টাঙ্গাইলে গুলিতে আ. লীগ- নেতা ফারুক নিহত

আওয়ামী লীগের টাঙ্গাইল জেলা কমিটির সদস্য মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হয়েছেন। শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে টাঙ্গাইল শহরের কলেজপাড়া নিজের বাসার কাছে তাঁকে গুলি করে দুর্বৃত্তরা।
পরিবারের লোকজন ও এলাকাবাসী তাঁকে উদ্ধার করে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যার প্রতিবাদে গতকাল শনিবার দুপুরে টাঙ্গাইল শহর ও বাসাইলে বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশ হয়েছে। দুপুরের দিকে করটিয়ায় ঢাকা-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা। হত্যার প্রতিবাদে এবং হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবিতে আজ রবিবার টাঙ্গাইল শহরে অর্ধদিবস হরতাল ডেকেছে ছাত্রলীগ। বিশ্ব ইজতেমার জন্য মহাসড়ক হরতালের বাইরে থাকবে।
এদিকে ফারুক আহমেদের স্ত্রী নাহার আহমেদ তাঁর স্বামীকে দলের লোকজনই হত্যা করেছে বলে অভিযোগ করেছেন।
গতকাল বাদ আসর শহরের বিন্দুবাসিনী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জানাজা শেষে কেন্দ্রীয় কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর লাশ দাফন করা হয়। খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, সংসদ সদস্য শওকত মোমেন শাহজাহান, খন্দকার আবদুল বাতেন, আমানুর রহমান খান রানাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ জানাজায় অংশ নেয়। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, শুক্রবার রাতে টাঙ্গাইল শহরের কলেজপাড়ার নিজ বাসা থেকে আনুমানিক দেড় শ গজ দূরে জেলা আওয়ামী লীগ নেতা, মুক্তিযোদ্ধা ও টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক মূলস্রোতের সম্পাদক ফারুক আহমেদকে রাস্তার পাশে পড়ে থাকতে দেখেন টাঙ্গাইল পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শফিকুল হক শামীম। শামীমের চিৎকার শুনে ফারুক আহমেদের পরিবারের সদস্যরা এবং আশপাশের লোকজন ছুটে যান। তাঁকে দ্রুত টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু কতর্ব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
কাউন্সিলর শফিকুল হক শামীম জানান, তিনি দুই বন্ধুকে নিয়ে কলেজপাড়ায় তাঁদের বাড়ির কাছের রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন। হঠাৎ দেখতে পান, ডাস্টবিনের পূর্বদিকে রাস্তার পাশে একটি লোক পড়ে আছে। কোনো মাদকসেবী নেশা করে পড়ে আছে বলে প্রথমে তাঁদের ধারণা হয়। তাঁদের একজন পড়ে থাকা লোকটির মুখে টর্চলাইটের আলো ফেললে তাঁরা ফারুক আহমেদকে চিনতে পারেন। তখন তিনি চিৎকার দিয়ে ওঠেন। চিৎকার শুনে তাঁর (ফারুক) বাড়ির লোকজন ছুটে আসেন।
কাউন্সিলর জানান, তাঁরা কোনো গুলির শব্দ পাননি। তবে একটি রিকশা যাওয়ার শব্দ পেয়েছেন বলে জানান তিনি।
টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. নুর মোহাম্মদ জানান, ফারুক আহমেদ হাসপাতালে আনার আগেই মারা যান। মুখে রক্ত দেখে প্রথমে ব্রেনস্ট্রোক বলে ধারণা হয়েছিল। কিন্তু দাঁত ভাঙা বা জিহ্বা কাটা পাওয়া যায়নি। পরে ভালো করে পরীক্ষা করার সময় দেখা যায়, তাঁর পিঠের ডান দিকে ছোট ছিদ্র রয়েছে। সেখানে রক্ত জমাট বেঁধে ছিল। ময়নাতদন্তে দেখা গেছে, তাঁর হার্টের মূল সঞ্চালক রক্তনালির ভেতরে একটি গুলি আটকে ছিল। সেখানে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। তাঁর শরীরের আর কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর জানান, ফারুক আহমেদের দেহে গুলি পাওয়া গেছে। ঘটনাস্থল থেকে আরেকটি গুলি পাওয়া গেছে। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে অনেক বিষয় জড়িত থাকতে পারে। তদন্ত ছাড়া কোনো কিছু পরিষ্কার করে বলা এ মুহূর্তে সম্ভব না। গতকাল বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো মামলা হয়নি বলে তিনি জানান।
ফারুক আহমেদের স্ত্রী নাহার আহমেদ হাসপাতালে সাংবাদিকদের বলেন, তাঁর স্বামীকে দলের লোকজনই হত্যা করেছে। তিনি স্বামী হত্যার বিচার দাবি করেন।
টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আলমগীর খান মেনু বলেন, 'বুঝতে পারছি না, ফারুক আহমেদকে কে বা কারা হত্যা করল। তিনি তো খুব ধনী ছিলেন না। কারো সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ছিল বলে মনে হয় না।' তবে আওয়ামী লীগ নেতা শাহজাহান আনসারী শহরে এক বিক্ষোভ সমাবেশে বলেন, 'ফারুক আহমেদকে রাজনৈতিক কারণে খুন করা হয়েছে। আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতেই এই হত্যাকাণ্ড।'
ফারুক আহমেদের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শুনে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক আনিছুর রহমান মিঞা, পুলিশ সুপার সালেহ মোহাম্মদ তানভীরসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা হাসপাতালে ছুটে যান। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের প্রশাসক ফজলুর রহমান খান ফারুক, সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান রানাসহ দলীয় নেতা-কর্মীরা হাসপাতালে ভিড় জমায়।
ফারুক আহমেদ হত্যার প্রতিবাদে গতকাল শনিবার দুপুর ১২টার দিকে জেলা ছাত্রলীগ শহরে বিক্ষোভ মিছিল করে। বিভিন্ন সড়ক ঘুরে নিরালা মোড়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে তারা। পরে সেখানে রাস্তা অবরোধ করে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করে জেলা আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের নেতা-কর্মীরা। বক্তব্য দেন শাহজাহান আনসারী, সুভাস চন্দ্র সাহা, ফারুক হোসেন মানিক, এম এ রৌফ প্রমুখ।
একই দাবিতে বাসাইলে বিক্ষোভ মিছিল করেছে আওয়ামী লীগ। এর আগে দলের নেতা-কর্মীরা করটিয়ায় ঢাকা-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে অবরোধ সৃষ্টি করে। সে সময় সড়কের উভয় পাশে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়।
টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নাজমুল হুদা নবীন জানান, আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক আহমেদ হত্যার প্রতিবাদে আজ রবিবার শহরে অর্ধদিবস হরতাল ডাকা হয়েছে। তবে বিশ্ব ইজতেমার কারণে ঢাকা-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়ক হরতালের আওতামুক্ত থাকবে।
জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আলমগীর খান মেনু জানান, ফারুক হত্যার প্রতিবাদে পরে দলীয় কর্মসূচি দেওয়া হবে।
গতকাল দুপুরে ময়নাতদন্ত শেষে ফারুক আহমেদের লাশ বাড়িতে আনা হয়। সেখানে পরিবারের সদস্যরা, আত্মীয়স্বজন ও দলীয় নেতা-কর্মীরা কান্নায় ভেঙে পড়ে। তখন এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। ৩টার দিকে তাঁর লাশ স্থানীয় শহীদ মিনারে রাখা হয়। সেখানে সর্বস্তরের মানুষ তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানায়। বাদ আসর শহরের বিন্দুবাসিনী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জানাজা শেষে কেন্দ্রীয় কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর লাশ দাফন করা হয়। খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, সংসদ সদস্য শওকত মোমেন শাহজাহান, খন্দকার আবদুল বাতেন, আমানুর রহমান খান রানাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ জানাজায় অংশ নেয়।
ফারুক আহমেদ টাঙ্গাইল সদর উপজেলা বিআরডিবির চেয়ারম্যান, টাঙ্গাইল রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও করোনেশন ড্রামাটিক ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। তাঁর দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।
ফারুক আহমেদের গ্রামের বাড়ি সিলেটের জকিগঞ্জে। বাবার চাকরিসূত্রে ছাত্রাবস্থায় তিনি টাঙ্গাইলে আসেন। শহরের বিন্দুবাসিনী সরকারি উচ্চ বালক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। তিনি টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি ছিলেন। পরে জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর ও প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। হত্যা মামলাসহ তাঁর বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.