শহীদ আসাদ দিবস-আসাদ থেকে স্বাধীনতা by ফকির আলমগীর

স্বদেশ মুক্তির লড়াইয়ে আসাদ এক সাহসী পথপ্রদর্শক। অন্যদিকে আসাদ আন্দোলন ও সংগ্রামের প্রেরণার উৎস। আমরা আজকে যখন শহীদ আসাদের কথা স্মরণ করি, তখন সেই গণঅভ্যুত্থানের কথা মনে হয়। আসাদ শহীদ না হলে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান হতো না, আসাদের পথ ধরেই মতিউর শহীদ হন।
আসাদের আত্মদানেই তখন স্বৈরশাসক আইয়ুবের তখ্ত উল্টে যায়। আমি তখন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র এবং সক্রিয়ভাবে আসাদেরই ছাত্র সংগঠন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) সঙ্গে যুক্ত। তাই শহীদ আসাদের রক্তমাখা শার্ট ছুঁয়ে শপথ নেওয়ার সেই উজ্জ্বল স্মৃতি আজও আমাকে জনগণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের সংগ্রামে প্রেরণা জোগায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস লিখতে গেলে আসাদের নাম আসবেই। বর্তমান প্রজন্মকে স্বদেশ মুক্তির আন্দোলন-সংগ্রামের কথা জানতে হলে আসাদচর্চা বেশি জরুরি। কারণ স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতিপর্বে আসাদ একটি বিরল মানুষ ছিলেন। তার স্বপ্ন ছিল জনগণতন্ত্র_ এ কথা সবার জানা। শহীদ আসাদ স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববঙ্গের স্বপ্ন দেখতেন। '৫২ থেকে ৬৯-এর মধ্যে রাজনীতির ধার আরও স্পষ্ট হয়েছে, মানুষের চেতনা আরও তীব্র হয়েছে, মানুষের আকাঙ্ক্ষা আরও পরিচ্ছন্ন হয়েছে। তারপর সেই যে আসাদের আন্দোলনের ধারা, তারই পথ ধরে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পথ ধরে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের ভেতরকার আকাঙ্ক্ষা একটা রূপ পেয়েছে। যে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি স্বীকৃতি পেয়েছিল বাংলাদেশের সংবিধানে, সেখানে সমাজতন্ত্রের কথা ছিল। সেই সমাজতন্ত্রের কথা আসাদ ভাবতেন এবং আসাদের যে স্বপ্ন, জনগণের যে স্বপ্ন বুকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল তার সমস্ত কিছুর মধ্যেই গণতান্ত্রিক পূর্ববঙ্গের, সমাজতান্ত্রিক পূর্ববঙ্গের স্বপ্ন ছিল; কিন্তু এত বছর পর যখন আসাদকে আমরা স্মরণ করছি তখন একটি প্রশ্ন আমাদের সামনে এসে যায়। আসাদের স্বপ্ন কি সফল হয়েছে? আমরা জানি আসাদের স্বপ্ন সফল হয়নি। আসাদের আত্মত্যাগ ছিল শোষণ মুক্তির প্রেরণা। যতদিন শোষণ থাকবে, বঞ্চনা থাকবে, নিপীড়ন থাকবে, ততদিন মৃত্যুঞ্জয়ী আসাদ থাকবে মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে এক সাহসী পথপ্রদর্শক হয়ে। কারণ আমরা দেখেছি স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময়ে সামরিক অভ্যুত্থান আমাদের দেশে হয়েছে। তারপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অজুহাতে বিশেষ জায়গার বিশেষ লোকেরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে। যে স্বপ্ন এ দেশের মুক্তিকামী মানুষ দেখেছে, যার জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, সেই স্বপ্ন লাঞ্ছিত হয়েছে, প্রতিক্রিয়াশীলদের জয় হয়েছে। কাজেই আমরা আসাদকে স্মরণ করি সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে। শহীদ আসাদ তাই সব সময় জনগণতান্ত্রিক বাংলা প্রতিষ্ঠার বার্তা নিয়ে আসেন। ধ্রুবতারার মতোই তিনি বেঁচে আছেন আমাদের হৃদয়ে। তাই তো শহীদ আসাদ উত্তাল ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান আমাদের জাতীয় জীবনে এক গৌরবময় অর্জন। তাই একুশের মতো ঊনসত্তর বাঙালি জাতীয়তা বোধের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। এক একটি শব্দের মধ্যে এসে পুঞ্জীভূত হয়েছে দেশ-জাতির চিন্তা-চেতনা, আশা-আকাঙ্ক্ষার যত অভিব্যক্তি। বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রাম কেবল ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে নিহিত নয়। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস অনেক দূর বিস্তৃত। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান প্রকৃত অর্থে একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের সোপান রচনা করেছিল। '৫২-এর ভাষা আন্দোলন বাঙালিকে ঘরমুখো করেছিল, আর '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান সেই বাঙালিকে তার ঘরের ঠিকানা খুঁজে দিয়েছিল। স্বাধিকারের ঢিমেতাল আন্দোলন ঊনসত্তরের ২০ জানুয়ারি আসাদের মৃত্যুর পর সহসাই গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। তাই আসাদকে গণঅভ্যুত্থানের নায়ক বলা হয়। '৬৯-এর ধারাবাহিকতায় একাত্তরে আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হলেও শহীদ আসাদের চেতনা কখনও ফুরাবার নয়।

ফকির আলমগীর :গণসঙ্গীত শিল্পী

No comments

Powered by Blogger.