সরকারের সব সাফল্য ম্লানের মেশিন ছাত্রলীগ, যুবলীগ!

 ফের ফ্রাঙ্কেইস্টাইনের ভূমিকায় ছাত্রলীগ-যুবলীগ। শাসক দলের এ দুটি সংগঠন সরকারের সকল অর্জন ধ্বংস করার মিশনে নামলেও নিয়ন্ত্রণ করার কেউ নেই।
সরকারের চার বছরের শাসনামলে নানা খাতে সরকারের অর্জনগুলোকে যখন সারাবিশ্বই স্বীকৃতি দিচ্ছে, অর্থনীতিসহ নানা বিষয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে সরকারের ভাবমূর্তি যখন ক্রমশ উজ্জ্বল হচ্ছেÑ ঠিক তখনই ছাত্রলীগ-যুবলীগের পরিকল্পিত নানা কর্মকা- সবকিছুকে ম্লান করে দিচ্ছে। শুধু সরকারী দলই নয়, খোদ বিরোধী দলের পক্ষ থেকেও এখন বলা হচ্ছেÑ সরকারের সকল অর্জনকে ধ্বংস করতে ছাত্রলীগ-যুবলীগই যথেষ্ট। প্রশ্ন উঠেছেÑ মহাজোট সরকারের সব অর্জন বিসর্জনের মিশনে নামা ছাত্রলীগ-যুবলীগ নামধারী এরা কারা? আদর্শ নয়, বরং ক্ষমতার প্রভাবে অর্থের নেশায় বুঁদ হয়ে সর্বত্র নিজেদের মধ্যে প্রাণঘাতী খেলায় মেতে ওঠা এ দুটি সংগঠনে সুকৌশলে আশ্রয় নেয়া যুব-ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীদের বেপরোয়া কর্মকা-ে খোদ সরকারের হাইকমান্ডকেই উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। ভর্তি বাণিজ্য, টেন্ডারবাজী, দখল, চাঁদাবাজিসহ সব ধরনের অনৈতিক কর্মকা-ে এ দুটি সংগঠনের নাম এলেও দেখার যেন কেউ নেই।
মাঝে মধ্যে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে হুঁশিয়ারি, কিছু পদক্ষেপ নেয়া হলেও অনেকেরই অভিযোগ, এ দুটি সংগঠনের লাগাম টেনে ধরতে অনেকটাই উদাসীন বর্তমান সরকার। এ দুটি সংগঠনে সুকৌশলে ঢুকে পড়া জামায়াত-শিবির সন্ত্রাসীদের শেষ বছরে সরকারকে জনবিচ্ছিন্ন ও প্রশ্নবিদ্ধ করার মিশন এখনই কঠোর হস্তে দমন করতে না পারলে আগামী নির্বাচনে সরকারকে বড় ধরনের মাশুল দিতে হবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অনুসন্ধান করে জানা গেছে, সরকারের যখনই বড় কোন অর্জন আসে, তখনই সেই অর্জনকে ম্লান এবং জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতেই ছাত্রলীগ-যুবলীগ ক্যাডাররা কোথাও না কোথাও বড় কোন অঘটন ঘটাচ্ছে। সরকারের গত চার বছরে অনেক কাজের যখন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আসছে, তখনই ছাত্রলীগ বা যুবলীগের অনৈতিক কর্মকা-ে তা চাপা পড়ে যাচ্ছে। সরকারের সাফল্যের চেয়ে এ দুটি সংগঠনের বিতর্কিত তৎপরতাই সংবাদ মাধ্যমে বড় করে ছাপা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বিশ্বই বলছে বাংলাদেশ এখন এক সাফল্যের গল্প। এ সাফল্য শুধু অর্থনীতিতেই নয়, মানব উন্নয়নেও আসন গেড়ে বসেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়েছে। এ কারণেই দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। দেশটির এ অগ্রগতির সাফল্য এখন আর বিদেশীদের চোখও এড়াচ্ছে না। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সাপ্তাহিক ইকোনমিস্টের চোখে ধরা পড়ে বাংলাদেশের এ অগ্রগতির গল্প। ঠিক তার পর পরই বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে আসল এ অগ্রগতির স্বীকৃতি। শুধু তাই নয়, বিশ্বব্যাংক এও স্বীকার করেছে যে, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে বৈশ্বিক অঙ্গনে যে নেতিবাচক ধারণা ছিল তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক এও বলছে, ২০২১ সাল নাগাদ একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে উন্নীত করতে হবে।
এসব স্বীকৃতির পাশাপাশি যখন খোদ বিশ্বব্যাংক বিশ্বমন্দার মধ্যেও ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সারাবিশ্ব্রে মধ্যে বাংলাদেশ পঞ্চম স্থান অধিকারী হওয়ার স্বীকৃতি দেয়, ঠিক তার দু’দিন পরই পুরান ঢাকায় এক নিরীহ দর্জি শ্রমিক বিশ্বজিৎকে ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্য কুপিয়ে হত্যার ঘটনা সরকারের এ বিশাল সাফল্যকে ম্লান করে দেয়। সরকারের এত বড় অর্জন দেশের জনগণ ভালভাবে জানার আগেই এই নৃশংস ঘটনা জানতে পারে, সরকার সম্পর্কে মানুষের সৃষ্টি হয় নেতিবাচক ধারণা। সরকারী তদন্তে বেরিয়ে পড়েছেÑ ছাত্রলীগের নামধারী এসব হত্যাকারী বেশিরভাগই অতীতে ছাত্রশিবির ও ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল।
সর্বশেষ নতুন বছরে বিশ্বব্যাংকসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ যে এখন তলাবিহীন ঝুড়ি নয়, সারাবিশ্বের কাছে উন্নয়নের মডেল’ বলে স্বীকৃতি দেয়, ঠিক তখনই আবারও বেপরোয়া হয়ে ওঠে সরকারের নিজেরই এ দুটি সংগঠন। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ, পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে ছাত্রলীগ ক্যাডারের গুলি করার সচিত্র মহড়া, দু’গ্রুপের গুলিতে এক শিশুর প্রাণহানী এবং ঢাকার গণপূর্তে টেন্ডারবাজি করতে গিয়ে যুবলীগ ক্যাডারদের মহড়া এবং ঠিকাদারদের মারধরের দৃশ্য সরকারের এই বিশাল অর্জনকেও ম্লান করে দেয়। ছাত্রলীগ-যুবলীগের সুযোগসন্ধানী এসব সন্ত্রাসী সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ ও সকল অর্জনকে ম্লান করে দেয়ায় যেন প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন উঠেছেÑ এসব অপকর্মে জড়িতরা সত্যিই কী বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী, নাকি সরকারী দলে সুকৌশলে প্রবেশ করে অন্য কেউ সরকারকে জনবিচ্ছিন্ন করার মিশনে নেমেছে?
পত্রিকার পাতা খুললেই দেশের কোথাও না কোথাও ছাত্রলীগের সশস্ত্র মহড়া, নিজেদের মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার দৃশ্য দেশের মানুষের কাছে অনেকটাই সহনীয় হয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দাবিÑ গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্রলীগ আর আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন নয়। স্বাধীন সংগঠন বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও ছাত্রলীগের লাগামহীন ও সাংঘর্ষিক কর্মকা-ে উদ্বিগ্ন সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা।
এমনকি প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাও বার বার কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে আসছেন। রুষ্ট প্রধানমন্ত্রী এও বলেছেন, ছাত্রলীগের কারণে সরকারের সব অর্জনকে বিসর্জন করতে দেয়া হবে না। একই সঙ্গে তিনি সরকারী দলে সুকৌশলে ছাত্রশিবির-ছাত্রদল সন্ত্রাসীরা পরিচয় লুকিয়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগে প্রবেশ করছে বলেও সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সজাগ থাকারও আহ্বান জানিয়েছেন।
এমনকি মাত্র ক’দিন আগে ছাত্রলীগের ৬৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে সংগঠনটির সাবেক সভাপতি ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এই ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের সংযত আচরণ করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলতে বাধ্য হন, ছাত্রলীগের ৬৫ বছরের গৌরবের ইতিহাস যেমন আমাদের মাথা উঁচু করে, তেমনি সম্প্রতি ছাত্রলীগের কিছু অপকর্ম আমাদের মাথাকে নিচু করে দিয়েছে। ছাত্রলীগে ‘কিছু হাইব্রিড ও ফরমালিন’ ঢুকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
ছাত্রলীগের সম্প্রতি বিতর্কিত কর্মকা- সম্পর্কে যোগাযোগ করা হলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ জনকণ্ঠকে বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে একেক রকম ইস্যুকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ সংঘাত-সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। ইতোমধ্যে যারা অপরাধ করেছে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সম্প্রতি যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ সময় সারাদেশের ছাত্রলীগের নেতাদের সংগঠনের আদর্শ মেনে চলারও পরামর্শ দেন তিনি।
সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, ময়মনসিংহ কৃষি বিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষ এবং গুলিতে এক শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় প্রচ- ক্ষুব্ধ সরকারের হাইকমান্ড। ইতোমধ্যে প্রশাসনের উচ্চ মহলকে এসব ঘটনায় জড়িত ছাত্রলীগ বা যেই হোক দ্রুত তাদের গ্রেফতার করে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি এও হুঁশিয়ারি করে দেয়া হয়েছে, সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত যে যত বড় নেতাই হোক, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নেয়া হলে সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.