আবুলকে আসামি করার মতো তথ্য মিলেছে ॥ প্যানেলকে দুদকের চিঠি- পদ্মা সেতু ॥ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের উত্তর পাওয়া যাবে by মহিউদ্দিন আহমেদ

 সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে আসামি করার মতো কিছু তথ্য পাওয়া গেছে উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
তবে এক্ষেত্রে অভিযোগের পক্ষে বিশ্বব্যাংক যেসব তথ্য দুদকে পাঠিয়েছে তা আদালতে উপস্থাপনের অনুমতি দিতে হবে এবং কানাডা থেকে রমেশের ডায়েরির অনুলিপি সংগ্রহ করতে প্যানেলের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, রবিবার শেষ বিকেলে প্যানেলের তিন সদস্যের কাছে আলাদা আলাদাভাবে ই-মেইলের মাধ্যমে চলতি মাসের নয় তারিখে দুদককে দেয়া চিঠির সুস্পষ্ট এবং সুবিন্যস্ত জবাব পাঠনো হয়। আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্যানেল থেকে জবাব পাওয়া যাবে বলেও জানায় ওই সূত্র।
চিঠিতে মামলার এজাহারে কেন আবুল হোসেনকে আসামি করা যায়নি তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হয়, অভিযোগ অনুসন্ধান পর্যায়ে দুদককে দেয়া বিশ্ববাংকের প্যানেলের তথ্য মামলায় এভিডেন্স হিসেবে ব্যবহার করার নির্দেশ না দেয়া, কানাডিয়ান পুলিশের কাছে থাকা রমেশের ডায়েরির অনুলিপি না পাওয়া এবং কিছু আইনী সীমাবদ্ধতার কারণে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসানকে আসামি করা যায়নি। তবে মামলাপরবর্তী তদন্ত পর্যায়ে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে তদন্তাধীন অবস্থায় পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে সন্দেহভাজনদের আসামি করার সুযোগ রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের ৯ জানুয়ারি দেয়া চিঠির জবাব তৈরি করে রবিবার সকালে তদন্ত টিম কমিশনের কাছে জমা দেয়। কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান, কমিশনার এম বদিউজ্জামান, মোঃ সাহাবুদ্দীন চুপ্পু, আইন উপদেষ্টা এ্যাডভোকেট আনিসুল হক যাচাই-বাছাই করেন। তদন্ত কর্মকর্তারা রবিবার শেষ বিকেলে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রধান আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সাবেক প্রধান লুই গ্যাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পো, হংকংয়ের দুর্নীতিবিরোধী স্বাধীন কমিশনার টিমোথি টং এবং যুক্তরাজ্যের দুর্নীতি দমন কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক রিচার্ড ওয়াল্ডারম্যানের কাছে তা প্রেরণ করেন। দুপুরের দিকে দুদক কার্যালয় থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের আনিসুল হক বলেন, আমরা চিঠির উত্তর তৈরি করেছি। প্যানেল চিঠিতে যা যা জানতে চেয়েছে, তার সব উত্তর দুদকের চিঠিতে রয়েছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এ চিঠি চলে যাবে।
সন্ধ্যায় দুদক চেয়ারম্যানের কাছে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে চান গণমাধ্যম কর্মীরা। এ সময় তিনি বলেন, তখন পর্যন্ত (রবিবার সন্ধ্যায়) তিনি কোন চিঠিতে স্বাক্ষর করেননি। তবে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে তাঁরা প্যানেলের চিঠির জাবাব দেবেন। শীঘ্রই জবাব দেয়া হবে বলে জানান তিনি।
চিঠিতে কী থাকছে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দুদক থেকে কিছু না বললেও নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জনকণ্ঠকে বলে, প্যানেলের প্রেরিত চিঠির পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে সৈয়দ আবুল হোসেনকে কেন তদন্ত পর্যায়ে আসামি করা হয়নি সে বিষয়টি বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তদন্ত পর্যায়ে তাঁকে আসামি করার মতো ইতোমধ্যে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। এর সঙ্গে রমেশের ডায়েরির অনুলিপি এবং বিশ্বব্যাংকের প্রেরণ করা পূর্বের তথ্য মামলায় এভিডেন্স হিসেবে ব্যবহার করতে দিলে তদন্তে সন্দেহভাজনদের আসামি করতে আইনী বাধা থাকবে না বলেও আশ্বস্ত করা হয়। মামলাপরবর্তী সময়ে প্রধান আসামি সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া, কাজী ফেরদাউসকে গ্রেফতারপরবর্তী রিমান্ড এবং জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। চিঠিতে জানানো হয়েছে সেতু ভবনে অভিযান চালিয়ে মোশররফের কম্পিউটার জব্দ এবং প্রকল্প সংক্রান্ত নথিপত্র জব্দ করার বিষয়টি। দুদকের তৈরি চিঠিতে বিশ্বব্যাংকের প্রশ্নের উত্তরের পাশাপাশি বাংলাদেশের আইন, দুদক আইন, জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্য উঠে এসেছে।
এদিকে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় বাড়ানো হয়েছে। রবিবার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের (সিএমএম) আদালতে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য ছিল। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশন কোন প্রতিবেদন না পাঠালে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তারেক মঈনুল ইসলাম আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি ফের প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য করেন। গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর সাবেক সেতু সচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়াসহ সাতজনের বিরুদ্ধে রাজধানীর বনানী থানায় মামলাটি করেন দুদকের জ্যেষ্ঠ উপ-পরিচালক আব্দুল্লাহ আল জাহিদ।
মামলার অপর আসামিরা হলেন- সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগে দরপত্র মূল্যায়নে গঠিত কমিটির সদস্য সচিব কাজী ফেরদাউস, সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী রিয়াজ আহমেদ জাবের, এসএনসি-লাভালিনের স্থানীয় এজেন্ট মোস্তফা ও এর ৩ কর্মকর্তা সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস, আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ সাহা ও সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইল। গত ৩ জানুয়ারি মামলার প্রধান আসামি সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া ও সেতু বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৗশলী (নদী শাসন) কাজী ফেরদাউসকে ৭ দিনের রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়। তাঁরা বর্তমানে কারাগারে আছেন।
আবুল হোসেনের বক্তব্য ॥ কোন যুক্তি বা কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুর্নীতির ঘটনার সঙ্গে যে কোনভাবে তাঁকে যুক্ত করার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ করেছেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এমপি। গত ১৫ জানুয়ারি দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানকে লেখা বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল চেয়ারম্যান লুই মোরেনো ওকাম্পোর চিঠির বক্তব্যের বিষয়ে রবিবার এক বিবৃতিতে এ অভিযোগ করেন তিনি। সৈয়দ আবুল হোসেন তাঁর বিবৃতিতে দাবি করেন, ‘পত্রিকায় প্রকাশিত প্যানেল চেয়ারম্যানের চিঠির (চিঠি যদি সত্য হয়) প্রতিটি বক্তব্য পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, মন্ত্রী হিসেবে শুধু আমার নামটি অভিযোগে অন্তর্ভুক্ত করলেই পদ্মা সেতুর নির্মাণের সকল অন্তরায় দূর হবে। কোন যুক্তি নয়, কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ নয়, ঘটনার সঙ্গে যে কোনভাবে আমাকে যুক্ত করতে হবে। তাহলে বিশ্বব্যাংক খুশি হবে। আর বিশ্বব্যাংক খুশি হলেই পদ্মা সেতুর কার্যক্রম শুরু করা যাবে। প্যানেল চেয়ারম্যানের এ ধরনের মনোভাব একটি আন্তর্জাতিক নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ দলের পক্ষে কোনভাবেই যৌক্তিক নয় এবং তার চিঠির বক্তব্যকে অসার ও উদ্দেশ্যমূলক বলেও মন্তব্য করেন সাবেক এ মন্ত্রী। আবুল হোসেন তাঁর বিবৃতিতে বলেন, মন্ত্রী হিসেবে আমার নামে প্যানেলের অভিযোগ ৫টি। প্রথমত এসএনসি-লাভালিনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমি দেখা করেছি। দ্বিতীয়ত এসএনসি-লাভালিনের স্থানীয় প্রতিনিধি প্রেরিত ই-মেইলে সচিবের বরাত দিয়ে ‘বড় কর্মকর্তা’র ইচ্ছে সংক্রান্ত বিষয়বস্তু সংযুক্ত থাকা। তৃতীয়ত রমেশ শাহের ডায়েরিতে ‘পিসিসি কস্ট’ হিসেবে লেখা আমার নাম ও পার্সেন্টেজের পরিমাণ সংযুক্ত থাকা। চতুর্থত পরামর্শক নিয়োগে খোলা দরপত্রে প্রাথমিকভাবে ২য় অবস্থান থেকে এসএনসি-লাভালিনের প্রথম অবস্থানে উঠে আসা। পঞ্চমত মন্ত্রী চূড়ান্ত অনুমোদনকারী বলে সকল দায়িত্ব মন্ত্রীর ওপর বর্তায়।
কয়েকটি পৃথক পৃথক অসামঞ্জস্যপূর্ণ ঘটনাকে একীভূত করে কল্পনাপ্রসূত ও মনগড়া একটি অভিযোগ উত্থাপন করে নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চেয়ারম্যানের আমাকে জড়িত করার বিষয়টি বোধগম্য নয়। প্যানেল চেয়ারম্যানের চিঠির বক্তব্য যে অসার ও উদ্দেশ্যমূলক তা সহজেই বোঝা যায়।
এসব অভিযোগের বিষয়ে আবুল হোসেনের ব্যাখ্যা হচ্ছে, প্রথমত আমি এসএনসি-লাভালিনের কোন প্রতিনিধির সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে বা গোপনীয়ভাবে কখনও দেখা করিনি। শুধু সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীর অনুরোধে এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সেতু বিভাগের সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তার উপস্থিতিতে সৌজন্যমূলক কথা বলেছি। এসএনসি-লাভালিন ছাড়াও এ কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, সংশ্লিষ্ট দেশের রাষ্ট্রদূতসহ অনেকের সঙ্গে আমার অফিস কক্ষে সাক্ষাত হয়েছে- যা আমার দাফতরিক কাজেরই একটি অংশ ছিল। দ্বিতীয়ত স্থানীয় প্রতিনিধির এসএনসি-লাভালিনের সদর দফতরে পাঠানো ই-মেইলের বিষয়বস্তুতে যদি আমার নামে কিছু উল্লেখ থাকে সংশ্লিষ্ট সকলের কাছ থেকে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করার কথা বলেন তিনি।
তৃতীয়ত রমেশ শাহের ডায়েরিতে লেখা ‘পিসিসি কস্ট’ যার কোন অনুলিপি এখনও পাওয়া যায়নি। যার ডায়েরিতে ‘পিসিসি কস্ট’ হিসেবে আমার নামে পার্সেন্টেজের কথা লেখা আছে বলে অভিযোগ আছে সে বিষয়ে কথিত ডায়েরির কপি, রমেশ শাহের বক্তব্য ও প্রকৃত তথ্য উদ্ঘাটন করা হলে এ ব্যাপারে তাঁকে দায়ী করার কোন উপাদান পাওয়া যাবে না বলে তিনি দাবি করেন। চতুর্থত এসএনসি-লাভালিনের দ্বিতীয় অবস্থান থেকে প্রথমে উঠে আসার ক্ষেত্রে তাঁর কোন ভূমিকাই ছিল না।
বিবৃতিতে আবুল হোসেন আরও দাবি করেন পঞ্চমত চুক্তি অনুমোদনের ক্ষেত্রে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী কোনভাবেই সর্বোচ্চ অনুমোদন দাতা নন।
তিনি আরও বলেন, মূল্যায়ন কমিটির কোন সদস্যের কাছে কোন প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে কোন তদ্বির করেননি। তিনি তদ্বির করেছেন- এ কথা মূল্যায়ন কমিটির কোন সদস্য বলেননি, বলতেও পারবেন না।

No comments

Powered by Blogger.