান চৌধুরী

মেডিক্যাল কলেজছাত্রী মীর মনজেরিনা আরাবিয়া জেরিনের মৃত্যুর আসল কারণ মাদক। মাদকাসক্ত প্রেমিকের কারণেই মরতে হলো জেরিনকে। মাদক নিয়ে কথাকাটাকাটির এক পর্যায়ে প্রেমিক স্মরণ উত্তেজিত হয়ে জেরিনকে চলন্ত ট্রেনের নিচে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করে।
ট্রেনের সঙ্গে প্রচ- ধাক্কা খেয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে জেরিনের মৃত্যু হয়। মাদকাসক্ত স্মরণের কারণেই দুটি পরিবারে নেমে আসে চরম অশান্তি। জেরিন মৃত্যুর ঘটনায় প্রেমিক স্মরণ ও তার পিতামাতাকে আসামি করে রাজধানীর কমলাপুর জিআরপি থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন নিহতের খালু হারুন অর রশীদ। জেরিনের পিতামাতা ও একমাত্র ভাই সোমবার দুপুর ১টায় কানাডা থেকে ঢাকায় পৌঁছে। আজ জেরিনের মরদেহ টাঙ্গাইলের নাগরপুরের গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হবে। বাংলাদেশস্থ কানাডীয় দূতাবাস জেরিনের মৃত্যুর ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়েছে। স্মরণকে ৩ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। মামলার অপর দুই আসামি স্মরণের পিতামাতাকে গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে।
মামলার বাদী নিহত জেরিনের খালু হারুন অর রশীদ (৪৭) জনকণ্ঠকে জানান, তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে কর্মরত। তাঁর পিতার নাম তাইমুদ্দিন আহমেদ। বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানাধীন গয়হাটা গ্রামে। তিনি রাজধানীর পশ্চিম রামপুরার উলনের ১২৮/৫ নম্বর বাড়িতে সপরিবারে বসবাস করছেন।
জেরিনের পিতার নাম মীর কায়কোবাদ বাবলু। মা মীর মেরী। বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানাধীন গয়হাটা গ্রামে। অনেক আগেই তাঁরা কানাডায় চলে যান। বসবাস শুরু করে টরন্টোতে। জেরিনরা ২ বোন এক ভাই। সবার জন্ম হয় কানাডায়। জেরিনের জন্ম হয় খুব সম্ভবত ১৯৯৪ সালে। জেরিন কানাডার টরন্টোর ক্রিসেন্ট স্কুলে পড়াশোনা করেছে। তার ইচ্ছে ডাক্তার হওয়া। কিন্তু কানাডার কোন মেডিক্যাল কলেজে চান্স পায়নি। জেরিনকে অন্যান্য বিষয়ে পড়াশোনা করার জন্য পরিবার ও আত্মীয়স্বজনদের তরফ থেকে বহুভাবে বোঝানো হয়েছে। কিন্তু জেরিনের ইচ্ছে ডাক্তার হওয়া এবং মানুষের সেবা করা। শেষ পর্যন্ত জেরিনের ইচ্ছেতেই বাংলাদেশে রাজধানীর উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
জেরিনের ছোট একমাত্র ভাই মীর জাবির। সে কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছে। আর সবার ছোট বোন মীর জিনান। কানাডার একটি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াশোনা করে। জেরিন মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়ে কলেজের হোস্টেলেই বসবাস শুরু করে। জেরিন এমবিবিএস প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিল। সে সুযোগ পেলেই আত্মীয়স্বজনদের বাসায় যাতায়াত করত। সর্বশেষ ২০১২ সালের আগস্টে জেরিন ঢাকায় মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়ার উদ্দেশে বাংলাদেশে আসে। আর যায়নি।
প্রায় ৭ মাস আগে মহিউদ্দিন স্বরণ (২৫) নামে এক যুবকের সঙ্গে জেরিনের পরিচয় হয়। সেই সুবাদে দু’জনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। স্মরণের পিতার নাম কাজী জসিম উদ্দিন। তিনি বাংলাদেশ বিমানে কর্মরত। মা শাহানা বেগম। বাড়ি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানাধীন জানঘর গ্রামে। গ্রামে তাদের বাড়িটি কাজী বাড়ি হিসেবে পরিচিত। পরিচয়ের সূত্র ধরে জেরিন স্মরণদের রাজধানীর দক্ষিণখান থানাধীন গাওয়াইর এলাকার ৬৬৭ নম্বর বাড়িতে যাতায়াত করত। জেরিন ও স্মরণের সম্পর্কের বিষয়টি স্মরণের পিতা-মাতা জানতেন। জেরিনকে বিয়ে করতে পারলে স্মরণ কানাডার স্থায়ী বাসিন্দা হতে পারবে। এটি জেনেই জেরিনকে বিয়ে করার জন্য স্মরণ উঠেপড়ে লেগে যায়। নানা কারণে জেরিন অনেক সময় আপত্তি করলে জেরিনকে চাপে রাখত স্মরণ।
গত শনিবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে জেরিন ও স্মরণ বের হয়। তারা রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকার বনরূপা আবাসিক এলাকার রেললাইন দিয়ে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার পাঁচতারকা হোটেল রেডিসনের পেছনের রেললাইনে। তাদের মধ্যে নানা বিষয়াদি নিয়ে ঝগড়া হচ্ছিল। সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে ঢাকাগামী একটি রেলগাড়ি সেখান দিয়ে যাচ্ছিল।
খানিক পরেই চিৎকার-চেঁচামেচির আওয়াজ পাওয়া যায়। স্থানীয়রা সেখানে জড়ো হয়ে এক মেয়েকে আহত অবস্থায় রেললাইনের পাশে পড়ে থাকতে দেখে। পরে স্থানীয়দের সহায়তায় জেরিনকে গুরুতর আহত অবস্থায় স্মরণ প্রথমে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে। জেরিনের অবস্থার অবনতি হলে পরে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগে স্থানান্তর করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই রাত ৭টা ৫০ মিনিটে জেরিনের মৃত্যু হয়। ময়নাতদন্ত শেষে জেরিনের মরদেহ রাজধানীর পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়েছে।
এদিকে সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে মোবাইল ফোনে তাকে স্মরণ জানায়, জেরিন ট্রেনের ধাক্কায় আহত হয়েছে। তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এমন খবর শুনে তিনিসহ জেরিনের আরও দুই আত্মীয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছুটে যান। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে জেরিনের ট্রেনের সঙ্গে ধাক্কা লাগার বিষয়ে স্মরণ অসংলগ্ন তথ্য দেয়। এ অবস্থায় বিষয়টি তারা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়িকে জানায়।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানায়, স্মরণ জেরিনের দুর্ঘটনা সম্পর্কে অসংলগ্ন তথ্য দিতে থাকে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে জেরিনের আত্মীয়স্বজন ডিএমসির পুলিশ ফাঁড়িতে অভিযোগ করেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে শাহবাগ থানাধীন বাবুপুরা পুলিশ ফাঁড়ির উপ-পরিদর্শক তাপস স্মরণকে আটক করে শাহবাগ থানায় পাঠায়।
জেরিনের খালু জনকণ্ঠকে আরও জানান, জেরিনের মৃত্যুর খবর তার পিতা-মাতাকে কানাডায় জানানো হয়। তার পিতা-মাতা বাংলাদেশস্থ কানাডীয় দূতাবাসকে জানায়। খবর পেয়ে বাংলাদেশস্থ কানাডীয় দূতাবাসের এক মহিলাসহ ৩ কর্মকর্তা জেরিনের মরদেহ দেখতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছুটে যান। কানাডা দূতাবাসের তরফ থেকে জেরিন হত্যা মামলাটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করতে এবং দোষীর উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে।
এদিকে জেরিনের মৃত্যুর ঘটনায় রবিবার রাত ১০টায় রাজধানীর কমলাপুর জিআরপি থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহতের খালু হারুন অর রশীদ। মামলায় স্মরণ ছাড়াও তার পিতা-মাতাকে আসামি করা হয়। মামলার বাদীর দাবি, জেরিন ও স্মরণের সম্পর্কের বিষয়টি স্মরণের পিতা-মাতা জানতেন। এতে একটি বিষয় স্পষ্ট, জেরিনের মৃত্যুর পেছনে স্মরণের পিতা-মাতার হাত রয়েছে। এজন্য স্মরণসহ তার পিতা-মাতাকে জেরিন হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে। রবিবার রাতে স্মরণকে শাহবাগ থানা থেকে কমলাপুর জিআরপি থানায় হস্তান্তর করা হয়।
মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা কমলাপুর জিআরপি থানার উপ-পরিদর্শক আলমগীর হোসেন মজুমদার জনকণ্ঠকে জানান, লন্ডন থেকে এমবিএ শেষ করে বাংলাদেশে এসেছে আসামি কাজী মহিউদ্দিন স্মরণ। স্মরণের এক ভাই ও এক বোন আছে। স্মরণ সবার বড়। সে রাজধানীর উত্তরায় কাজী আইটি ফার্ম নামে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক একটি নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে বসে। ব্যবসা ও দূর সম্পর্কের এক পারিবারিক আত্মীয়তার সূত্র ধরে জেরিনের সঙ্গে প্রায় ৭ মাস আগে পরিচয় হয় স্মরণের। সম্পর্কের সূত্র ধরেই প্রেম। স্মরণ খুব সম্ভবত ইয়াবা ও হেরোইনের মতো মারাত্মক মাদকে আসক্ত। তার গা দিয়ে দুর্গন্ধ বের হয়। এত উচ্চশিক্ষিত ছেলে অথচ তার গায়ের পোশাক দেখেই বোঝা যায় স্মরণ মাদকাসক্ত। স্মরণ লন্ডন থেকে এমবিএ শেষ করার দাবি করলেও খুব সম্ভবত মাদকাসক্ত থাকায় লন্ডন থেকে তাকে বাংলাদেশে চলে আসতে হয়েছে। মাদক নিয়ে জেরিনের সঙ্গে স্মরণের প্রায়ই ঝগড়া হতো। ঘটনার দিন তারা রেডিসন হোটেলের পেছনে রেললাইন ধরে হাঁটছিল। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে তিনি আরও জানান, খুব সম্ভবত মাদকের বিষয়াদি নিয়ে দু’জনের মধ্যে তুমুল ঝগড়া হয়। ঝগড়ার এক পর্যায়ে স্মরণ উত্তেজিত হয়ে জেরিনকে ট্রেনের নিচে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করে। আর তাতেই ঘটে এমন দুর্ঘটনা। মামলার প্রধান আসামি কাজী মহিউদ্দিন স্মরণকে সোমবার দুপুরে ৫ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে সোপর্দ করা হয়। আদালত শুনানি শেষে স্মরণকে ৩ দিনের জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেয়। কমলাপুর জিআরপি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, পুরো বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। জেরিন মৃত্যুর পেছনে আরও কোন কারণ আছে কি-না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.