শতবর্ষের ক্যাথলিক মিশন- দুর্গাপুরের রানী খং গির্জার শতবর্ষ পূর্তি উসব আজ শুরু

প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি, গারো পাহাড়ের পাদদেশে সোমেশ্বরী নদীর দু'পাশে অবস্থিত কমরেড মণি সিংহের টঙ্ক আন্দোলনের ঐতিহাসিক এলাকা বৃহত্তর ময়মনসিংহের সুসঙ্গ দুর্গাপুর, যা বর্তমানে নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলা হিসেবে পরিচিত।
ভারত উপমহাদেশের অতি প্রাচীন জনপদ। এই ঐতিহাসিক এলাকার আর একটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা হচ্ছে রাণী খং ক্যাথলিক গীর্জা_ যা শুধু এলাকায় ধর্মপ্রচারই নয়, মানব সেবার এক অপুর্ব দৃষ্টানত্ম স্থপন করে চলেছে। এ গীর্জারই গৌরবময় শতবর্ষ পূর্তি উৎসব আজ শুক্রবার থেকে জমজমাট বর্ণাঢ্য আয়োজনে শুরম্ন হতে যাচ্ছে। ময়মনসিংহ শহর থেকে দূরত্ব ৬০ কি.মি.। নেত্রকোনা শহর থেকে ৪০ কি.মি.। বর্তমানে এতদঞ্চলের একমাত্র ভঙ্গুর রাসত্মায় বেশ কষ্টে মোটরসাইকেল, টেম্পু, ভটভটি, মাইক্রোবাস ও বাসে পেঁৗছানো যায় এখানে। সময় লাগে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। অনেক আগে থেকেই মুনি-ঋষি, আধ্যাত্মিক সাধক, ধর্মযাজকদের আগমনের মধ্য দিয়ে দুর্গাপুরে সভ্যতার সূচনা হয়। ঘটে প্রচার- প্রসার। এমনিভাবে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে মহামানব যীশু খ্রিস্ট ধর্মভক্ত (প্রোটেস্টিন) কয়েক যাজক গারো পাহাড়ের পাদদেশে দুর্গাপুরের আদিবাসী গারোদের মাঝে তাঁদের ধর্মবিশ্বাস প্রচারে আসেন। ১৮৫৩ সালে ময়মনসিংহে যীশুর বাণী পেঁৗছলেও দুর্গাপুরে প্রচার সূচনা হয় ১৮৯০ সালে। এই ধর্মবিশ্বাস প্রচারের মাত্র এক যুগ না যেতেই ঐ মহামানবের বাণী নিয়ে যাজকদের মধ্যে বিরোধ হয়। এদের এক পৰ দৃঢ়বিশ্বাসী আদিবাসী গারোদেরকে বিষয়টি জানিয়ে দেয়। এবং ঢাকায় খ্রিস্ট ধর্ম কেন্দ্রে যোগাযোগ করতে বলে। কথামতো স্থানীয় ৫ গারো নেতা দৃঢ়বিশ্বাসী উজির রম্নমার, জিরিং হাজং, থুদিং হাজং, খিমাংন দাংগ, সিন্ধু রোগা ঢাকায় গিয়ে বিশপ নিলে বর্ণ সিএসসির সঙ্গে দেখা করেন এবং দুর্গাপুরে একজন যাজক পাঠাতে অনুরোধ করেন। পর্যাপ্ত যাজক না থাকায় বিশপ নিলে বর্ণ তাৎৰণিক কাউকে পাঠাতে পারেননি। যাজক আসতে বিলম্ব হওয়ায় খ্রিস্ট ভক্ত ঐ ৫ গারো নেতা ফের ঢাকায় গিয়ে যাজক পাঠানোর আবেদন জানান। তখন বিশপ নিলে বর্ণ ফাদার এডলফ ফ্রান্সে (ফ্রান্সের নাগরিক) সিএসসি'কে দুর্গাপুরে পাঠান। ১৯০৯ সালে ফাদার এডলফ ফ্রান্সে সিএসসি দুর্গাপুরের টাউশাল পাড়া গ্রামে মিশন স্থাপন করেন। খ্রিস্টান ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাস প্রচার কাজ শুরম্ন করেন। ফাদার এডলফের নিরলস প্রচেষ্টায় অবহেলিত গারোদের মাঝে ভক্ত বিশ্বাসীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। প্রয়োজন হয় মিশন চত্বরের ব্যাপ্তি ঘটানোর। টাউশাল পাড়া মিশন চত্বরে প্রয়োজনীয় পরিমাণ জমি না পাওয়ায় মিশন স্থানানত্মরের চিনত্মা ভাবনা চলে। খোজা হতে থাকে সুবিধাজনক জমির। এরপর বামনপাড়া মঠগড় টিলায় জমি পছন্দ হয়। তাদের এখানে জমি পছন্দ হলেও সুসঙ্গ দুর্গাপুরের তৎকালীন জমিদার মিশন স্থাপনের জন্য দুর্গাপুর পৌর শহর থেকে ৭ কি.মি. দূরে সোমেশ্বরী তীরবতর্ী রানী খং টিলার জমি বন্দোবসত্ম দেন। জমি বন্দোবসত্ম পাওয়ার পরে ফাদার এডলফ ফ্রান্সের নেতৃত্বে ১৯১২ সালে মিশনটি রানী খং-এ স্থানানত্মর ঘটে। ১৯১৫ সালে রানী খং-এ যাজক ভবন (বর্তমানে পুরনো গির্জা) নির্মাণ করা হয়। তখন থেকেই দুর্গম দুর্গাপুরে খ্রিস্ট (ক্যাথলিক) ধর্মবিশ্বাসের জয়যাত্রা শুরম্ন। ১৯১৫ সাল থেকে এ পর্যনত্ম এখানে ৩৫ জনের মতো ফাদার সেবা দিতে আসেন। বর্তমানে এই রানী খং গির্জায় কর্মরত আছেন ফাদার শিমন হাচ্চা, ফাদার যোশেফ, ফাদার অঞ্জন আম্বিল, সিস্টার মিস্টাল মালা,্ এসএমআরএ, সিস্টার লিওভা এসএমআরএ, সিস্টার ইস্মাকুলেট এসএমআরএ, সিস্টার লুইজা এসএমআরএ, সিস্টার এমি এসএমআরএ প্রমুখ। ফাদার শিমন হাচ্চাকে রানী খং মিশন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি দৈনিক জনকণ্ঠকে জানান, এই ধর্মপলস্নীর অধীনে ৮ হাজার বিশ্বাসী ভক্ত আছেন। এই গির্জার অধীন ১ হাইস্কুল, ১৪ প্রাইমারী স্কুল, ১ ডিস্পেন্সারি, ১ বড় গির্জা ও ৪০টি ছোট গির্জা ঘর রয়েছে।
তিনি আরও জানান, আজ শুক্রবার থেকে আগামী রবিবার পর্যনত্ম ৩ দিনব্যাপী রানী খং গির্জায় শত বর্ষপূর্তি উৎসব উদ্্যাপন করা হবে। গির্জা শত বর্ষপূর্তি উপলৰে প্রথম ফাদার এডলফ ফ্রান্সে সিএসসি ও সেই ধর্মপ্রাণ ৫ গারো নেতার প্রতীকী ভাস্কর্যসহ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। শত বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান উদ্বোধনের দিন উন্মোচন করা হবে। স্মৃতিসৌধটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করতে আসবেন ইতালির রোমে অবস্থিত বিশ্ব বিসত্মার সংঘের সেক্রেটারি আর্চ বিশপ রবার্ট সারা। ঐ সময় তাঁর সঙ্গে থাকবেন ময়মনসিংহ ধর্ম প্রদেশের বিশপ পনের, পল কুরি সিএসসি। আসন্ন ঐ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ৬ ধর্ম প্রদেশের বিশপ, ভারতের বিভিন্ন স্থানের বিশপগণ উপস্থিত থাকবেন। আরও অনেকে আসবেন ইতালি, পোল্যান্ড, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপিন্স, কোরিয়া, ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে। শত বর্ষপূর্তি উপলৰে রানী খং গির্জায় প্রায় ১০ হাজার অতিথি ভক্তের সমাগম ঘটবে। উৎসব উপলৰে ময়মনসিংহ ধর্ম প্রদেশের ৪শ' ধর্ম প্রচারক এবং এক শ' বছর যাঁরা এখানে সেবা করেছেন (জীবিত অথবা মৃত) তাঁদের ক্রেস্ট দিয়ে সম্মানিত করা হবে। এছাড়াও সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট প্রমোদ মানখিন ও সুভাষ জেংসামসহ প্রায় ৬০ ব্যক্তিত্বকে সম্মাননা দেয়া হবে। এ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে ভারতের লোকসভার সাবেক স্পীকার পূর্ণ সাংমা ও তাঁর কন্যা ভারতের কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী অগাতা সাংমা উপস্থিত থাকতে পারেন বলে ফাদার সিমন হাচ্চা জানান।
_নিতাই সাহা, দুর্গাপুর

No comments

Powered by Blogger.