ভারত ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কাঠামো by বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

বাংলাদেশ এবং ভারতের সম্পর্ক যুক্ত ইতিহাস দ্বারা, ভাষা দ্বারা, সাহিত্য দ্বারা এবং ধর্ম দ্বারা। এই অর্থে বাংলাদেশ এবং ভারতের যুক্ত ইতিহাসের দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ এবং ভারতের সম্পর্ক দাবি করে বিভিন্ন সূক্ষ্মতা।
ভারতীয় ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামোর যে অংশ পশ্চিমবঙ্গ তার সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাস, ভাষা এবং সাহিত্যের যুক্ততা আছে। বাঙালী সংস্কৃতি সীমানত্মের দুই পাড়ে বিকাশ লাভ করেছে; এই বিকাশের একদিকে আছে ভারতীয় ফেডারেল রাষ্ট্রের কাঠামো, অন্যদিকে কাছে সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইউনিটারি কাঠামো। ইসলাম ধর্মের যে দিকটি বাংলাভাষার ওপর নির্ভর করে বিকাশ লাভ করেছে, সেই বিকাশ ইসলাম ধর্মের যে-দিকটি ফাসর্ী এবং উদর্ুর ওপর নির্ভরশীল তার চেয়ে ভিন্ন। আবার হিন্দু ধর্মের যে দিকটি বাংলাভাষার ওপর নির্ভর করে বিকাশ লাভ করেছে, সেই বিকাশ হিন্দু ধর্মের যে-দিকটি সংস্কৃত এবং হিন্দীর ওপর নির্ভরশীল, তার চেয়ে স্বতন্ত্র। রাজনীতির দিক থেকে ফেডারেল ভারতীয় রাষ্ট্রের রাজনীতি সেকু্যলার হওয়া সত্ত্বেও, ধর্মজ সঙ্কীর্ণতাবাদের উপস্থিতি নগণ্য নয়; আবার রাজনীতির দিক থেকে ইউনিটারি বাংলাদেশের রাজনীতি সেকু্যলার হওয়া সত্ত্বেও, ধর্মজ সঙ্কীর্ণতাবাদের উপস্থিতি ফেলনা নয়। অর্থনীতির দিক থেকে দুই রাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক বন্ধন এখনও অনেকটা বাসত্মব ও স্বপ্নের মেলবন্ধনে তৈরি হয়ে আছে।
বহু সাংস্কৃতিক ইতিহাসের কাছে আমাদের কমিটমেন্ট। এই কমিটমেন্ট প্রকাশিত আঞ্চলিক সৌভ্রাতৃত্ববোধ, এই কাজে জাতিক ঐক্য এবং সোশ্যাল জাস্টিস নির্মাণের জন্য। এরই মধ্যে দিয়ে তৈরি হয় সেকু্যলারিজম। এটা তৈরি হয়, বেড়ে ওঠে জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে। ভারতে এবং বাংলাদেশে তাই ঘটছে। তত্ত্বের ৰেত্রে যতটা নয়, জীবনযাপনের ৰেত্রে : ভারতীয় ফেডারেল রাষ্ট্রের সমসত্ম অংশের মূলে কিছু নির্দিষ্ট অংশে সেকু্যলারিজমের বিভা ফুটে উঠেছে। এটা ইউনিটারি বাংলাদেশের জন্য সত্য। গোঁড়ামির বদলে সহিষ্ণুতা, পরস্পরকে দূরে ঠেলার বদলে পরস্পরকে কাছে টানার প্রবণতা এক ধরনের সেকু্যলারিজম তৈরি করে চলেছে। গোঁড়ামি অবলম্বন করে রচিত হয় না।
গোঁড়ামির সঙ্গে স্বাধীনতার লড়াই কি এক করা যায়? যায় না। সেই ভিত থেকে গান্ধীজী ভারতের কৃষকদের দেখেছেন এবং বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের কৃষকদের দেখেছেন। কৃষক ঐতিহ্য এবং স্বাধীনতার তত্ত্বের মধ্যে যে আপেৰিক সমানত্মরালতা আছে, এই সমানত্মরালতার মধ্যে স্বাধীনতার এই দুই লড়াকু নেতা এবং তাত্তি্বক নেতা গ্রামীণ পৃথিবীকে দেখেছেন। গ্রামীণ পৃথিবী তাঁদের দু'জনের কাছে এক অবারিত দিগনত্ম, এক ভিন্ন মূল্যবোধ, এক ধরনের পরিস্থিতি যেখানে অনুপস্থিত শহুরে জীবন, শিল্পকারখানা।
গান্ধীজী এবং বঙ্গবন্ধুর কাছে গ্রামাঞ্চল হচ্ছে কৃষক প্র্যাকটিস, যে প্র্যাকটিস ইনডাস্ট্র্রিয়াল প্রলেটারিয়েটদের থেকে ভিন্ন। এখান থেকে তাঁরা দু'জন এক ধরনের প্র্যাকটিস তৈরি করেছেন, যেখান থেকে তাঁরা দু'জন তাঁদের বর্ণিত স্বাধীনতার লড়াইয়ের শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গি প্রণয়ন করেছেন। সেজন্য তাঁরা দু'জনই স্বাধীনতার লড়াই করেছেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন কৃষক পরিবেশের ভেতর থেকে। কৃষকরা এভাবে স্বাধীনতার ঐতিহাসিক পরিসরে এসেছে, যে পরিসরের বাসত্মবতা হচ্ছে গোঁড়ামিমুক্ত জীবনযাপন, হিন্দু-মুসলমান কৃষক হচ্ছে এক ধরনের কনোসাল ফোর্স উদ্ভিদ্যমান বুর্জোয়া সমাজের মধ্যে। উদ্ভিদ্যমান বুর্জোয়া সমাজের মধ্যে একটি শ্রেণীহীন সমাজের কথা ভেবেছেন তাঁরা দু'জন, আর শ্রেণীহীন সমাজের মূলশক্তি হচ্ছে ভারতের এবং বাংলাদেশের কৃষক।
গান্ধীজী এবং বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রের কাঠামো নিয়ে ভাবেননি, তাঁরা ভেবেছেন রাজনীতির চরিত্র নিয়ে। রাজনীতির চরিত্র তাঁদের কাছে পস্নুরালিস্ট, সেজন্য তাঁরা দু'জনই ভেবেছেন যে তত্ত্ব সঠিক/ সত্য যখন সে তত্ত্ব প্র্যাকটিস কতর্ৃক নিমর্ীত হয়। সে-কারণেই তাঁরা দু'জন গান্ধীজী এবং বঙ্গবন্ধু কৃষকদের জানের জান, প্রিয় ছিলেন। তাঁরা পাশ্চাত্যের আন্দোলনের মধ্যে বেড়ে ওঠেননি। তাঁরা বেড়ে উঠেছেন ভারতীয় কৃষক এবং বাঙালী কৃষক আন্দোলনের ঐতিহ্যে।
গান্ধীজীর কংগ্রেস এবং বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ আমলাতন্ত্রকে ভয় পেত। মবিলাইজেশন আন্দোলনের মধ্যে তরঙ্গের পর তরঙ্গ যদি তৈরি করে, তাহলে পার্টি বু্যরোক্রেসির নিয়ন্ত্রণ ঢিলা হতে থাকে। গান্ধীজী অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে কৃষকদের ভূমিকা দেখে এই সিদ্ধানত্মে পৌঁছেছিলেন যে, ব্রিটিশ শাসনকে কুপোকাত করে দেবে কৃষক জনসমষ্টি, কংগ্রেসীর আমলাতন্ত্র নয়। বঙ্গবন্ধুও অনুরূপ সিদ্ধানত্মে পেঁৗছেছিলেন, ৬৯-এ কৃষক জনসমষ্টির লড়াকু ভূমিকা দেখে। ঢাকার ওপর কৃষক জনসমষ্টি নির্ভরশীল নয়, নিজেরাই সিদ্ধানত্ম গ্রহণ করেছে তারা। অসহযোগ আন্দোলনের সময় একই ভূমিকা দেখেছিলেন তিনি। গান্ধীজী এবং জনসাধারণ, বঙ্গবন্ধু এবং জনসাধারণের মধ্যকার সম্পর্ক এবং সূত্রের ভিত্তি হচ্ছে নেতৃত্বের সঙ্গে জনসাধারণের সম্পর্ক : শ্রেণীর সঙ্গে নেতৃত্বের সম্পর্ক নয়। ঐতিহাসিক পরিস্থিতি, দু'ৰেত্রে, জাতীয় লড়াই এবং কৃষি লড়াইকে একটি অভিনব আন্দোলনে বদলে দিয়েছে, যে আন্দোলনের লৰ্য সাধারণ মানুষের ভাত-কাপড় পাইয়ে দেয়া।
সেজন্য তাঁরা দু'জনই, রাষ্ট্রের কাঠামো নিয়ে চিনত্মিত ছিলেন না। সাধারণ মানুষের শক্তি মবিলাইজ করে ভারত এবং বাংলাদেশ পরিউন্নত হতে পারে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে ভাত-কাপড় পাইয়ে দেবার ব্যবস্থা। যে ব্যবস্থা ভাত-কাপড় পাইয়ে দিতে পারবে, সে ব্যবস্থার দিকে কৃষক জনসমষ্টি ঝুঁকে পড়বে। গণতন্ত্র তাই ভাত-কাপড় পাইয়ে দেবার ব্যবস্থা, বু্যরোক্রেটিক পাওয়ার তৈরির ৰেত্র নয়। যদি পার্টি কিংবা সরকার বু্যরোক্রেটিক পাওয়ার তৈরির ৰেত্র হয় (যা-কিনা ভারত এবং বাংলাদেশের অধিকাংশ পার্টি কিংবা সরকারের চরিত্র) সেখানে রাষ্ট্র, পার্টি, সরকারের বুর্জোয়া সত্মরবিন্যাস দীর্ঘায়িত হতে বাধ্য। গান্ধীজী এবং বঙ্গবন্ধু দু'জনই এই অবস্থার সমালোচক ছিলেন, দু'জনই এই অবস্থাকে ভয় পেতেন। দুই রাষ্ট্রেই সেজন্য লড়াইটা এখন পস্নুরালিস্ট সমাজ গঠনের।

No comments

Powered by Blogger.