প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়া সফর-সুযোগ ও সম্ভাবনা by দেলোয়ার হোসেন

বাংলাদেশ-মস্কো সম্পর্ক একটি ঐতিহাসিক সম্পর্ক। এর একটি দীর্ঘ ইতিহাস আছে। ১৯৭১ সালের উত্তাল দিনগুলোতে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল। বিশ্ব কূটনীতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে সে সময়ের পাক-মার্কিন পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ-উত্তরকালেও সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক মস্কো সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের এক ঐতিহাসিক অগ্রযাত্রা সূচিত হয়েছিল। কালের আবর্তে বিশ্বরাজনীতি এবং আঞ্চলিক রাজনীতির এক ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। বিশেষ করে বাংলাদেশ এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয় দেশের রাজনীতির এক নতুন ইতিহাস দেখা যায়। একদিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক ও অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটে। যার মাধ্যমে রাজনীতিতে এক নতুন মেরুকরণ শুরু হয়। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে নতুন নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। আজকের রাশিয়া সেই সোভিয়েত পরাশক্তির উত্তরাধিকার হিসেবে ১৯৯১ সাল থেকে নতুনভাবে আবির্ভূত হয়।
রাশিয়া শুরুতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে পড়লেও ধীরে ধীরে বিশ্ব অর্থনীতি এবং বিশ্ব রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে ইতিমধ্যে আত্মপ্রকাশ করেছে। এটি নতুন রাশিয়া হলেও বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন করার কোনো সুযোগ নেই। রাশিয়ার রাজনৈতিক নেতৃত্ব বরাবরই বিষয়টি তাদের সর্বক্ষেত্রে প্রতিফলিত করে আসছে।
১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসে নতুন রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে। এর মধ্যে রাশিয়া বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক শক্তি এবং সপ্তম বৃহৎ অর্থনীতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। পাশাপাশি আঞ্চলিক ও বিশ্বরাজনীতিতে অনেক বেশি সক্রিয় অবস্থান গ্রহণ করছে। ইউরোপ, পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, লাতিন আমেরিকাসহ সর্বত্র রাশিয়ার ব্যাপক কূটনৈতিক অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়।
দেরিতে হলেও সম্প্রতি ডবি্লউটিওর সদস্যপদ লাভের মাধ্যমে দেশটির অর্থনৈতিক সম্পর্ক শক্তিশালী হয়েছে। এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মস্কো সফর করে এলেন। এ সফর নানাদিক থেকে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এই সফরের মাধ্যমে আমরা কতগুলো ক্ষেত্রে দু'দেশের সম্পর্কের এক নতুন ধারা সূচনার ইঙ্গিত পাই। এর অন্যতম হচ্ছে, জ্বালানি সহযোগিতা। বিশ্বে জ্বালানি শক্তিতে রাশিয়া একটি শক্তিশালী পক্ষ। দেশটিতে পেট্রোলিয়াম গ্যাস সম্পদের রিজার্ভ বিশ্বে সর্ববৃহৎ। তার সঙ্গে তারা পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করে জ্বালানি উৎপাদনে অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে মস্কোর সঙ্গে বাংলাদেশের জ্বালানি বিষয়ক সহযোগিতার বিষয় আলোচিত হয়ে আসছে। এ ক্ষেত্রে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশে জ্বালানি সংকট দূর করার একটি প্রচেষ্টা। বাংলাদেশের রূপপুরে ২০০০ মেগাওয়াট সম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির পরিকল্পনা মাথায় রেখেই দু'দেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে জ্বালানি উৎপাদনের বিষয়টি দেশে-বিদেশে একটি বিতর্কিত বিষয়। কিন্তু সারাবিশ্বে জ্বালানির উৎস হিসেবে পারমাণবিক শক্তি বর্তমানেও প্রায় ১৩ শতাংশ, যা অত্যন্ত ব্যাপক। ফুকোশিমা কিংবা চেরনোবিল দুর্ঘটনা এ ধরনের বিতর্ককে নতুন মাত্রা দিয়ে থাকলেও জ্বালানির উৎস হিসেবে পারমাণবিক শক্তি এখনও অনেক গ্রহণযোগ্য। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য জ্বালানি বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আরও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে জ্বালানি সরবরাহ স্থিতিশীল ও গ্রহণযোগ্য মূল্যের মধ্যে রাখা। বিশ্বে প্রায় চার দশক ধরে পারমাণবিক শক্তি জ্বালানি হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয়ে আসছে। ফলে আজকের জাপানের কিংবা জার্মানির বাস্তবতা বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ বিষয়ে দু'দেশের সহযোগিতার ব্যাপারে যে চুক্তি হয়েছে এবং পারমাণবিক চুলি্ল নির্মাণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ার পরিবেশ ও নিরাপত্তাগত দিক থেকে রাশিয়ার যে ধরনের অংশগ্রহণের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে তাতে দু'দেশের জ্বালানি সহযোগিতার একটি বাস্তব প্রতিফলন আমরা ভবিষ্যতে লক্ষ্য করব।
আরেকটি আলোচনার বিষয়। সামরিক সহযোগিতার একটি বড় ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ৮ হাজার কোটি টাকার অস্ত্র কেনার একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। যার মাধ্যমে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় ঋণের আওতায় বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী প্রয়োজনীয় অস্ত্র ক্রয় করবে। বাংলাদেশের কোনো সুনির্দিষ্ট প্রতিরক্ষানীতি না থাকলেও এটি শান্তিপূর্ণ দেশ। দেশটি 'পসচার' বজায় রেখে চলে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশের ব্যাপক অংশগ্রহণ দেশটির শান্তিপূর্ণ প্রতিরক্ষানীতির বহিঃপ্রকাশ। ফলে দেশটির সামরিক শক্তি আধুনিকায়ন মূলত পুরনো অস্ত্র সরঞ্জামের পরিবর্তে নতুন সংযোজন মাত্র।
এটি তেমন কোনো মৌলিক সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে না, তারপরও এই অস্ত্র সরঞ্জাম ক্রয় বাংলাদেশের সামরিক শক্তির ব্যাপারে বহির্বিশ্বে, বিশেষ করে এ অঞ্চলে এক ধরনের সমীহ তৈরি করবে। যা দেশটির নিরাপত্তার জন্য সহায়ক হবে। তবে ক্রয় প্রক্রিয়াটি যথাসম্ভব স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে দু'দেশের সম্পর্ক বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। বিশেষ করে বর্তমান সরকারের আমলে রাশিয়ার সঙ্গে ব্যাপক বাণিজ্য সম্প্রসারণ ঘটছে। ২০০৩-০৫ সময়ে বাংলাদেশ-রাশিয়ার বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল মাত্র পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলার, যা ২০১১ সালে ৪০০ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। রাশিয়া এমন একটি দেশ যার সঙ্গে ওই অঞ্চলে সবগুলো দেশ বিভিন্ন ধরনের আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা দ্বারা ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন-বেলারুশের মধ্যকার কাস্টমস ইউনিয়ন বাংলাদেশের পণ্য রফতানির জন্য একটি নতুন বাজার হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। রাশিয়ার ঋণাত্মক জন্মহার বাংলাদেশের শ্রমবাজারের জন্যও একটি ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। রাশিয়ার সঙ্গে বিনিয়োগ ও প্রযুক্তির বিষয়ে ব্যাপক সহযোগিতার সুযোগ আছে। বিষয়গুলো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে প্রদত্ত বক্তৃতায় ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে। তাছাড়া রাশিয়ার কূটনীতিক এবং নীতিনির্ধারকদের বক্তব্যের মধ্যেও বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের অত্যন্ত ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা গেছে। এখানে লক্ষণীয়, রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ এশিয়ার সাম্প্রতিক উত্থান যা ভূ-অর্থনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিকভাবে দৃশ্যমান তা লক্ষ্য করে এসেছে। এই ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশে রাশিয়া বাংলাদেশকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে বিবেচনা করছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
জ্বালানি, সামরিক, অর্থনৈতিক বিবেচনার বাইরে যে বিষয়টি সবার মনে একটি বড় প্রশ্নের উদ্রেক করছে সেটি হচ্ছে, এ দু'দেশের সম্পর্ক শক্তিশালীকরণের কূটনৈতিক প্রভাব কী হতে পারে। বিশেষ করে ভারত-চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টিকে কীভাবে নিচ্ছে। সবার মনে বিষয়টি উঁকি দিচ্ছে। একটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশ বিশ্বের সব শক্তিশালী পক্ষের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ড. ইউনূস, শ্রমিক অধিকার এবং বাণিজ্য বিষয়ে কিছু টানাপড়েন থাকলেও দু'দেশের সম্পর্ক ব্যাপক ও গভীর। দু'দেশের মধ্যে নৌ-সহযোগিতা, সামরিক সংলাপ অতি সম্প্রতি সম্পর্কের গভীরতা আরও বাড়িয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়া সফর এবং উভয়ের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী পক্ষ হিসেবে রাশিয়াও বাংলাদেশের সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত হলো। ফলে বাংলাদেশের কূটনীতিতে রাশিয়াকে কেন্দ্র করে চীন কিংবা ভারত, কিংবা যুক্তরাষ্ট্র কোনো বিরোধ অথবা সংশয় সৃষ্টির সুযোগ নেই। আমরা যদি রাশিয়া, ভারত এবং চীনের সঙ্গে রাশিয়ার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের গভীরতা পর্যবেক্ষণ করি, তাহলে দেখা যাবে বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়ার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মাত্রা তাদের তুলনায় সীমিত। বিশ্বায়ন ও আত্মনির্ভরশীলতার যুগে বিভিন্ন রাষ্ট্র পারস্পরিক স্বার্থকে সামনে রেখে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলের মতাদর্শের সংকীর্ণতার ঊধর্ে্ব উঠে নিজেদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখছে। ফলে বাড়ছে বাণিজ্য, বাড়ছে বিনিয়োগ, বাড়ছে সাংস্কৃতিক বন্ধন। যার মাধ্যমে উন্নয়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে ইকোনমিক ডিপ্লোম্যাসি ও পূর্বমুখী নীতির কথা বলে এসেছে।
প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়া সফর এ বিষয়ে অগ্রগতির একটি মাইলফলক। তবে উৎকণ্ঠার বিষয় হচ্ছে, সফরটি এবং স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলো নিয়ে এক ধরনের রাজনীতি বাংলাদেশে শুরু হয়েছে, যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। পররাষ্ট্রনীতির বিষয়গুলোকে এভাবে সংকীর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় বিশ্লেষণ করে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করা মোটেও কাম্য নয়। বিষয়টিকে জাতীয় স্বার্থের নিরিখে এবং অতীতের স্টেরিওটাইপ মানসিকতা বর্জন করে দেখা উচিত। যে কোনো সিদ্ধান্তের কারিগরি দিক নিয়ে কিংবা বাস্তবায়নে দক্ষতা ও আন্তরিকতায় বিষয়গুলো প্রশ্ন করা যেতে পারে। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতিতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জাতীয় স্বার্থ এবং জাতীয় উন্নয়নে কাজে লাগানোর সুযোগ থেকে জাতিকে বঞ্চিত করার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ-রাশিয়া সম্পর্ক সত্যিকার অর্থে একটি নতুন মাত্রায় উপনীত হোক এটিই কাম্য।

অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.