সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-ঘরে-বাইরে আপদ by এম আবদুল হাফিজ

নিবিড় নিরাপত্তাবোধ নিয়ে নিজ বাসভূমে সহজাত মনস্তাত্তি্বক স্বস্তিতে বাস করার আনন্দ কবেই উবে গেছে এ দেশে গুম, নিখোঁজ বা অপহরণের উপসর্গের মধ্য দিয়ে। এই শব্দমালার সঙ্গে আমরা প্রথম পরিচিত হই পাকিস্তানের সন্ত্রাসবিরোধী ভূমিকায়।
সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফের বৈধতা অর্জনের অংশ হিসেবে তার গোয়েন্দারা সিআইএ এবং এফবিআইর চাহিদামতো সন্দেহভাজনদের তাদের হাতে তুলে দেওয়ায় সেখানে শুরু হয় নিখোঁজ, গুম ও অপহরণ প্রক্রিয়া। আমাদের দেশে বিগত জোট সরকারের আমলে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী বিএনপির উপদলীয় রাজনীতির শিকার হয়ে নিখোঁজ হন। এ সরকারের আমলের বহুল আলোচিত ইলিয়াস আলী তার ড্রাইভারসহ অপহৃত হওয়ায় ইলিয়াসপত্নী তাহসিনা রুশদির প্রধানমন্ত্রীর শরণাপন্ন হওয়ার মতো জামালউদ্দিনের স্বজনরাও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে ধরনা দিয়েছিলেন। অজ্ঞাত কারণে উভয় ক্ষেত্রেই তা কোনো সুফল বয়ে আনেনি।
দীর্ঘদিন পর চট্টগ্রামের পাহাড়ি জঙ্গলে জামালউদ্দিনের কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু ইলিয়াস আলীর ক্ষেত্রে একজন জলজ্যান্ত মানুষ সেই যে হাওয়া হয়ে গেলেন, অতঃপর কোথাও তার কোনো চিহ্নই আবিষ্কৃত হলো না। কোনো ক্লু বা চিহ্ন পাওয়া যায়নি বিএনপির ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলমের। তবে সর্বশেষ নিখোঁজ বিএনপিদলীয় রফিকুল মজুমদারের লাশ পাওয়া গেছে হাতকড়া পরা অবস্থায় ঢাকা থেকে বেশ দূরে।
ত্রাস সঞ্চারক এই নিখোঁজ, গুম বা অপহরণের ঘটনাগুলো শুধু এক করুণ একাকিত্বের মৃত্যুকেই স্মরণ করিয়ে দেয় না; সেগুলো রাজনৈতিক বিরোধিতায় লিপ্ত হওয়া থেকেও নিবৃত্ত রাখার হাতিয়ার। কেননা, রাজনীতি করা এক কথা এবং সেই প্রক্রিয়ায় একেবারেই হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে যে বিয়োগান্ত সুর ধ্বনিত হয়, যে অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে বা একটি চিরনির্বাসনের আবহ থাকে, সেটা অনেকেরই পছন্দ নয়। বরং মরতে হলে তাদের অধিক পছন্দের মৃত্যু নূর হোসেনের মৃত্যু। নগরীর জিরো পয়েন্টে হাজার মানুষের দৃষ্টিসীমায়।
মেরুদণ্ড শীতল করে দেওয়া এই উপসর্গগুলোর অন্তর্নিহিত বার্তা আরও ভয়াবহ। তা প্রতিনিয়ত আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে কোনো রাজনৈতিক প্রতিবাদে বা বিরোধিতায় প্রবৃত্ত না হতে। যতই তা কারও বিবেককে দংশন করুক বা অন্যায় মনে হোক। যতই পদ্মা সেতুসদৃশ দুর্নীতি হোক, ছাত্রলীগ তাদের বাণিজ্যের পসরা সাজিয়ে বসুক বা জনস্বার্থবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত হোক। সব প্রতিবাদ ও প্রতিরোধকে স্তব্ধ করে দেওয়াই এসব রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের লক্ষ্য। স্বভাবতই কিছু অকুতোভয় মানুষ ছাড়া এমন গুম-অপহরণের ঝুঁকি কেউ নিতে চাইবে না এবং এমন প্রতিবাদবিমুখতা হাসিল করাই কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য।
কর্তৃপক্ষ যে তাদের গেস্টাপো কর্মকাণ্ডে বেশ সাফল্য পেয়েছে, তার কিছু প্রতিফলন আছে সামাজিক চালচিত্রে। আজকের তরুণরা রাজনীতিবিমুখ। তাদের অধিক পছন্দ থার্টিফার্স্ট নাইটের হৈ-হুল্লোড়, ভোগ ও আনন্দবাদ, যৌন অপরাধে ক্রমেই তাদের সম্পৃক্ততা বাড়ছে। এভাবেই নতুন প্রজন্মকে প্রতিবাদের রাজনীতি থেকে সরিয়ে রেখে তাদের পথকে নিষ্কণ্টক ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে পরিকল্পিত পথেই এগোচ্ছে কায়েমি স্বার্থবাদীরা। অথচ ক্ষমতাসীনদেরই দায়িত্ব ছিল নাগরিক নিরাপত্তা বজায় রাখতে, যাতে আর কোনো গুম-অপহরণ ঘটতে না পারে।
এ তো গেল আমাদের অভ্যন্তরীণ আপদ। বাইরে আরেক আপদ আমাদের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকা বসবাসকারীদের জন্য দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। ফেলানী নামক এক অখ্যাত কিশোরীর বিএসএফের হাতে নিহত হওয়া থেকে এই আপদের সূচনা। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতে, বিএসএফের আত্মরক্ষা করার অধিকার আছে। তার অর্থ কি এই যে, একজন নিরস্ত্র গ্রাম্য কিশোরী ভারতের সশস্ত্র সীমান্ত বাহিনীর জন্য সত্যিই কোনো হুমকি ছিল। তদবধি নিয়মিতভাবেই চলছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের এই হত্যাযজ্ঞ। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, আমাদের ভরসার স্থল সরকারও ভারতীয়দেরই পক্ষ নিয়েছে। আমরা এখন কোথায় যাব, কার কাছে প্রতিকার চাইব? সারাদেশসহ বিজিবির নবনিযুক্ত মহাপরিচালক জেনারেল আজিজ এ হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার। নির্বিকার শুধু আমাদের সরকার। কী নিষ্ঠুর পরিহাস!
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে এক প্রকার জিঘাংসা কাজ করছে। যেন তারা আমাদের কোনো 'বিচ্যুতির' প্রতিশোধ নিচ্ছে। ঘরে যেমন, বাইরে থেকেও আমাদের জন্য বিপত্তি। সময় এসেছে_ শুধু আমাদের রাজনীতির পুনর্বিন্যাসে নয়, প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কেরও পুনর্মূল্যায়নের।

ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ :সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.