টাঙ্গাইলে দুর্বৃত্তের গুলিতে আওয়ামী লীগ নেতা নিহত- প্রতিবাদ বিক্ষোভ, চার ঘণ্টা সড়ক অবরোধ ॥ আজ শহরে হরতাল

 টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদকে (৬০) গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে শহরের কলেজ পাড়া মহেষখোলায় নিজ বাসার কাছে অজ্ঞাত দুষ্কৃতকারীরা তাকে গুলি করে হত্যা করে ফেলে রাখে।
এদিকে হত্যাকা-ের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা শনিবার সকালে শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে। তারা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবি জানায়। একই দাবিতে জেলা আওয়ামী লীগ রবিবার শহরে আধাবেলা হরতালের ডাক দিয়েছে। তবে বঙ্গবন্ধু সেতু-ঢাকা মহাসড়ক হরতালের আওতামুক্ত থাকবে বলে জানান জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নাজমুল হুদা নবীন।
এ হত্যার প্রতিবাদে শনিবার বেলা ১২টার দিকে করটিয়া সাদত কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের করাতিপাড়ায় অবরোধ করে। বিক্ষুব্ধ কর্মী সমর্থকরা বেশকয়েকটি যানবাহন ভাংচুর করে এবং মহাসড়কের ওপর টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এ সময় মহাসড়কের উভয় পাশে প্রায় ৪ ঘণ্টা যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায় এবং দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এছাড়া বিভিন্ন উপজেলায় বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে। বাসাইল উপজেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। শনিবার দুপুর ৩টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত টাঙ্গাইল বাস ও মিনিবাস মালিক সমিতিভুক্ত সকল যানবাহন বন্ধ থাকে। এদিকে হত্যাকা-ের বিষয়ে পুলিশ এখনও কোনো ক্লু বের করতে পারেনি। তবে ঘটনাস্থল থেকে গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়েছে। হত্যাকা-ের বিষয়ে প্রথমে পরিবারের সঙ্গে কথা বলে ঘটনার তদন্ত সঠিকভাবে করা হবে বলে জানিয়েছেন টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর।
জানা গেছে, শুক্রবার রাত সোয়া ১১টার দিকে ফারুক আহমেদ জেলা আওয়ামী লীগ অফিস থেকে বের হয়ে রিকশা নিয়ে বাড়ি ফিরফিলেন। বাসায় ফেরার আগে তিনি তাঁর স্ত্রীকে ফোন করে বলেন গেটের সামনে এসে দাঁড়াতে। এর পনের মিনিট পর মহেষখোলায় অবস্থিত নিজ বাস ভবনের প্রায় দেড়শ’ গজ দূরে রিকশা নিয়ে আসলে দুর্বৃত্তরা তাঁর পিঠে গুলি করে। এতে সে রিকশা থেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পর ফারুক আহমেদকে রাস্তার পাশে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখেন টাঙ্গাইল পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শফিকুল হক শামীম। এ সময় শামীমের ডাকচিৎকারে ফারুক আহমদের পরিবারের লোকজন ও আশপাশের লোকজন ছুটে আসে। দ্রুত টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হলে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহত আওয়ামী লীগ নেতার স্ত্রী নাহার আহমেদ অভিযোগ করেন, তাঁর স্বামীকে দলীয় লোকজনই হত্যা করেছে। হাসপাতালে চিৎকার করে স্বামী হত্যার বিচার দাবি করেন তিনি।
দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত ফারুক আহমদ ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীর একজন অন্যতম শীর্ষ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা প্রতিরোধ যুদ্ধে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকায় পায়ে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। তাঁর বাড়ি সিলেটের জকিগঞ্জে। পিতার চাকরির সুবাদে স্বাধীনতার আগে টাঙ্গাইলে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন পরিবারের সঙ্গে। এ কারণে টাঙ্গাইলেই তাঁর রাজনীতির উথান ঘটে। দলীয় যে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়ন তাঁর মতামতের ভিত্তিতেই পরিচালিত হয়ে আসছিল দীর্ঘদিন ধরে। আর এসব কারণে তিনি দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দলের শিকার হতে পারেন বলে মনে করছেন অনেকে। তবে বিষয়টি অস্বীকার করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফজলুর রহমান খান ফারুক। তিনি বলেন, এ হত্যাকা- শত্রুতামূলক না রাজনৈতিক তা তদন্তের আগে বলা যাচ্ছে না। টাঙ্গাইলের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এখনও এমন কোন অবস্থার সৃষ্টি হয়নি যে, এরকম একটি হত্যাকা- ঘটতে পারে। জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আশরাফুজ্জামান স্মৃতি বলেন, দলের ভেতর কোন কোন্দল ছিল না। জেলা আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে তিনি বিভিন্ন সময় অসঙ্গতির কথা তুলে ধরতেন। এটাই তাঁর কাল হয়ে থাকতে পারে। সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস-চেয়ারম্যান ফারুক হোসেন মানিক বলেন, আওয়ামী লীগের অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করতেই তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।
হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে ঘাটাইলের এমপি আমানুর রহমান খান রানা, জেলা প্রশাসক আনিছুর রহমান মিঞা, পুলিশ সুপার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের প্রশাসক ফজলুর রহমান ফারুকসহ সহ প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তারা হাসপাতালে ছুটে যান।
শনিবার বেলা ৩টায় নিহতের লাশ সর্বস্তরের শ্রদ্ধার জন্যে শহীদ মিনারে রাখা হয়। আসরের নামাজের পর বিন্দুবাসিনী সরকারী বালক উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জানাজা শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। জানাজায় খাদ্যমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জার, সংসদ সদস্য খন্দকার আব্দুল বাতেন, কৃষিবিদ শওকত মোমেন শাজাহান, একাব্বর হোসেন, আমানুর রহমান খান রানা, জেলা প্রশাসক আনিছুর রহমান মিঞা, পুলিশ সুপার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর, অতিরিক্ত সচিব মোঃ হুমায়ুন খালিদ, সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ লেবু, কালীহাতি উপজেলা চেয়ারম্যান সোহেল হাজারী, ধনবাড়ি পৌর মেয়র মঞ্জুরুল আলম তপন। উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র, কাউন্সিলর, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ সর্বস্তরের কয়েক হাজার লোক তার জানাজায় অংশ নেয়। এ সময় খাদ্যমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক যত দ্রুত সম্ভব খুনীদের শনাক্ত করে গ্রেফতার করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, এটি একটি রাজনৈতিক হত্যাকা-। আওয়ামী লীগ কর্মীদের নিশ্চিন্ন করতেই এ হত্যাকা- ঘটানো হয়েছে। খুনীদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে।

No comments

Powered by Blogger.