আদম বেপারিদের দিন শেষ, কম খরচে বিদেশে চাকরি- ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্রে নিবন্ধন

 মাঠপর্যায়ের ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্র মালয়েশিয়া সরকারের প্লান্টেশন খাতে বাংলাদেশ থেকে লোক নিয়োগের নিবন্ধন করায় এত কালের আদম বেপারিদের খপ্পর থেকে সাধারণ মানুষ রেহাই পেয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রেগ্রামের আওতায় এই প্রথম ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্রে (ইউআইএসসি) জনশক্তি রফতানির নিবন্ধন কাজ শুরু হওয়ায় সাধারণের মধ্যে অনেক আশঙ্কা দূর হয়েছে। তবে তথ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে কিছু ভুল-ত্রুটি ও কিছু বিড়ম্বনারও শিকার হতে হয়েছে নিবন্ধন করতে আসা লোকজনকে। বিশেষ করে দীর্ঘ সময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে অনেকের ধৈর্যচ্যুতিও ঘটেছে। সরকারীভাবে বলা হয়েছিল নিবন্ধন করতে প্রতিজনের ৫ মিনিটের বেশি সময় লাগবে না। সেখানে ধীরগতির ইন্টারনেটের কারণে প্রতিজনের ২০ থেকে ৩০ মিনিট পর্যন্ত সময় লেগেছে। তার ওপর ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্রে কম্পিউটারের সংখ্যাও কম। এর মধ্যেই বিদ্যুত চলে গেলে ডেক্সটপ কম্পিউটারের খুবই কম ব্যাকআপ থাকায় নিবন্ধন বন্ধ রাখতে হয়। এতে কালক্ষেপণ হয় বেশি। যেখানে জেনারেটরের ব্যবস্থা ছিল সেখানে তেমন অসুবিধা হয়নি। কমন অসুবিধা একটাই ধীর গতির ইন্টারনেট। এদিকে ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্রে নিয়মানুযায়ী যিনি যে সেবা নেবেন সে জন্য নির্দিষ্ট অঙ্কের ফি ধার্য করা আছে। এই ফি দিয়েই তথ্যসেবা কেন্দ্রর উদ্যোক্তাদের (যিনি কম্পিউটারে অন লাইনে কাজ করেন) বেতন-ভাতা আসে। মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে প্রতিজন নিবন্ধনের জন্য ৫০ টাকা ধার্য করা আছে। অভিযোগ পাওয়া যায় কোথাও এই অর্থের বেশি আদায় করা হয়। কয়েক এলাকায় দালালদেরও আধিপত্য ছিল। তবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাগণের কাছে অভিযোগ করা হলে তা বন্ধে দ্রুতই কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়। বগুড়ার ১২ উপজেলার ১০৮টি ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্রে ১৬ থেকে ১৮ জানুয়ারি এই তিন দিন সকাল ন’টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত একটানা নিবন্ধন করা হয়। মোট ৩১ হাজার ৪২২ জন নিবন্ধনকৃতদের লটারি অনুষ্ঠিত হয় ১৯ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। নিবন্ধনকৃতদের উপস্থিতিতেই লটারি কার্যক্রম পরিচালিত হয় কম্পিউটারের র‌্যান্ডম সিলেকশনের মাধ্যমে। এতে ৮৮৪ জন মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য নির্বাচিত হয়। সম্পূর্ণ স্বচ্ছতায় লটারি অনুষ্ঠিত হওয়ায় উপস্থিত সকলেই মহা খুশি। বগুড়ায় এই লটারির প্রথম ভাগ্যবান ব্যক্তি গাবতলি উপজেলার মহিষাবান ইউনিয়নের সুলতান মাহমুদ। বিজয়ী হওয়ার পর আনন্দের জোয়ার বয়ে আসে পুরো পরিবারে। তাঁর বাবা ইউনুস আলী বললেন, ছেলেকে বিদেশ পাঠানোর জন্য কত দেন দরবার করেছেন। আদম বেপারিরা লাখ টাকারও বেশি চেয়েছে। এখন তিনি এতটাই খুশি যে মাত্র ৪০ হাজার টাকায় বিমান ভাড়া স্বাস্থ্য পরীক্ষা প্রশিক্ষণ ফি অন্যান্য ব্যয় মেটাতে হবে। বাড়তি কোন খরচও নেই। টেনশনও নেই। সরকারের এমন কাজে এলাকার সকলেই খুশি। এমন খুশি আদমদীঘির আরিফুল ইসলাম, ধুনটের নদী ভাঙ্গনকবলিত ভা-ারবাড়ি ইউনিয়নের রবিউল ইসলাম, রোতিন্দ্র নাথ সরকার, জামিল হোসেন, যমুনার চালুয়াবাড়ি চরের মাসুম আহমেদ, হামিদুল। তাঁদের কথাÑ নিত্যবছর নদী ভাঙ্গনের থাবায় জমি-জিরাত হারাতে হয়। কোন রকমে ব্যবসা করে নৌকা বাইয়ে টিকে থাকা। যখন খবর এলো সরকার ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্রে বিদেশ যাওয়ার নাম নিবন্ধন করছে তখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছেন লাইনে দাঁড়িয়ে। লটারিতে যখন নাম উঠল তখন সকল কষ্ট দূর হয়ে গেছে। এখন টাকা সংগ্রহ করে মালয়েশিয়া গিয়ে কাজ করে দু’টো পয়সা রোজগার করে পরিবারকে সহযোগিতা করবেন। প্রথম পর্যায়ের এই নাম নিবন্ধনে বগুড়া অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি নিবন্ধিত হয় শিবগঞ্জ উপজেলায়। সেখানে সাড়ে ৪ হাজারেরও বেশি নাম নিবন্ধিত হয়। ময়দানহাঁটা ইউনিয়নের আনোয়ার মৃদু হেসে বললেন মালয়েশিয়া থেকে রোজগার করে পয়লা দফায় এসে বিয়ের পিঁড়িতেও বসবেন পছন্দের প্রেয়সীর সঙ্গে। জেলা প্রশাসনের জনশক্তিবিষয়ক কার্যালয় থেকে জানা গেল, বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় প্রতি দফায় ১০ হাজার করে তিন দফায় ৩০ হাজার জনশক্তি রফতানি হবে। কৃষি কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন গ্রামের তরুণদের পাঠানো হবে যাদের বয়স ১৮ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে। মালয়েশিয়ায় পাহাড়ী এলাকায় পাম গাছের বাগান ও রাবার বাগানে কাজ করতে আগ্রহী হতে হবে। এই বিষয়ে শিবগঞ্জের আটমূল ইউনিয়নের মিটন মিয়া বললেন, দেশে এর চেয়ে কত কঠিন কাজ করতে হয়। আর বিদেশে গিয়ে না খাটলে টাকা আসবে কোত্থেকে! বগুড়া অঞ্চলে নাম নিবন্ধনে তাড়াতাড়ি কাজ হয়েছে কাহালু উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নে। এই উপজেলার অনেক লোক বিদেশে থাকায় কিভাবে নিবন্ধন করতে হয় তা অনেকের জানা। আরেকটি ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্রের নিবন্ধনে এগিয়ে ছিল সেটা হলো আদমদীঘির কুন্দুগ্রাম। এই কেন্দ্রের উদ্যোক্তা সুরুজ মিয়া বললেন প্রথম দিনে ইউনিয়ন কোড পেতে কিছুটা দেরি হয়। দ্রুত কাজের জন্য তিনি উচ্চ ক্ষমতার মডেম ব্যবহার করেন নিজের উদ্যোগে। এতে তাঁর লাভ লোকজন জানল এই সেবাকেন্দ্রে দ্রুত কাজ হয়। যে কোন কাজে তাঁর কাছে লোকজন আসবে। এত কিছুর পরও দালালের উপদ্রব একটু ছিলই। যাদের বেশিরভাগই আদম বেপারিদের এজেন্ট। ওরা বুঝতে পেরেছে গ্রামের নিরীহ মানুষদের প্রতারণা করার দিন শেষ হয়ে এলো বলে। অন্যদিকে সারিয়াকান্দীর কাজলা ও সোনাতলার তেকানীচুকাইনগর ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্রে কারিগরি ত্রুটির কারণে প্রথম দিন নিবন্ধন করা যায় নি। লোকজন বলাবলি করে এভাবে বিদেশে লোক পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হলে অনেক মানুষ আদম বেপারির খপ্পর থেকে বেঁচে যাবে।

No comments

Powered by Blogger.