এই পশুবৃত্তি নিরসনে সোচ্চার হতে হবে by মাহমুদুর রহমান মান্না

বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের হার অন্যান্য দেশের তুলনায় এমনিতে অনেক বেশি। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ করা যাচ্ছে না। ইদানীং তা যেন লাগামহীন হয়ে পড়ছে। সরকারের প্রচার মাধ্যমে নানাবিধ খাতে উন্নয়নের সূচক যেভাবে দেখানো হচ্ছে, এমনকি নারীর ক্ষমতায়ন সম্পর্কেও পাঁচ মুখে বলা হচ্ছে।
এসব সত্যি হলে নারী নির্যাতনের হার হ্রাস পাওয়ার কথা। অথচ হচ্ছে বিপরীত। নারীর প্রতি অমানবিক আচরণ, সহিংসতা, গণধর্ষণ ও ধর্ষিতাকে খুন- এসব বেড়েই চলেছে। এর কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যায় নির্যাতিতার স্বজন ও জনগণের অভিযোগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি। স্থানীয় পুলিশ প্রায় প্রতিটি নারী নির্যাতনের ঘটনায় অপরাধীর পক্ষে অবস্থান নিয়ে থাকে। কারণ অপরাধীরা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকে।
কাপাসিয়ার ঘটনায় দেশের মানুষ আরো উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। নির্যাতিত মেয়েটিকে তার ঘর থেকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে নিখোঁজ করে রেখেছেন সরকারি দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। জাতীয় মহিলা সমিতির প্রতিনিধি-সদস্যরা নির্যাতিতাকে আইনি সহায়তা দিতে গিয়েছিলেন। মেয়েটির বাবাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন থানায়। কিন্তু তাঁদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রেখেও জিডি পর্যন্ত গ্রহণ করেনি পুলিশ।
উপজেলা মহিলা লীগের নেত্রী নিজেই বলেছেন, তিনি মেয়েটিকে অন্য স্থানে নিয়ে রেখেছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরাও বলেছেন, ওই নেত্রী মোটরসাইকেলে বসিয়ে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গেছেন মেয়েটিকে। তিনি স্বীকার করেছেন মেয়েটিকে গায়েব করার কথা। অথচ পুলিশ তাঁকে না ধরে বিভিন্ন জায়গায় সন্ধান করছে উদ্ধারের জন্য। সন্দেহাতীতভাবে এটা আইনের অপপ্রয়োগ হিসেবে গণ্য।
টাঙ্গাইলের ঘটনাও মনে করতে পারি আমরা। ওই নির্যাতিত মেয়েটির বাবা ভয়ে মুখ খুলতে পারেননি। পত্রিকায় দেখলাম একটি মেয়েকে এক বছর আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয়েছে। এখন সে অন্তঃসত্ত্বা। আমরা কি আইনশৃঙ্খলাহীন কোনো নৈরাজ্যকর দেশে বাস করছি?
আমরা জানি, দিলি্লতে ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে সারা ভারতজুড়ে জনগণ ফুঁসে উঠেছিল। নারীর নিরাপত্তা ও ধর্ষণ আইনের সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে সরকারকে বাধ্য করেছিল নতুন আইন সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করতে। দেখেছি মেয়েটির লাশ আনতে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী গিয়েছিলেন বিমানবন্দরে। প্রমাণ করেছেন যে রাষ্ট্র নির্যাতিতার পক্ষে, রাষ্ট্র ন্যায়, আইনের শাসন ও মানবিকতা প্রতিষ্ঠার পক্ষে। অপরদিকে আমাদের রাষ্ট্র বা সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত নেতিবাচক এবং সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের ঔদ্ধত্য ন্যক্কারজনক। ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষমতার অপপ্রয়োগ হচ্ছে বিনা দ্বিধায়।
এই পশুবৃত্তি নিরসনে ভারতের জনগণের মতো আমাদেরও তাই প্রতিবাদী হতে হবে। সমাজের সর্বস্তরে নারী অধিকার রক্ষা, নারী নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। আর তা করতে হবে এখনই। আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্যজুড়ে নারীর প্রতি সম্মানের উদাহরণ রয়েছে। তাই নারী অধিকার রক্ষা আমাদের সাংস্কৃতিক যুদ্ধও। বাঙালি সংস্কৃতির বিশাল জায়গাজুড়ে রয়েছে নারীর ভূমিকা। বাঙালির সংগ্রামী ইতিহাসজুড়ে রয়েছে নারীর অসামান্য কীর্তি। রয়েছে সাংস্কৃতিক পরম্পরায় মাতৃভক্তি। অথচ আজ এ দেশে নারী তার জীবনের, সম্ভ্রমের নিরাপত্তা পাচ্ছে না। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে! স্কুল-কলেজের মেয়েরা নিরাপত্তাহীনতায় আতঙ্কগ্রস্ত থাকবে কেন একটি স্বাধীন দেশের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে? তাই আমাদের সবার নিজ নিজ অবস্থান থেকে নারী অধিকার রক্ষা, নারীর নিরাপত্তা ও নারী নির্যাতন আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের জন্য আওয়াজ তুলতে হবে।
প্রচলিত আইনও যদি যথাযথ প্রয়োগ হয়, স্বজনপ্রীতি যদি বন্ধ হয় তাহলে এ ধরনের ঘটনা কমে আসবে। প্রশাসনকে দায়িত্ব সচেতন হওয়া অপরিহার্য। তা না হলে এমন ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে না।
গ্রন্থনা : মোস্তফা হোসেইন ও লুৎফর রহমান রনো

No comments

Powered by Blogger.