বিশ্ব এজতেমায় আজ আখেরি মোনাজাত

আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে টঙ্গীতে দ্বিতীয় পর্বের বিশ্ব এজতেমা আজ শেষ হচ্ছে। লাখো ধর্মপ্রাণ মুসল্লির উপস্থিতিতে টঙ্গী তুরাগ তীর এখন এক পুণ্যভূমি। জিকির আসকার ও আল্লাহর রেজাবন্দীর আসায় মশগুল রয়েছেন বিশ্ব এজতেমায় যোগ দেয়া অসংখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি।
দুপুর ১২টা থেকে ১টার মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে আখেরি মোনাজাত। আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে রবিবার ভোর থেকে মানুষের ঢল নামবে টঙ্গীর দিকে। আখেরি মোনাজাতের পূর্ব পর্যন্ত এ ঢল অব্যাহত থাকবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ দেশ বিদেশের লাখো লাখো মুসল্লি এ আখেরি মোনাজের শরিক হবেন। দ্বিতীয় পর্বের এজতেমায় প্রথম পর্বের চেয়ে মুসল্লির সমাগম অনেকটা কম দেখা গেছে। যানজট ও মানুষ জটও ছিল কম।
এদিকে আখেরি মোনাজাত নির্বিঘœ করতে ঢাকার দিকে মহাখালী গাজীপুরের দিকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা কালীগঞ্জ রোডের দিকে মীরের বাজার এবং আশুলিয়ার দিকে আশুলিয়ায় সকল যানবাহন আজ মধ্য রাত থেকে থামিয়ে দেয়া হবে। শুধু মাত্র জরুরী সার্ভিসের যানবাহনগুলো স্বাভাবিক চলাচল অব্যাহত থাকবে। প্রতিবছর আখেরি মোনাজাতের শেষে ঢাকা-টঙ্গী-গাজীপুর, আশুলিয়া, পুবাইল সড়কে ট্রাফিক পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের স্বল্পতার কারণে মহাসড়কগুলোতে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ যানজট। আখেরি মোনাজাত শেষে যানজট নিরসনে আরও অধিক সংখ্যক ট্রাফিক পুলিশ মোতায়েনের দাবি করেছেন এজতেমায় আসা মুসল্লিরা।
লাখো মুসল্লির জিকির আজগার ও তবলীগ মুরুব্বীদের গুরুত্বপূর্ণ বয়ানের মধ্য দিয়ে ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে শনিবার বিশ্ব এজতেমার দ্বিতীয় ধাপের দ্বিতীয় দিন অতিবাহিত হয়েছে। টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরের বর্তমান ময়দানে স্থান সঙ্কুলানের অভাবে গত তিন বছর থেকে দুই ধাপে বিশ্ব এজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। প্রথম ধাপের এজতেমায় বহিরাগত মুসল্লিদের অংশগ্রহণ ছিল জামাতবন্দী মুসল্লিদের চেয়ে অনেক বেশি। টঙ্গী ও আশপাশের এলাকায় প্রথম ধাপের এজতেমার যে আমেজ বিরাজ করছিল দ্বিতীয় ধাপে সেই আমেজ আর নেই। বহিরাগত মুসল্লিদেরে কোলাহলমুক্ত দ্বিতীয় ধাপের এজতেমায় তবলিগ মুরুব্বীদের বয়ান শুনতে মশগুল জামাতবন্দী মুসল্লিরা।
এজতেমায় তবলিগের শীর্ষ মুরুব্বীরা দিনে ৪ বার তথা বাদ ফজর, বাদ জোহর, বাদ আসর ও বাদ মাগরিব আ’ম বয়ান (সব শ্রেণীর জন্য সর্বজনীন বয়ান) করে থাকেন। মাঝে মাঝে তবলিগ মুরুব্বীগণ বয়ান ও নামাজের মিম্বর থেকে বিশেষ শ্রেণীর তথা আলেম, সাধারণ শিক্ষিত, মাদ্রাসা ও স্কুল-কলেজের ছাত্র এবং বিদেশী মুসল্লিদের উদ্দেশে খুসুসী বা খাস বয়ান (নির্দিষ্ট শ্রেণীর জন্য বয়ান) করেন। শনিবার দ্বিতীয় ধাপের দ্বিতীয় দিনের এজতেমায় বাদ ফজর আ’ম বয়ান করেন পাকিস্তানের মাওলানা জামিল, বাদ জোহর ভারতের মিয়াজী আজমত উল্লাহ, বাদ আসর ভারতের মাওলানা যোবায়েরুল হাসান এবং বাদ মাগরিব ভারতের মাওলানা আহমদ লাট। এছাড়া মাওলানা আহমদ লাট সকাল ১০ টায় বয়ানের মঞ্চ থেকে আলেমদের উদ্দেশে এবং পাকিস্তানের মাওলানা শওকত নামাজের মিম্বর থেকে আরব ছাত্রদের উদ্দেশে খাস বয়ান করেন। খাস বয়ানের শ্রোতারা নির্ধারিত সময়ের আগেই নির্ধারিত স্থানে অর্থাৎ নামাজ ও বয়ানের মিম্বরের সামনে গিয়ে সমবেত হন। তবলিগ মুরুব্বিদের আ’ম বয়ান সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ভাষা ভাষীদের জন্য তরজমা করে শুনানো হচ্ছে। মনোমুগ্ধ হয়ে মুসল্লিরা তবলিগ মুরুব্বীদের গুরুত্বপূর্ণ এসব বয়ান শুনতে মশগুল রয়েছেন।
এজতেমা ময়দানে তবলিগ জামাতের মরুব্বীগণ সুবিশাল চটের প্যান্ডেলের নিচে অবস্থানরত দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লির উদ্দেশে তবলিগের ছয় উসূল (৬টি মৌলিক বিষয়) যথা কালিমা (ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোর ওপর বিশ্বাস স্থাপন),নামাজ, ইলম ও জিকির (দ্বীনি শিক্ষা ও সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহকে সর্বক্ষণ স্মরণ করা), ইকরামুল মুসলিমিন (মুসলমানদের প্রতি সদাচারণ), তাসহিয়ে নিয়ত (শুদ্ধ নিয়ত) এবং তবলিগ (দ্বীনের প্রচার) সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বয়ান করেন। মুরুব্বীদের বয়ান চলাকালে ময়দানে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে।
যৌতুকবিহীন বিয়ে ॥ এজতেমা ময়দানের মূল মঞ্চে শনিবার বাদ আছর কনের অভিভাবক ও বরের উপস্থিতিতে যৌতুকবিহীন গণবিবাহ পড়ানো হয়। বিবাহ শেষে মঞ্চে খেজুর ও মিষ্টি বিতরণ করা হয়। শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত শতাধিক জোড়া বর ও কনের বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানা গেছে। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ এসব দম্পতি দাম্পত্য জীবনে শরীয়তের বিধি-বিধান শিক্ষা লাভের জন্য এজতেমায় নিজেদের উৎসর্গ করবে বলে কনেরা জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, করা যেতে পারে নবীজির যৌতুকবিহীন বিবাহ প্রথা সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে এজতেমার শীর্ষ মুরুব্বীগণ প্রতিবছর গণবিয়ের এ আয়োজন করে থাকেন।
চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে দুর্ভোগ ॥ এজতেমায় আগত মুসল্লিদের অনেকে আকস্মিক বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ফ্রি চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। টঙ্গী পৌর কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় এজতেমা ময়দানের উত্তর পাশে নিউ মন্নু মিলের বাউন্ডারির ভেতর খালি জায়গায় ফ্রি চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো চালু রয়েছে। চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোর সঙ্গেই র‌্যাব, এনএসআই ও গাজীপুর জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষও অবস্থিত। সেখানে পানি নিষ্কাশনের কোন ব্যবস্থা না থাকায় ওজুর পানিতে ৮টি চিকিৎসা কেন্দ্র তলিয়ে গেছে। ফলে ডা. এ.আর খান হোমিওপ্যাথি মেডিক্যাল সেন্টার, পাকিজা গ্রুপ, রেনেটা লিঃ, শহীদ মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও আয়ুর্বেদীয় ফার্মাসি (ঢাকা) লিঃসহ ৮টি ফ্রি চিকিৎসা কেন্দ্র বন্ধ রয়েছে।
মোবাইল কোর্ট ॥ এজতেমায় স্থাপিত গাজীপুর জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ সূত্রে জানা যায়, এজতেমায় হোটেল- রেস্তরাঁয় বিশুদ্ধ খাবার সরবরাহ নিশ্চিত করতে ৩টি ভ্রাম্যমাণ আদালত কাজ করছে। এছাড়া আদালত এজতেমা এলাকায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং পকেটমার ও ছিনতাইকারীদের তাৎক্ষণিক বিচার করার কাজেও নিয়োজিত রয়েছেন।
বিদেশী মেহমান ॥ শনিবার পর্যন্ত বিশ্বের ৮৭টি দেশের প্রায় ১০ হাজার বিদেশী মুসল্লি এজতেমায় শরিক হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৪৯৬৬ জন বিভিন্ন মেয়াদের চিল্লাধারী মুসল্লি এবং বাকি ২৯৮০ জন শুধু ইজতেমায় অংশ নিয়ে আখেরি মোনাজাত শেষে নিজ নিজ দেশে ফিরে যাবেন বলে ইজতেমায় বিদেশী মুসল্লিদের ইজতেকবাল (অভ্যর্থনা) কক্ষ সূত্রে জানা গেছে। এবছর পাকিস্তান থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক অর্থাৎ ৭৬৯ জন মুসল্লি ইজতেমায় অংশ নিয়েছেন। ভারত থেকে এসেছেন ৩৩১ জন এবং সৌদী আরব থেকে ১৬৭ জন। এছাড়া বার্মা, মালদ্বীপ, আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, ইরান, ওমান, ব্রুনাই, কুয়েত, কুরিয়া, চীন, জর্দান, তুরস্ক, থাইল্যান্ড, আরব আমিরাত, বাহরাইন, ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়া, সিরিয়া, মিসর, সিঙ্গাপুর, লেবানন, আলজেরিয়া, মরক্কো, সোমালিয়া, তাঞ্জানিয়া, চাদ, ইয়েমেন, নাইজেরিয়া, তিউনিশিয়া, অষ্ট্রেলিয়া, অষ্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, কানাডা, কম্বোডিয়া, ফিনল্যান্ড, ফিজি, জাম্বিয়া, ফ্রান্স, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ইতালি, কেনিয়া, মৌরিতানিয়া, মালি, নরওয়ে, আফ্রিকা, ফিলিস্তিন, জিবুতি, ঘানা, কাতার, জাপান ও জার্মানির মুসল্লিরা ইজতেমায় অংশ নিয়েছেন।
আরও ৫ জনের মৃত্যু ॥ তবলীগ জামাতে এসে এজতেমা ময়দানে শুক্রবার রাত থেকে শনিবার বিকেল পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়ীয়া কাজীপাড়ার আনোয়ার হোসেন (৫৫), টাঙ্গাইল কালীহাতীর আগচারান গ্রামের নুরমোহাম্মদ খান (৭০), নওগাঁ মান্দার নাপিতপাড়ার ইসমাইল হোসেন (৬০), হেদায়েতুল ইসলাম (৭০), নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার মহেসপুর গ্রামের সুলতান উদ্দিন (৬৫) ইন্তেকাল করেছেন। এ নিয়ে দ্বিতীয় পর্বের এজতেমায় মোট মুসল্লির মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল ৯-এ।
এজতেমা ময়দানে তবলীগ জামাতের মরুব্বীগণ সুবিশাল চটের প্যান্ডেলের নিচে অবস্থানরত দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লির উদ্দেশ্যে তবলিগের ছয় উসূল (৬টি মৌলিক বিষয়) যথা কালিমা (ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোর ওপর বিশ্বাস স্থাপন), নামাজ, ইলম ও জিকির (দ্বীনি শিক্ষা ও আল্লাহ্্কে সর্বক্ষণ স্মরণ করা), ইকরামুল মুসলিমিন (মুসলমানদের প্রতি সদাচারণ), তাসহিয়ে নিয়ত (শুদ্ধ নিয়ত) এবং তবলিগ (দ্বীনের প্রচার) সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বয়ান করেন। মুরুব্বীদের বয়ান চলাকালে ময়দানে বয়ানে বলেন, আল্লাহর সান্নিধ্য পেতে হলে কোরানের সকল নির্দেশ মানতে হবে। সঠিক পথে চলতে হবে। পিনপতন নীরবতা নেমে আসে।

No comments

Powered by Blogger.