নদীকৃত্য দিবস : জাতীয় নদী চাই by শেখ রোকন

আলতাব হোসেন, একরামুল হক শামীম, জায়েদ ইবনে আবুল ফজল, ফারহাত জাহান, মাহফুজুর রহমান মানিক রমাপ্রসাদ বাবু, শেখ রোকন, সাঈদ জুবেরী ও সিরাজুল ইসলাম আবেদ
প্রতিবছর ১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস (ইন্টারন্যাশনাল ডে অব অ্যাকশন ফর রিভারস) হিসেবে পালিত হয়। এ বছরও 'নদীর জন্য অনুপ্রাণিত হোন, সৃষ্টিশীল হোন, সক্রিয় হোন' প্রতিপাদ্য নিয়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে। ১৯৯৭ সালের মার্চে ব্রাজিলের কুরিতিবা শহরে অনুষ্ঠিত হওয়া একটি আন্তর্জাতিক সমাবেশ থেকে 'আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস' পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নদীর প্রতি দায়বদ্ধতা মনে করিয়ে দিতেই এই দিবসের সূচনা। ব্রাজিলের সেই সমাবেশে ২০টি দেশের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। মূলত বিভিন্ন দেশে বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা সেই সমাবেশে নিজেদের সংকট সমাধানের উপায় খুঁজতে একত্রিত হয়েছিলেন। তাইওয়ান, ব্রাজিল, চিলি, লেসেথো, আর্জেন্টিনা, থাইল্যান্ড, রাশিয়া, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও কিছু দেশের প্রতিনিধি নদীর প্রতি জবাবদিহি করার একটি দিবস পালনে একমত হন। বৃহৎ বাঁধের বিরুদ্ধে ব্রাজিলের একটি কর্মদিবসের (১৪ মার্চ) ঘোষণা আগে থেকেই ছিল। তাই ১৪ মার্চেই আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই দিবসের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো নদীতে বাঁধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া।
ইন্টারন্যাশনাল রিভারস নামের একটি সংগঠন আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস উদযাপনের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ২১টির বেশি দেশে ৪৮টি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ বছর আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস পালিত হচ্ছে। সৌভাগ্যের বিষয়, এই অল্পসংখ্যক দেশের তালিকায় বাংলাদেশও রয়েছে। রিভারাইন পিপল নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে গত বছর প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস পালিত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় এ বছরও রিভারাইন পিপল দিবসটি পালন করছে। এ উপলক্ষে আজ সোমবার বিকেল ৫টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরসি মজুমদার মিলনায়তনে নদীবিষয়ক সেমিনার ও বই প্রকাশনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। নদী বিষয়ে রিভারাইন পিপলের বর্ষপত্র 'নদী'র প্রকাশনা উৎসব হবে সেই অনুষ্ঠানে।
নদী আমাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। সাহিত্য, গান, নাটক, চলচ্চিত্রে নানাভাবে উঠে এসেছে নদীর প্রসঙ্গ। এত কিছুর পরেও আমাদের নদীগুলো মুমূর্ষু অবস্থায়। মানবসৃষ্ট কারণে নদীগুলো মৃতপ্রায়। প্রতি বছরই কমছে নদীর সংখ্যা। তাই 'আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস' আমাদের জন্য নদীর প্রতি জবাবদিহি করার দিবস। নদীর বহুমুখী সংকটের এ ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দিয়ে নদীকৃত্য দিবসকে সামনে রেখে আমাদের নদী রক্ষায় সচেষ্ট হতে হবে। নদীর সুস্বাস্থ্য রক্ষার বিষয়টি আজ সারাবিশ্বেই আলোচিত। নদীমাতৃক এই দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিষয়টি ভিন্ন পরিসরে আলোচনার দাবি রাখে। এখানে নদী মরে যাচ্ছে, হারিয়ে ফেলছে বর্ণময় রূপ। আমরা দেখেছি, স্বাধীনতার পর কম-বেশি ২০ হাজার কিলোমিটার নদীপথ হারিয়ে গেছে। এ অবস্থার দায় কি আমরা এড়াতে পারি?
এবারের 'আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস'কে সামনে রেখে আমরা যে দাবিটির দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই সেটি হলো জাতীয় নদীর দাবি। বাংলাদেশের একটি জাতীয় নদী থাকা উচিত বলে আমরা মনে করি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতীয় নদী রয়েছে। ভারত ২০০৯ সালে গঙ্গা নদীকে জাতীয় নদী ঘোষণা করে। এ ঘোষণার ফলাফল পরিলক্ষিত হয় যখন জাতীয় নদীর মর্যাদা রক্ষায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে পদক্ষেপ নেয় ভারত। অন্যদিকে পাকিস্তান সিন্ধু নদকে জাতীয় নদী ঘোষণা করে প্রতিবছর ২৪ জানুয়ারি সিন্ধু দিবস হিসেবে পালন করছে। যুক্তরাষ্ট্রে পাঁচটি প্রবাহকে জাতীয় নদী ঘোষণা করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যে রয়েছে 'ন্যাশনাল রিভারস অথরিটি'। প্রশ্ন উঠতে পারে, জাতীয় নদী ঘোষণার মাধ্যমেই কি নদী রক্ষা সম্ভব হবে? নদীর প্রতি সচেতন হওয়ার আরও অনেক উপায় রয়েছে, আরও অনেক কিছু করার রয়েছে। তবে জাতীয় নদীর ঘোষণা নদীর প্রতি আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করবে। নদী বিচ্ছিন্ন কোনো প্রবাহ নয়। একটি নদীর সঠিক প্রবাহের সঙ্গে আরও অনেকগুলো নদীর সংযোগ রয়েছে। জাতীয় নদীর ঘোষণা আসলে সামগ্রিকভাবে তা বাংলাদেশের সব নদীর প্রতিই মনোযোগ দেওয়ার মতো ব্যাপার হবে।
আমাদের নদীগুলোকে স্বাস্থ্যবান করতে হলে নানামুখী উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে। 'আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস'-এর মতো দিবসগুলোতে নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করা যেতে পারে। নদী সম্পর্কে নাগরিকদের যত বেশি সচেতন ও সংবেদনশীল করে তোলা যাবে আমাদের দেশের নদীর জন্য ততই তা উপকারী হবে। নদীর জন্য কিছু একটা করার মাধ্যমে নদীকৃত্য দিবস উদযাপনে যুক্ত হতে পারেন সবাই। নদী আমাদের অনেক কিছুই দিয়েছে। বিপরীতে আমরা নদীর প্রতি কিরূপ মনোভাব রাখছি কিংবা কিরূপ আচরণ করছি তার জবাবদিহিতা করার জন্য 'আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস'-এর চেয়ে ভালো দিন আর কোনটা হতে পারে?

লেখকবৃন্দ নদী বিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগ 'রিভারাইন পিপল'-এর সঙ্গে যুক্ত
riverine.people@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.