বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সরকার কি নির্লিপ্তই থাকবে?

বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে মুক্তবুদ্ধি চর্চার অবাধ ক্ষেত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা অর্থবিত্তে সমৃদ্ধ নয়। তারপরও অনেক মেধাবী অর্থবিত্তের চাকরিতে না গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতাকে বেছে নেন। তার অন্যতম কারণ হচ্ছে, এখানে স্বাধীন মত প্রকাশ করা যায়, গবেষণা করা যায়।
নিজেদের সুন্দর, সৎ এবং দেশ-জাতির সেবার স্বপ্নগুলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে রোপণ করা যায়। কিন্তু সেই চরিত্রকে হনন করা হয়েছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিক্ষাবান্ধব নন। তিনি শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে সহায়ক নন। একজন উপাচার্য হবেন নক্ষত্রের মতো। তিনি আলো বিকিরণ করবেন। কিন্তু বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তেমনটি হলেন না। বিশালাকার অন্ধকারের অন্য নাম প্রফেসর ড. মু. আবদুুল জলিল মিয়া। তার সম্পর্কে গণমাধ্যমগুলোতে এত বেশি দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, তার পরিমাণ এখন কয়েকশ' পৃষ্ঠা। দেশের অন্য কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো উপাচার্য এত বেশি দুর্নীতি-অনিয়ম-পারিবারিকীকরণ করেছেন কি-না বা মুক্তবুদ্ধি চর্র্চাকেদ্রে এত বেশি স্বৈরাচারী হয়েছেন কি-না, আমাদের জানা নেই। তবুও সরকার নীরব। সরকারের এই নীরবতার সুযোগ নিয়ে তিনি তার দুর্নীতির পৃথিবীকে সম্প্র্রসারণ করেছেন। একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে খাস তালুকে পরিণত করেছেন।
গত ৫ জানুয়ারি থেকে তার দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছেন। অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে এ আন্দোলন চলছিল। উপাচার্য মহোদয় আন্দোলন রোধ করতে বহিরাগতদের নিয়ে এসে কোনো কোনো দিন মিছিল করিয়েছেন। ১০ জানুয়ারি ২০১৩ তারিখের ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। যারা আন্দোলন করছিলেন, তারা দুর্নীতিবিরোধী মঞ্চের পরিচয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের দক্ষিণ ফটক থেকে আন্দোলন করছিলেন। ১০ তারিখ সকালে ছাত্রলীগের নামধারী (ভিসি লীগ) কয়েকজন এবং বহিরাগতরা দুর্নীতিবিরোধী মঞ্চে ছাত্রলীগের একটি ব্যানার ঝুলিয়ে দেয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যাবর্তন দিবস উদ্যাপন করার লক্ষ্যে ছাত্রলীগ নামধারীরা দুর্নীতিবিরোধী মঞ্চের স্থানটি দখল করে নেয়। এ মঞ্চের আন্দোলনকারীরা বিবাদে না গিয়ে অন্য একটি স্থানে সমবেত হওয়ার জন্য মাইকে ঘোষণা দিতে থাকেন। এমন সময় ভিসির কয়েকজন পেটোয়া এবং বহিরাগতরা আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণ করে। প্রথমে তারা মাইকের সংযোগ খুলে দিয়ে মাইক ভাংচুর করে, অ্যামপ্লিফায়ার ভাঙে এবং ব্যাটারির এসিড শিক্ষকদের উদ্দেশে ছুড়ে দেয়। তাতে দু'জন শিক্ষকের চোখ এসিডদগ্ধ হয়।
এই এসিড ছুড়ে দেওয়ার পেছনে প্রথমত অপরাধী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচর্য স্বয়ং। ৯ জানুয়ারি রাতে বিভিন্ন সূত্রে আন্দোলনকারীরা জানতে পারেন, আন্দোলনে বহিরাগতদের দিয়ে হামলা করা হতে পারে। তখন আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির কাছে বিষয়টি লিখিতভাবে অবহিত করেন। এরপর তারা বিষয়টি ক্যাম্পাসের ফাঁড়ির দায়িত্বশীল পুলিশের কাছে লিখিতভাবে জানান। যখন সন্ত্রাসীরা এসিড ছুড়ে দেয় তখন প্রক্টরিয়াল বডির তিনজন সদস্য সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পুলিশ নির্দেশ না পেলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের বের করে দিতে পারে না। বিষয়টি স্টম্ফটিক সত্য যে, প্রক্টরিয়াল বডির সহযোগিতায় বহিরাগত এবং ভিসির পেটোয়াদের দিয়ে ইতিহাসের এই ন্যক্কারজনক ঘটনাটি ঘটানো হয়। উপাচার্যকে দায়ী করছি এ কারণে যে, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন বহিরাগতমুক্ত করলেন না? বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমাহীন দুর্নীতি করলেন উপাচার্য। বহিরাগত এনে তিনিই সন্ত্রাসী কাজে মদদ দিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করলেন তিনিই। এসব কাজের মধ্যে তিনি শুধু নিজেরটুকুই দেখলেন।
বর্তমানে তিনি আরও ঘৃণ্য কাজে লিপ্ত হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করার পর শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা শহরে স্মরণকালের দীর্ঘ মানববন্ধন করেন তার পদত্যাগ দাবিতে। উপাচার্য তখন ভাড়া করা লোক দিয়ে 'মানববন্ধন' করান। তিনি লোক নিয়ে আসেন ট্রাকে করে বিভিন্ন এলাকা থেকে। লোক ভাড়া করেন বস্তি থেকে। বেশ কয়েকটি পত্রিকায় এসব খবর পরিবেশিত হয়েছে। উপাচার্য কতখানি অমানবিক হতে পারেন, তা বলে শেষ করা যাবে না। তিনি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক। সারাদেশ যখন এসিডে আক্রান্ত দু'জন শিক্ষকের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করছে, রংপুরের সর্বস্তরের মানুষ যখন তাদের প্রতি সহানুভূতি জ্ঞাপন করছেন, তখন উপাচার্য সংবাদ সম্মেলন করে বলছেন যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করার জন্য আক্রান্ত শিক্ষকরা কাজ করছিলেন। আমরা জানি, একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধে এ দেশের যারা বিরোধিতা করেছিল, তার রাজাকার। তারা এদেশের শত্রু। আর বর্তমানে যারা দুর্নীতি-অনিয়ম করছেন, তারাও এদেশের শত্রু। তারা হচ্ছেন একালের রাজাকার। বর্তমান উপাচার্য একবারও রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসিড আক্রান্তদের দেখতে যাননি। তার নামে যখন ক্যাম্পাসে মাইক বাজিয়ে তার দুর্নীতির শ্বেতপত্র পাঠ করা হচ্ছিল, তখনও তিনি সেখানে গিয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। তিনি আন্দোলনকারীদের মুখোমুখি হওয়ার নৈতিক সাহসটুকুও হারিয়েছেন। শুধু তাই নয়; তার নামে দুর্নীতির যে দীর্ঘ ফিরিস্তি রয়েছে, তাতে তার আর নীতিবাক্য উচ্চারণের অধিকার থাকে না।
উপাচার্য শুধু নিজেই দুর্নীতি করেছেন_ তা-ই নয়; তিনি বাঙালির ইতিহাসে দু'জন গুণী মানুষকেও অপমানিত করেছেন। যে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন সারাজীবন মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন এবং বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গঠনের চেষ্টা করেছেন, সেই মানুষটির নামে প্রতিষ্ঠিত হওয়া বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান তিনি ধুলার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন। অন্য এক ব্যক্তি হচ্ছেন ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া, যিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা সত্ত্বেও ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি কোনোদিন। সেই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরমাণুবিজ্ঞানীর নামে একটি ইনস্টিটিউট খুলে সেখানে শুধু তার মেয়ে, ভাগি্নসহ কয়েকজন আত্মীয়ের কর্মসংস্থান করেছেন। সেখানে গবেষণার কোনো পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে তিনি কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। উপাচার্য প্রফেসর ড. মু. আবদুুল জলিল মিয়ার যে পদত্যাগের দাবি উচ্চারিত হচ্ছে, তার যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করে তাকে শুধু অব্যাহতি দেওয়া নয়, বরং তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থাও করা প্রয়োজন। তাতে বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে_ এটা আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।

ড. আরএম হাফিজুর রহমান, উমর ফারুক, শিক্ষক এবং কায়সার আলম জামিল সারোয়ার ও সাদিয়া কবীর শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া
বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

No comments

Powered by Blogger.