বিদ্যুত উৎপাদনে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সংশয়- প্রাথমিক জ্বালানির নিশ্চয়তা নেই ॥ গণশুনানিতে বিশেষজ্ঞরা

 প্রাথমিক জ্বালানির নিশ্চয়তা না থাকায় বিদ্যুত উৎপাদনে সরকার প্রণীত মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশের বিদ্যুত এবং জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে দেশে দিন দিন গ্যাসের মজুদ শেষ হচ্ছে।
এ অবস্থায় বিকল্প জ্বালানি হিসেবে কয়লার কথা বলা হলেও উত্তোলনের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। যাতে আগামী দিনে বিদ্যুত উৎপাদন মারাত্মকভাবে বিঘিœত হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন অবাস্তব এবং অযৌক্তিক ভিত্তির তথ্য-উপাত্তের ওপর নির্ভর করে সরকার বিদ্যুত উৎপাদনে মহাপরিকল্পনা করেছে। শনিবার সকালে রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি আয়োজিত ‘বিদ্যুত সমস্যার সমাধান এবং বিদ্যুতের মূল্য পরিস্থিতি : আগামীর পথনির্দেশনা’ শীর্ষক গণশুনানিতে বিশেষজ্ঞরা এসব মন্তব্য করেন। এছাড়াও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের ভুল নীতির কারণে দেশে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দেশের জ্বালানি পরিস্থিতির বাস্তব অবস্থা তুলে ধরে বক্তারা গণশুনানিতে বলেন, সরকারের চার বছর অতিক্রম হলেও এখনও কয়লা উত্তোলন বা আমদানি, এলএনজি আমদানির কোন অগ্রগতি নেই। প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার বাড়লেও গ্যাসের উৎপাদন একই হারে বাড়ছে না। বক্তারা বলেন, ২০৩০ সাল পর্যন্ত যে বিদ্যুত উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হয়েছে তাতে জ্বালানি হিসেবে সব থেকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে দেশীয় কয়লাকে। এর পরপর আমদানি করা কয়লা এবং এলএনজিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এখনও সরকার বিদ্যুত উৎপাদনের প্রাথমিক জ্বালানির সংস্থান করতে পারেনি। এখন দেশীয় কয়লা উত্তোলনের উদ্যোগ নিলেও খনি করতে আরও অন্তত পাঁচ থেকে ছয় বছর সময় লাগবে। এছাড়া বক্তারা বলছেন, ২০৩০ সাল পর্যন্ত সরকার গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদনের যে পরিকল্পনা করেছে তাও বাস্তব অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাঁরা বলছেন, সরকার বড় বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনে ব্যর্থ হওয়ায় ছোট আকারের বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে বেশি দামে বিদ্যুত কেনা হচ্ছে। সরকারের এই নীতিকে ভ্রান্ত উল্লেখ করে তাঁরা বলেন, এ কারণে দেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ছে।
সাবেক উপদেষ্টা জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম বলেন, প্রাথমিক জ্বালানির নিশ্চয়তা না করলে কোন মহাপরিকল্পনা সফল হবে না। সরকার স্বল্পমেয়াদী প্রকল্পগুলোতে সফল হয়েছে। কিন্তু মধ্যমেয়াদী বা দীর্ঘমেয়াদী কোন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ঠিকমতো হচ্ছে না। তিনি বলেন, জরুরীভিত্তিতে বিদ্যুত দিতে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট করা হয়। কিন্তু এখন দেখছি কয়েকটি কুইক রেন্টালের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে এবং বাকিগুলোরও বৃদ্ধি করা হবে। এতে করে সরকারের উচ্চমূল্যে বিদ্যুত কেনার প্রবণতা থেকে যাচ্ছে। ম. তামিম বলেন, জ্বালানি খাতে সরকার যে ভর্তুকি দিচ্ছে তার ৫০ শতাংশও জনগণের কাছে পৌঁছায় না। ডিজেলের দাম বাড়ানোর ফলে কৃষকের ধানের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। এই মুহূর্তে যদি কৃষক সরাসরি ভর্তুকি মূল্যে ডিজেল না পায় তাহলে আগামী বছর ধান ও চালের দাম বেড়ে যাবে, যা জীবনযাত্রার ওপর প্রভাব ফেলবে।
বুয়েটের রাসায়নিক কৌশল বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক এজাজ হোসেন বলেন, সরকার আগেও মাস্টারপ্ল্যান করেছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি। এবারও বাস্তবায়ন হবে না। বিদ্যুত সমস্যা সমাধানে সরকার আণবিক বিদ্যুতের কথা বলছে। কিন্তু এই প্রকল্প বাস্তবায়নে কত টাকা খরচ হবে তা সরকার বলছে না। রাশিয়া কোন্্ শর্তের ভিত্তিতে বা কত সুদে টাকা দেবে তাও স্পষ্ট নয়।
গণশুনানিতে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর আদেশ শুধু বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনই দিতে পারে। আইনে কমিশনকে এই ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। ২০০৮ সালে এই ক্ষমতা সরকারের হাতে নেয়ার জন্য একটি সুপারিশ সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু কমিটি তা বাতিল করে দিয়ে বিইআরসিকে দাম বাড়ানোর ক্ষমতা দিয়ে দেয়। তিনি অবিলম্বে এই ক্ষমতা বিইআরসিকে দেয়ার দাবি জানান। তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে ঘরে ঘরে আজ আগুন জ্বলছে। দ্রব্যমূল্য বেড়েই চলেছে। এতে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে নাভিশ্বাস উঠেছে।
গণশুনানিতে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির যুগ্ম-সচিব মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যেভাবে সরকার বিদ্যুত ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে, তাতে আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হবে। তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে পোশাক প্রস্তুতকারকরা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকলে রফতানি আয় অনেক কমে যাবে।
বিদ্যুত খাতে চলমান সিস্টেমলসকে শুভঙ্করের ফাঁকি হিসেবে উল্লেখ করেন বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুবিদ আলী ভূঁইয়া। তিনি বলেন, সরকারী প্রতিষ্ঠানেই সিস্টেমলসের কথা শোনা যায়। তিনি আরও বলেন, সিস্টেমলসের দোহাই দিয়ে বিদ্যুত কোম্পানিগুলো একটা গোঁজামিলের সমাধান দেয়ার চেষ্টা করে। সকল অপকর্ম ঢাকার একটি উপযুক্ত পদ্ধতি হলো সিস্টেমলস। তিনি বিদ্যুত কোম্পানির প্রতিনিধিদের আরও বেশি দায়িত্বশীল ও দেশপ্রেমিক হওয়ার আহ্বান জানান।
এতে উপস্থিত ছিলেন বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুল হক, শ্রম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ইসরাফিল আলম, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি মোঃ আশিকুর রহমান, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ইমদাদুল হক, সদস্য ড. সেলিম মাহামুদ ও প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন, বিদ্যুত বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিব মনোয়ার হোসেন, আরইবি চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মঈন প্রমুখ।

No comments

Powered by Blogger.