কাজলকে বাঁচাতে একজোট- প্রশাসন ও দলীয় নেতারা by এস এম আজাদ ও তোফাজ্জাল হোসেন রুবেল

গাজীপুরের কাপাসিয়ার সংসদ সদস্যের ঘনিষ্ঠ ও এপিএস পরিচয়দানকারী সাইফুল হাকিম মোল্লা ওরফে কাজল মোল্লার অপকর্ম ঢাকতে মাঠে নেমেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। আর তাঁদের সহায়তা দিচ্ছে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন।
কাজলের বাসার কিশোরী গৃহকর্মীকে ধর্ষণ ও তার ওপর শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর এলাকায় যখন তুমুল আলোড়ন, তখন প্রশাসন (শুক্রবার পর্যন্ত) এ ব্যাপারে কিছুই জানে না বলে জানিয়েছে। অপরাধী গ্রেপ্তার নেই, মেয়েটির সুরক্ষা নেই। অথচ ঘৃণিত এ ঘটনার সংবাদ প্রকাশ করায় কালের কণ্ঠের বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি গ্রহণ করেছে কাপাসিয়া থানার পুলিশ। আর ঘটনা যখন জানাজানি হয়ে গেছে সারা দেশে, তখন অভিযুক্তকে বাঁচাতে নিগৃহীত মেয়েটির সাজানো বক্তব্য গ্রহণের নাটক মঞ্চায়ন করেছে প্রশাসন। এসব ঘটনার সূত্র ধরে কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা গেছে, কাজল মোল্লাকে রক্ষায় পুলিশ আর প্রশাসনের আশীর্বাদ নিয়ে মাঠে নেমেছে তিন সদস্যের 'ধামাচাপা সিন্ডিকেট'। সিন্ডিকেট সদস্যরা হলেন জেলা যুবলীগের সদস্য আসাদুজ্জামান আসাদ, কাপাসিয়া উপজেলা যুব মহিলা লীগের আহ্বায়ক ও সদর ইউনিয়নের সংরক্ষিত ওয়ার্ডের মেম্বার কানিজ ফাতেমা রুহিতা ও কাপাসিয়া ইউনিয়নের বড়টেক গ্রামের ফজলুল হক ওরফে ফজলু। ধর্ষিতার পরিবারকে হুমকি, মেয়েটিকে তুলে নেওয়া, মিথ্যা প্রচার, বাড়িতে পাহারা বসানোসহ নানা অপকর্মের মাধ্যমে তাঁরা প্রমাণের চেষ্টা করছেন কাজল নিরপরাধ। অনুসন্ধানকালে স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, কাজল ও তাঁকে সহায়তাকারী চক্রের বিরুদ্ধে এলাকায় রয়েছে অনেক অভিযোগ। এর আগে আরো দুই গৃহকর্মীর ওপর নির্যাতন চালানোর অভিযোগ আছে কাজলের বিরুদ্ধে।
ধামাচাপার যত অপকৌশল : গত শুক্রবারও নির্যাতিত কিশোরীকে তুলে নিয়ে যান মেম্বার রুহিতা। গতকাল শনিবার দুপুর ১২টার দিকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলাউদ্দিন আলী, কাপাসিয়া থানার ওসি দেলোয়ার হোসেন, ওবায়েদ মেম্বারসহ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা আসেন ওই কিশোরীর বাড়িতে। ঠিক ওই সময় মেম্বার ও যুব মহিলা লীগ নেতা রুহিতা মোটরসাইকেলে করে নির্যাতিতাকে হাজির করেন সেখানে। তখন কিশোরীর মা-বাবা বাড়িতে ছিলেন না। পরিবারের অন্য সবার কাছ থেকে আলাদা করে কৌশলে মেয়েটির সাজানো জবানবন্দি নেয় পুলিশ। তাঁরা চলে যাওয়ার পর মেয়েটি অভয় পেয়ে সাংবাদিকদের কাছে তাকে ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা বর্ণনা করে কান্না জড়ানো কণ্ঠে। স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানান, ধর্ষণের আলামত মুছে ফেলতে মেয়েটিকে তুলে নিয়ে গিয়ে তার ডিএনসি করানো হয়েছে বলে ধারণা তাঁদের। তবে এ ব্যাপারে কিশোরী মুখ খোলেনি। সাংবাদিকদের সঙ্গে সে যখন কথা বলছিল, তখন দুই ব্যক্তি আসেন সেখানে। তাঁদের দেখেই ঘাবড়ে যান সোবহান ও তাঁর বোন। কথা বলে জানা গেল, ওই দুই যুবকের মধ্যে একজনের নাম রাসেল। তিনি কাপাসিয়ার ২ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সম্পাদক। রাসেলের দাবি, তিনি নির্যাতিত কিশোরীকে দেখতে এসেছেন। তবে কালের কণ্ঠের প্রতিবেদকদের ওই বাড়িতে অবস্থান করার পুরো দুই ঘণ্টা সময় সেখানেই ছিলেন তিনি। বিকেলে আবার তিনি ওই বাড়িতে যান। প্রতিবেশীরা জানান, রাসেলের মতো কয়েকজন প্রতিদিনই পাহারা দিচ্ছেন নির্যাতিত কিশোরীর বাড়িটি। তাঁদের ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পায় না ভুক্তভোগীরা।
ধর্ষিতার বাবা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বৃহস্পতিবার বিকেলে ভয়ভীতি দেখিয়ে যুব মহিলা লীগের নেত্রী কানিজ ফাতেমা রুহিতা, যুবলীগ নেতা আসাদুজ্জামান আসাদ ও প্রতিবেশী ফজলুল কাপাসিয়ায় গিয়ে সাংবাদিকদের সামনে আমাকে মিথ্যা বলতে বাধ্য করেন। আমার মেয়ে লেখাপড়া জানে না। পাশবিক ও শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি লিখে আসাদ ও রুহিতা কাগজে মেয়ের স্বাক্ষর নেন। পরে শুনেছি, একই কথা বলে তাঁরা থানায় আমার মেয়ের পক্ষ হয়ে সাধারণ ডায়েরি করেন। শুক্রবার ভোরে ওই তিনজন নিরাপত্তার কথা বলে মেয়েকে তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য আবার আমার বাড়িতে আসেন। আমি আপত্তি তোলায় তাঁরা জানান, বাড়িতে থাকলে সাংবাদিকরা নাকি আমার মেয়েকে মেরে ফেলবেন। ভয় পেয়ে আমি তাকে যেতে দিই। তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তা তাঁরা বলে যাননি।' ধর্ষিতার বাবা আরো জানান, তাঁকে দেওয়া টাকা ফেরত নিতে হুমকি দিচ্ছেন কাজলের সহযোগীরা। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বললে মেরে ফেলার হুমকিও দেন তাঁরা।
স্থানীয় প্রতিবেশী দুই নারী পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রায় দুই মাস মেয়েটির মাসিক বন্ধ ছিল। এ কারণে বাড়িতে ফেরার পর চিন্তায় ছিল সে। নির্যাতনের কথা জানানোর পর প্রতিবেশী এক নারী তাকে পরীক্ষার জন্য নিয়ে যান। সেখানে দুই দাগ এসেছে বলে জানান চিকিৎসক। এ কারণে তাঁরা ধারণা করছেন, মেয়েটি গর্ভবতী হয়েছিল এবং তুলে নিয়ে গিয়ে তার গর্ভপাত ঘটানো হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে মেয়েটি গতকাল পর্যন্ত কালের কণ্ঠকে কিছু জানায়নি।
স্বজনরা জানায়, উদ্ধারের পরদিন নির্যাতিত কিশোরীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান তার বাবা। ওই দিন বিকেল ৪টার দিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে হাজির হন আসাদুজ্জামান আসাদ। হাসপাতালে দেড় হাজার টাকা দিয়ে ছাড়পত্র নেন তিনি। কিশোরীর বাবার হাতে এক হাজার টাকা গুঁজে দিয়ে জোর করে তাঁদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে বাসায় গিয়ে আরো ১০ হাজার টাকা দেন আসাদ। পরদিন এক প্রতিবেশী নারী কিশোরীকে নিয়ে স্থানীয় ব্র্যাক স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে গিয়ে পরীক্ষা করান।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য : কাপাসিয়া থানার ওসি দেলোয়ার হোসেন কয়েকবার ঘটনাস্থলে এসে অভিযুক্ত কাজলের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। স্থানীয় লোকজন ও প্রত্যক্ষদর্শীরা মেয়েটির শারীরিক আঘাতের চিহ্ন ও অসুস্থতা দেখে আঁতকে উঠলেও পুলিশ বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে। গতকাল ওসির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'মেয়েটি আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ করেনি। তাই ব্যবস্থা নিতে পারছি না।' হয়তো ভয়ে পুলিশের কাছে মুখ খুলছে না মেয়েটি, কিন্তু সাংবাদিকদের তো সে সব বলেছে- এ তথ্য জানালে ওসি ওই প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলেন, 'তার নিরাপত্তার ব্যাপারটি আমরা দেখব।'
এ বিষয়ে জানতে কাপাসিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলাউদ্দিনের মোবাইলে ফোন করা হলে সাংবাদিক পরিচয় জেনেই লাইন কেটে দেন তিনি। মোবাইলে খুদে বার্তা পাঠিয়ে তাঁর বক্তব্য জানতে চাইলেও তিনি জবাব দেননি।
গাজীপুর বহুমুখী দুস্থ নারী কল্যাণ সমিতির সভানেত্রী তাসলিমা নয়ন বলেন, 'এ জঘন্য ঘটনার নিন্দা জানাচ্ছি। দোষীদের শাস্তি এবং মেয়েটির সুচিকিৎসার দাবিতে আগামীকাল (আজ) আমরা মানববন্ধন করব।'
সার্বিক ঘটনার ব্যাপারে গাজীপুরের পুলিশ সুপার আবদুল বাতেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'আমি বিষয়টি জানি না। জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।'
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনার পর পুলিশের দায়িত্ব মামলা রুজু করে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এ বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধিতে সুস্পষ্ট বর্ণনা আছে।'
তাঁদের কীর্তিকলাপ : অনুসন্ধানে জানা গেছে, কাজল মোল্লার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনসহ চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা আত্মসাতের অনেক অভিযোগ আছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কাপাসিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা জানান, সোহেল তাজ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর পুলিশের এসআই পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে কাজল কাপাসিয়ার হাইলজোড় গ্রামের আলফাজ মেম্বারের ছেলে আতিকুল ইসলামের কাছ থেকে তিন লাখ টাকা নেন। তাঁর অপকীর্তির কথা জানতে পেরে সোহেল পরে আর তাঁকে পাত্তা দেননি। ফলে আতিকুলের চাকরিও হয়নি, টাকাও ফেরত পাননি। সোহেল তাজের পদত্যাগের পর শূন্য আসনের উপনির্বাচনে সিমিন হোসেন রিমি প্রার্থী হলে আতিকুল টাকা ফেরত পেতে রিমির কাছে অভিযোগ করেন। তারপর কয়েক কিস্তিতে কাজল দুই লাখ টাকা ফেরত দিলেও দেই-দিচ্ছি করে বাকি টাকা আর দেননি। কাপাসিয়া উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আফসার উদ্দিন আহমেদের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট অ্যাডভোকেট সারোয়ারী কায়নাত জানান, প্রার্থী হওয়ার কারণে কাজল নির্বাচন থেকে সরে যেতে আফসার উদ্দিন আহমেদকে একাধিকবার হুমকি দেন। এ ঘটনায় আফসার উদ্দিন আহমেদ রিটার্নিং অফিসার ও নির্বাচন কমিশনে কাজল মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন। স্থানীয় লোকজন জানায়, কাজলের বিরুদ্ধে বারিষাব ইউনিয়নের দত্তরা এবং রায়েদ মধ্যপাড়া গ্রামের দুই যুবতীকে বাসায় কাজের জন্য নিয়ে তাদের ওপর নির্যাতন চালানোর অভিযোগ রয়েছে।
কাপাসিয়া থানা যুব মহিলা লীগের সভাপতি কানিজ ফাতেমা রুহিতা সরকারদলীয় নেত্রী হওয়ায় তাঁর প্রভাবও রয়েছে যথেষ্ট। নিজে একটি ইয়ামাহা ১০০ সিসি মোটরসাইকেল চালিয়ে এলাকায় দাপিয়ে বেড়ান। একটি প্রাইভেট কারও আছে তাঁর। গতকাল তিনি পুলিশকে নিজের মোটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে মেয়েটির বাড়িতে নিয়ে আসেন। উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সারফুদ্দিন মোড়লের ছোট বোন রুহিতা কিছুদিন আগে কাপাসিয়া পাবুর মুচিপাড়া এলাকায় বাংলা মদের স্পট থেকে চাঁদা না পেয়ে দুজনকে পুলিশে দেন। ওই মাদক স্পট থেকে নিয়মিত চাঁদাবাজি করেন তিনি। এ ছাড়া কর্মসৃজন প্রকল্পে সূর্যনারায়ণপুরে একটি কাজে অনিয়মের কারণে তাঁকে শোকজ করা হয়। কাপাসিয়া থানায় নিয়মিত দালালির অভিযোগও আছে তাঁর বিরুদ্ধে।
গতকাল রুহিতার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি ঘটনাস্থল থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে প্রতিবেদককে গিয়ে কথা বলতে বলেন। পাবুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে গিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, 'নিরাপত্তার জন্য মেয়েটি আমার বাড়িতে এসেছিল। মেয়েটি অনেকটা ঝামেলার। তাই সে এলাকার একটি গোষ্ঠীর কথামতো ধর্ষণ ও গর্ভপাতের কথা বলছে। কাজল ভাই থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী। তাই তাঁর বিরুদ্ধে নিজ দলের লোকজন ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে।' মেয়েটিকে বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে গর্ভপাত করিয়েছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে রুহিতা নামের চতুর প্রকৃতির এই নেত্রী হেসে বিষয়টি উড়িয়ে দেন।
এদিকে আসাদুজ্জামান আসাদ ১৯৯৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জেলা ছাত্রদল নেতা মনিরুজ্জামান হত্যা মামলার আসামি। বর্তমান সরকারের আমলে তিনি টেন্ডারবাজি এবং টিআর-কাবিখার চাল সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন। গত বছর জেলা পরিষদের কয়েকটি প্রকল্পের টেন্ডার শিডিউল ছিনিয়ে নেন তিনি। কাপাসিয়ার ত্রাস আসাদের আছে নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী। গতকাল বক্তব্য নেওয়ার জন্য তাঁর মোবাইল ফোনে অনেকবার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
অভিযুক্ত কাজল মোল্লা কালের কণ্ঠের সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেন, মেয়েটিকে কোনো নির্যাতন করা হয়নি। অপহরণের কথা অস্বীকার করে তিনি বলেন, 'ওকে কেউ তুলে নেয়নি।'
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানেন না!

No comments

Powered by Blogger.