প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠক- নারী নির্যাতন এখনই বন্ধ করতে হবে

আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় নারী নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় জবাবদিহি এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছারও অভাব রয়েছে। জাতীয় সংসদকেও এ বিষয়টিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে দেখা যাচ্ছে না।
গতকাল শনিবার ‘নারীর প্রতি সহিংসতা এখনই প্রতিরোধ করুন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে নারী ও মানবাধিকারকর্মীরা এ কথা বলেন। প্রথম আলো এ বৈঠকের আয়োজন করে। বৈঠকের আলোচকেরা বলেন, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকেই মূল দায়িত্ব পালন করতে হবে। জাতীয় সংসদের আগামী অধিবেশনেই যাতে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে ধিক্কার এবং প্রতিবাদ জানানো হয়, তারও দাবি তোলেন বক্তারা। আলোচকেরা জোর দিয়ে বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা আর চলতে দেওয়া যাবে না। নির্যাতন প্রতিরোধে সরকারের পাশাপাশি পাড়ায় পাড়ায় নারী নির্যাতনবিরোধী কমিটি গড়ে তুলতে হবে।
নারী নির্যাতনকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার জন্য আলোচকেরা স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন সুপারিশ করেন। রাজনৈতিক সদিচ্ছার পাশাপাশি নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বিভিন্ন আইনের বাস্তবায়ন এবং নারীদের প্রতি যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তা পাল্টানোর বিষয়টিতেও গুরুত্ব দেন তাঁরা। এ ছাড়া এ ধরনের আন্দোলনে পুরুষদের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি বলে আলোচকেরা উল্লেখ করেন।
কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে নারী নির্যাতনের মতো সামাজিক ব্যাধি প্রতিরোধে সরকার বা বিরোধী দল এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। কেন নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, কেন এ ধরনের ঘটনা কমানো যাচ্ছে না, তা নিয়ে গবেষণা করারও সুপারিশ করেন আলোচকেরা।
বৈঠকে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
বৈঠকের প্রধান অতিথি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, নারী নির্যাতনের ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কাছের কাউকে এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হতে দেখতে হবে কি না, তা নিয়ে ভয়ে থাকতে হয়। দীর্ঘদিনের আন্দোলন, সংগ্রাম, কার্যক্রম থাকার পরও প্রত্যাশা অনুযায়ী ফলাফল মিলছে না।
মেহের আফরোজ জানান, জাতীয় সংসদে সরকারি এবং বেসরকারি দলের নারী সাংসদদের নিয়ে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে একটি ককাস তৈরির প্রক্রিয়া চলছে। ককাস তৈরি হয়ে গেলে দলমত-নির্বিশেষে সবাই নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারবেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বলেন, নারী নির্যাতনকে সম্ভ্রমহানি হিসেবে দেখা হয়। এটা যে একটা অপরাধ, সে বোধটুকুও তৈরি হয়নি। সব সময় নারীদের সাবধান থাকতে বলা হয়। অপরাধীদের দিকে কখনো আঙুল তোলা হচ্ছে না। একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীও সহজে বলে দিচ্ছেন, ধর্ষণ একতরফা হয় না। পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা কতটা গভীরে গেলে এ ধরনের বক্তব্য দেওয়া যায়, তা সহজেই অনুমেয়। সুলতানা কামাল বলেন, দেশের অসংখ্য ভালো মানুষ চুপ থাকলে হবে না, নিজের ভেতরের মনুষ্যত্ব জাগিয়ে তুলতে হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘পুলিশ সপ্তাহ শুরু হচ্ছে। আমরা আশা করব এ সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেই আমাদের প্রধানমন্ত্রী নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা হতে দেওয়া যাবে না, সে ধরনের ঘোষণা দেবেন।’ ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব নারী নির্যাতনকে বাড়িয়ে তুলছে বলে তিনি অভিমত দেন।
জাতিসংঘ সিডও কমিটির সাবেক চেয়ারপারসন নারীনেত্রী সালমা খান বলেন, ‘সমাজে ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের ঘটনা নতুন নয়। তবে সমাজে একধরনের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে যা ভয়াবহ। জাতি, ইতিহাস এবং সমাজ রক্ষার জন্য “টার্নিং পয়েন্টে” পৌঁছে গেছি। ধর্ষণকারী জামিন নিয়ে বের হয়ে আবার ধর্ষণ ও হত্যার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে।’
সাংসদ আসাদুজ্জামান নূর নারী নির্যাতনের বিষয়টি জাতীয় সংসদে উত্থাপনের আশ্বাস দেন। তিনি বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর আইন থাকার পরও প্রয়োগ বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম বলেন, সতীত্ব রক্ষার দায়িত্ব নারীর, তা পুরুষের জন্য প্রযোজ্য নয়—এ কথা বলে নির্যাতনের শিকার নারীকেই অপরাধী বানানো হয়। নির্যাতনের পর মেয়েটি কী পোশাক পরল, কখন বাড়ি থেকে বের হলো ইত্যাদি প্রশ্ন সামনে আনা হয়। আয়শা খানম বলেন, নারীর নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে।
নারীনেত্রী এবং সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মালেকা বেগম পাড়ায় পাড়ায় নারী নির্যাতনবিরোধী কমিটি গড়ে তোলার কথা বলেন। পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধবিষয়ক আইন বাস্তবায়নের পাশাপাশি উত্তরাধিকার আইনে সম-অধিকারের বিষয়টি সম্পৃক্ত করা, অভিভাবকত্ব আইনসহ বিভিন্ন আইনে পরিবর্তন আনার সুপারিশ করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম নূর-উন নবী বলেন, নারী নির্যাতন প্রতিরোধের দায়িত্ব চাপাতে হবে পুরুষদের ঘাড়ে। কেননা, ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই নির্যাতনকারী পুরুষ। পুরুষকে এ বিষয়ে নাড়া দিতে না পারলে লাভ হবে না।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিভিন্ন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার মতের অমিল থাকতেই পারে। কিন্তু দুই নেত্রী নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে এক হয়ে একসঙ্গে জাতীয় সংসদে একটি বক্তব্য দিতে পারেন।
নারীপক্ষের সভানেত্রী ইউ এম হাবিবুন নেসা বলেন, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয় কাঠামোগত দুর্বলতার অবসান ঘটেনি। দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন হয়নি।
অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মনিরা রহমান বলেন, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে প্রথম আলোর ভূমিকার কথা উল্লেখ করে বলেন, নারায়ণগঞ্জের অ্যাসিডদগ্ধ হাসিনার আসামিদের পুলিশ তিন বছরেও গ্রেপ্তার করেনি। প্রথম আলোতে সংবাদ প্রকাশিত হলে সেই পুলিশই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আসামিদের গ্রেপ্তার করে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের প্রধান সামন্তলাল সেন বলেন, ইডেন মহিলা কলেজের অ্যাসিডদগ্ধ শিক্ষার্থীর মুখে যতই প্লাস্টিক সার্জারি করা হোক, আগের চেহারা আর কখনোই ফিরে পাবে না। অথচ আসামি এখনো গ্রেপ্তার হয়নি।
নাট্য ব্যক্তিত্ব সারা যাকের বলেন, নারীর দেহ ঢেকে রাখার বিষয়টি সামনে আনলে চলবে না। সহিংসতার দায় নারীর ওপর বর্তায়। পুরুষের ওপর তা বর্তানো উচিত। বিশ্বব্যাপী এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৩৫ শতাংশ পুরুষই বলছে, ধরা না পড়লে বা নাম প্রকাশ না হলে সে ধর্ষণ বা জোরপূর্বক সম্পর্ক করতে বেশি আগ্রহী।
নাট্য ব্যক্তিত্ব বিপাশা হায়াত বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা এমনকি ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলোও যে শুধু অপরিচিত সন্ত্রাসীরাই ঘটাচ্ছে তা নয়, এগুলো বেশির ভাগই ঘটাচ্ছেন স্বামী, প্রেমিক বা খুবই কাছের কেউ। তাই এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। অন্যদিকে নির্যাতনের প্রভাবে সেই পরিবারের শিশুরাও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
কিছু সুপারিশ: নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সালমা খান রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা বাড়ানোর সুপারিশ করেন। সুলতানা কামাল নারী নির্যাতন মামলায় যেসব অপরাধী জামিনে থেকে আবার অপরাধ করছে, তাদের জামিনদারদেরও শাস্তির আওতায় আনার সুপারিশ করেন।
আয়শা খানম নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত-ব্যবস্থা চালুর সুপারিশ করেন। পরিবারের ভেতরে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা বাড়ানোর সুপারিশ করেন এ কে এম নূর-উন নবী। সামন্তলাল সেন অ্যাসিড নিক্ষেপকারীর পাশাপাশি অ্যাসিড সরবরাহকারীকেও আইনের আওতায় আনার কথা বলেন।

No comments

Powered by Blogger.