ব্যয় বিশ্লেষণের নামে বাড়তি ভাড়ার বোঝা চাপানোর প্রক্রিয়া চলছে- সরকারের ঘোষণার আগেই বাস ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন মালিকেরা by আনোয়ার হোসেন

সরকার ঘোষণা দেওয়ার আগেই দূরপাল্লার পথে বাসের ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন মালিকেরা। কোম্পানি ও দূরত্বভেদে বাসের ভাড়া ৪০ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে তা আদায় করা হচ্ছে।
গত মঙ্গলবার যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে এক বৈঠকে নির্ধারণের আগে বাড়তি ভাড়া আদায় না করার আহ্বান জানিয়েছিলেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। মালিকেরাও মন্ত্রীকে কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু মালিকেরা কথা রাখেননি। আর সরকারও যাত্রী সাধারণের স্বার্থে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে কেবল মালিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছে।
মঙ্গলবারের বৈঠকে আজ রোববার নতুন ভাড়া হার ঠিক করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সে লক্ষ্যে আজ বেলা তিনটায় যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে বৈঠক বসছে। এর আগে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির পর প্রতি কিলোমিটারে বাসের ভাড়া ২৩ পয়সা বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছিলেন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটির প্রধান ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান। কিন্তু যোগাযোগমন্ত্রী ও সচিব—উভয়ই তা কমানোর লক্ষ্যে পুনর্বিবেচনার জন্য পাঠান।
অভিযোগ উঠেছে, ব্যয় বিশ্লেষণের নামে যাত্রীদের ওপর বাড়তি ভাড়ার বোঝা চাপানোর প্রক্রিয়া চলছে। কারণ, এর মধ্যে জ্বালানির বাইরের অন্য সব পরিচালন ব্যয়ও জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আর সরকারের ব্যয় বিশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় বাসমালিকদের বক্তব্যই প্রাধান্য পেয়ে আসছে।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক বিভাগের সচিব এম এ এন সিদ্দিক গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যয় পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই করেই আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’ ঘোষণার আগেই ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মালিকদের ধরব কেন, তাঁরা কথা দিয়ে কথা রাখেননি।’
বাসের ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিআরটিএ যে ব্যয় বিশ্লেষণ করে তাতে দেখা গেছে, জ্বালানির মূল্য এক টাকা বৃদ্ধি পেলে ভাড়া বৃদ্ধি পায় এক পয়সা। সে হিসাবে ডিজেলের মূল্য সাত টাকা বৃদ্ধির কারণে বাসভাড়া সাত পয়সা বৃদ্ধি পাওয়ার কথা।
বর্তমানে কিলোমিটারপ্রতি একজনের ভাড়া এক টাকা ৩৫ পয়সা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব ও ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটির মালিক প্রতিনিধি খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ দাবি করেন, প্রতিদিনই টায়ার-টিউবের দাম বাড়ছে। তাই জ্বালানির মূল্য ধরে হিসাব করলে বাসমালিকেরা পথে বসবেন।
বাড়তি ভাড়া আদায়: এসআর পরিবহনে এক সপ্তাহ আগেও ঢাকা-বগুড়া পথে ভাড়া নেওয়া হতো ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা। কিন্তু গতকাল কল্যাণপুর কাউন্টারে গিয়ে দেখা গেছে, এ পথের ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ৩৮০ টাকা। নওগাঁ পর্যন্ত আগে নেওয়া হতো ৩৫০ টাকা। গতকাল নেওয়া হয়েছে ৪০০ টাকা।
বগুড়ার যাত্রী আবদুল মান্নান বলেন, ‘ঢাকা থেকে বগুড়ার দূরত্ব ১৯১ কিলোমিটার। সে হিসাবে কিলোমিটারপ্রতি একেকজন যাত্রীর কাছ থেকে ২৬ থেকে ৩১ পয়সা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। অথচ সরকার ভাড়া বৃদ্ধি করেছে বলে শুনিনি।’
এসআর পরিবহনের একজন কর্মকর্তা দাবি করেন, বাড়তি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে না। আগে কম নিতেন। এখন সঠিক ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। এর আগের বার এ প্রক্রিয়ায় ভাড়া বাড়িয়ে এমন বক্তব্যই দিয়েছিলেন বাস মালিক সমিতি ও কাউন্টারগুলোয় কর্মরত তাঁদের কর্মকর্তারা।
কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার রেজাউল আলম বলেন, তিনি গত শুক্রবার রাতে ভেড়ামারা থেকে শ্যামলী পরিবহনে এসেছেন ৪২৫ টাকায়। আজ (গতকাল) ভেড়ামারা যাওয়ার টিকিট কেটেছেন ৪৫০ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে এ পথে ভাড়া ছিল ৪০০ টাকা।
গাবতলী বাস টার্মিনাল, কল্যাণপুর ও শ্যামলী বাসস্ট্যান্ড ঘুরে দেখা গেছে, এভাবে প্রায় সব পরিবহন কোম্পানিই নিজেদের মতো করে ভাড়া বৃদ্ধি করেছে।
এমনকি ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির পর সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাসচালিত (সিএনজি) বাসেও বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। কমলাপুর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পথে চলাচলকারী সোহাগ পরিবহনে এত দিন ১৫০ টাকা ভাড়া নেওয়া হতো। গত শুক্রবার থেকে ১৭০ টাকা আদায় করা হচ্ছে। এ পথে চলাচলকারী তিশা পরিবহনেরও ভাড়া বৃদ্ধির অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সোহাগ ও তিশা পরিবহনের চালক এবং কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের বহরের অনেক বাস সিএনজিতে চলে।
ব্যয় বিশ্লেষণে শুভঙ্করের ফাঁকি: গত বছর জানুয়ারি মাসে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির পর বাস পরিচালনায় ১৬ ধরনের ব্যয় ও ভাড়া নির্ধারণে ভূমিকা রাখে—এমন অন্তত ১২টি উপাদান বিশ্লেষণ করে ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে—বাসের ক্রয়মূল্য, ব্যাংকঋণের সুদ, কর-ভ্যাট, জ্বালানি খরচ, শ্রমিক-কর্মচারীর বেতন-ভাতা, বিমার প্রিমিয়াম, গ্যারেজ ভাড়া ও মালিকের ১০ শতাংশ মুনাফা।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, একটি বাসে যাত্রীবোঝাইয়ের হার কত এবং বাসটি দৈনিক কত কিলোমিটার পথ চলে—ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে তা বিবেচনায় আনা হয়।
গত মঙ্গল যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের করা ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটি কিলোমিটারপ্রতি ২৩ পয়সা বৃদ্ধির যে প্রস্তাব দেয়, তাতে ৫১ আসনের একটি বাস গড়ে ৩৭ জন যাত্রী নিয়ে চলাচল করে বলে উল্লেখ করা হয়। সরেজমিনে দেখা গেছে, অধিকাংশ বাসই পুরো আসন বোঝাই করে চলাচল করে। কমিটি যে ব্যয় বিশ্লেষণ করে, তাতে যাত্রীবোঝাইয়ের পরিমাণ দুজন বৃদ্ধি করলে (গড়ে ৩৯ জন) ভাড়া কমে যায় আট পয়সা, বাড়াতে হবে ১৫ পয়সা। আর যাত্রী পাঁচজন বেশি ধরলে ভাড়া অন্তত ১৮ পয়সা কমে যায়।
প্রতিদিন বাস ৩৫০ কিলোমিটার চলাচল করে বলে উল্লেখ করা হয়। বাসচালকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ঢাকা-সিলেট পথে ২৪ ঘণ্টায় ৫০০ এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে ৪০০ কিলোমিটার চলে প্রতিটি বাস। বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পর উত্তরবঙ্গেও গড়ে ৫০০ কিলোমিটার চলে। দৈনিক গড় চলাচল বেড়ে গেলে ভাড়াও কমে যায়। কিন্তু সেখানেও দেওয়া হচ্ছে ফাঁকি।
প্রতিটি বাসের ক্রয়মূল্য ৭৫ লাখ টাকা এবং এর জন্য ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের সুদ প্রায় ৩২ লাখ টাকা ধরে তা ভাড়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে একটি বাসের পেছনে বিনিয়োগ ধরা হয়েছে এক কোটি সাত লাখ ৪০ হাজার টাকা। একটি বাসের বয়সসীমা ধরা হয়েছে ১০ বছর। কিন্তু রাস্তায় বিশেষ করে মফস্বলে এর চেয়ে কম দামি এবং ২০ বছরের পুরোনো বাস চলে।
রাজধানীসহ সারা দেশের অধিকাংশ মালিক তাঁদের বাস সড়ক-মহাসড়কে রাখেন। অথচ বছরে গড়ে দুই লাখ টাকা গ্যারেজ ভাড়া দেখিয়ে তা যাত্রীদের কাছ থেকে তোলা হচ্ছে।
অভিযোগ আছে, একটি বাসে কত যাত্রী হয়, কত কিলোমিটার চলে, যে ব্যয় উল্লেখ করা হয় আসলে এর বাজারমূল্য কত, তা কখনোই কমিটি সরেজমিন যাচাই করে দেখে না। মালিকদের কথায় অঙ্ক বসিয়ে দেওয়া হয়।
এবারের ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটিতে সাতজন সরকারি কর্মকর্তা রয়েছেন। মালিক সমিতির নেতা আছেন চারজন। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) একজন সদস্য থাকলেও তাঁর জোরালো ভূমিকা রাখার সুযোগ হয় না।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী অভিযোগ করেন, ব্যয় বিশ্লেষণের মাধ্যমে যাত্রীদের নয়, বাসমালিকদের স্বার্থ রক্ষা করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় সরকার বাস্তবের চেয়ে বেশি ভাড়া নির্ধারণ করে। আর বাস্তবে ভাড়া আদায়ের বেলায় মালিকেরা আরেক দফা বাড়িয়ে নেন। কিন্তু সরকারিভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

No comments

Powered by Blogger.