রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়- অচলাবস্থার অবসান প্রয়োজন

দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন মাত্রার অচলাবস্থা চলছে। কোথাও অচলাবস্থার মেঘ কিছুটা কেটেছে, কোথাও কাটেনি। এ অবস্থায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয়েছে অচলাবস্থা।
রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থার মূলসূত্র উপাচার্য অধ্যাপক ড. মু. আবদুল জলিল মিয়ার দুর্নীতি। দুর্নীতি যদি উপাচার্য করেই থাকেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সরকার রয়েছে। সে জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যাওয়ার কথা নয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মূল কাজ হচ্ছে পাঠদান-পাঠগ্রহণ। শ্রেণীকক্ষের বাইরে কখন শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামেন, সেটাও বিচার্য। সরকার যখন উপাচার্যের দুর্নীতির কোনো প্রতিকার করছে না, তখনই শুরু হয়েছে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ইতিহাস অনেক গৌরবের। যখনই যেখানে আন্দোলন হয়, তখনই পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথা শোনা যায়। তার পরও আন্দোলনের একটি ভালো দিক হচ্ছে যে বিষয়টিকে সরকারের আমলে নিতে অনেকটাই বাধ্য করে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে। এ আন্দোলন ঠেকাতে (অনুমান করা যায় উপাচার্যের হুকুমে) শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে উদ্দেশ করে অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনাও ঘটেছে। আন্দোলনকারীদের ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপ করা চরম ঘৃণ্য কাজ। এর বিচার হতে হবে। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যে আন্দোলন চলছে, তার যৌক্তিকতা যা-ই হোক না কেন, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করার মধ্য দিয়ে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর ক্ষতি হচ্ছে, তা কে পূরণ করবে? বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন হলেই যে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করতে হবে, তারও কোনো অর্থ নেই। উপাচার্য মহোদয় তো বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক। তিনি তো আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন। কয়েকটি মাইক বাজিয়ে তাঁর দুর্নীতির খবর পরিবেশন করে শিক্ষক-শিক্ষার্থী যদি অরাজকতা সৃষ্টি করেন, তাহলেও তো উপাচার্যের দায়িত্ব সেই অরাজক অবস্থা দূর করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। টানা ছয় দিনের আন্দোলনে তিনি এক দিনও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেননি। আলোচনা করলে হয়তো সমাধান হতে পারত।
যেহেতু উপাচার্য মহোদয় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কোনো আলোচনায় বসেননি, এমনকি এখন পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের আন্দোলনকে অযৌক্তিক প্রমাণ করতে পারেননি, তাই এই সমস্যা সমাধানে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে।
দিনের পর দিন অবস্থার আরও অবনতি হচ্ছে। দুটি পক্ষ এখন আন্দোলনে আছে। কয়েকটি পত্রিকায় ১৫ জানুয়ারি প্রকাশিত খবরে যা দেখা গেল, তা অত্যন্ত মর্মপীড়াদায়ক। উপাচার্য বিভিন্ন জায়গা থেকে লোক ভাড়া করে ট্রাকে করে এনে তাঁর পক্ষে মানববন্ধন করিয়েছেন। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীর একাংশ দিয়ে আন্দোলন করাচ্ছেন।
রাস্তায় কর্মসূচি পালন করতে না দিয়ে উপাচার্য ক্ষমতাসীন হয়ে থাকবেন কিংবা থাকা যায়, এ রকম তো নয়। তাহলে উপাচার্য তাঁর পক্ষে মানববন্ধন করে কী প্রমাণ করতে চাইছেন? আন্দোলনকারী যে দুজন শিক্ষক হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন কয়েক দিন ধরে, তাঁদের দেখতেও যাননি। বরং তিনি সংবাদ সম্মেলন করে আন্দোলনকারীদের জামায়াত-বিএনপি বলে আখ্যায়িত করছেন, যাঁদের নিয়োগ করেছেন তিনি নিজেই। উপাচার্য মহোদয়ের কথায় মনে হচ্ছে, আন্দোলনকারীরা জামায়াত-বিএনপি হলে তাঁদের হাসপাতালে দেখতে যাওয়া যাবে না, তাঁদের চোখে অ্যাসিড ছুড়ে দেওয়াটা ন্যায়সংগত এবং তাঁর দুর্নীতি নিয়ে কথা বলার অধিকার নেই। উপাচার্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে তাঁর দুর্নীতি নিয়ে। তিনি যদি কোনো বিষয়ে চ্যালেঞ্জ করতে চান, সেটা হওয়া উচিত ছিল তিনি দুর্নীতি করেন কি না, সেটা নিয়ে। এতে করে উপাচার্যের স্বচ্ছতার দিকটি বোঝা যেত। আন্দোলনকারীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবোধ রয়েছে, তাঁরা প্রগতিপন্থী। তাঁদের সম্পর্কে এত মিথ্যাচার করার মধ্য দিয়ে আসলে উপাচার্যের স্খলিত চরিত্র আরও বোঝা যায়। উপাচার্যকে একটি বিষয় অবশ্যই মনে রাখা প্রয়োজন যে তিনি মিথ্যাচার করলে, কোনো দুর্নীতি করলে শুধু মহাজোট সরকারের সম্মান ভূলুণ্ঠিত হয় না, গোটা জাতি অপমানিত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তা দূরীকরণে আশু পদক্ষেপ জরুরি। উপাচার্যের নামে যে অভিযোগগুলো উত্থাপিত হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তিনি প্রায় ডজন দুয়েক আত্মীয়স্বজন নিয়োগ দিয়েছেন। এসবের ক্ষেত্রে আইন-নিয়ম-যোগ্যতাও মানা হয়নি। এনআইডিএস নামের একটি শিক্ষা-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে তিনি অধিভুক্ত করেছেন, যার মালিকানা তাঁর নিজের। তিনি সিনেটের সভা আহ্বান করেন না, অবৈধ সিন্ডিকেট সদস্য রেখেছেন, এক বছর আগে বই কেনার টেন্ডার হলেও সে বই কেনেন না, হলে প্রাধ্যক্ষ-আবাসিক শিক্ষক নিয়োগ হলেও হলে শিক্ষার্থী থাকার ব্যবস্থা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অনুমোদিত পদের চেয়ে বহুসংখ্যক বেশি নিয়োগ দিয়েছেন। যাঁদের বেতন দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে গ্রহণ করা বিভিন্ন খাতের টাকা থেকে। জনশ্রুতি আছে, এসব নিয়োগে প্রচুর অর্থের লেনদেন হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের কাছে উপাচার্য প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে শিক্ষার্থীরা আর তাঁকে বিশ্বাসও করতে চায় না। যদি আন্দোলনকারীদের আন্দোলন অযৌক্তিক হয়, তারও যেমন ব্যাখ্যা প্রয়োজন, তেমনি যাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে, তাঁর সত্যতাও নিরূপণ করা জরুরি। উত্তর জনপদের অনেক স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয় এটি। এখানকার শিক্ষার্থীর মধ্যে অধিকাংশই রংপুর অঞ্চলের। এখানে এমনিতেই আর্থসামাজিক অবস্থা ভালো নয়। বাবা-ভাইয়ের ঘাম ঝরানো অর্থ, মায়ের পোষা গাভির দুধ বিক্রি করা অর্থ, হাঁস-মুরগির ডিম বিক্রি করা অর্থ দিয়ে এখানে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করে। এখানকার অনেক শিক্ষার্থী তিন বেলা না খেয়েও পড়ালেখা করে। তাদের এক দিন নষ্ট হওয়া মানে অনেক শ্রমজীবী অভিভাবকের কষ্ট দীর্ঘ করা। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা অত্যন্ত জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয় খুললে যাতে আবার আন্দোলন শুরু না হয়, সে জন্য সরকারের পদক্ষেপ জরুরি। উপাচার্য যদি অন্যায় করে থাকেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধেও যেমন আইনি ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, তেমনি যদি আন্দোলনকারীরা অন্যায় করে থাকেন, তাঁদেরও নিবৃত্ত হওয়া প্রয়োজন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শেখা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে শেখাটাও তো শিক্ষার অংশ। সেই শিক্ষাও যদি শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়ে থাকেন, সেটাও জীবনের অনেক বড় অর্জন।
লেখকেরা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক।

No comments

Powered by Blogger.