বাচ্চু রাজাকার খুনি, ধর্ষক ও অপহরণকারী by জাকিয়া আহমেদ

বাচ্চু রাজাকার আর অভিযুক্ত নন, দোষী সাব্যস্ত হওয়া একজন খুনি, ধর্ষক ও অপহরণকারী। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো এখন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ১২ জনকে হত্যা, তিন নারীকে ধর্ষণ ও একজনকে অপহরণ করে নির্যাতনের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারকে।
১৯৭১ সালের ১৪ মে ফরিদপুরের বোয়ালমারী থানার কলারন গ্রামের জমিদার সুধাংশু মোহন রায়কে পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করেন আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার। এর দুইদিন পরে ১৬ মে বাচ্চু রাজাকার সালথা থানার (সাবেক নগরকান্দা) পুরুরা নমপাড়া গ্রামের মাধবচন্দ্র বিশ্বাসকে গুলি করে হত্যা করেন। পরের দিন ১৭ মে আযাদ ৩০-৩৫ জন রাজাকারকে নিয়ে বোয়ালমারীর হাসামদিয়া গ্রামের হিন্দুপাড়ায় নির্বিচারে গুলি ছুড়ে ঘটনাস্থলে ৭ জনকে ও ধরে নিয়ে গিয়ে পরে গুলি করে আরও দুইজনকে হত্যা করেন তিনি। এরপর ৩ জুন সালথা থানার ফুলবাড়িয়া গ্রামের হিন্দুপাড়ায় লুটপাট শেষে গুলি করে হত্যা করেন চিত্তরঞ্জন দাসকে।

এছাড়া বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে ধর্ষণের অভিযোগও। ৮ জুন বাচ্চু রাজাকার ও তার চার-পাঁচজন সহযোগী বোয়ালমারীর নতিবদিয়া গ্রামের এক হিন্দু বাড়িতে দুই নারীকে গণধর্ষণ করেন। এর আগে ১৮ মে সালথা থানার উজিরপুর বাজারপাড়া গ্রামের এক সংখ্যালঘু তরুণীকে অপহরণ করে আটকে রেখে নির্যাতন করেন।

এছাড়া একাত্তরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ফরিদপুর শহরের খাবাশপুর থেকে রণজিৎ নাথ ওরফে বাবুনাথকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রথম রায় ঘোষণা করা হলো। ২১ জানুয়ারি সোমবার সকাল পৌনে বারোটায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এই রায় ঘোষণা করেন।

ট্রাইব্যুনাল ২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন এই ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মজিবুর রহমান মিঞা ও বিচারক শাহিনুর ইসলাম।

প্রায় ১ ঘন্টা ব্যাপী ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে ১১২ পৃষ্ঠার রায় পড়ে শোনান।

বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে মোট ১০ টি অভিযোগ আনা হলে ৮ টি অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনাল তার আদেশে বলেন, হত্যা, গণহত্যা, র্ধষণ এবং এ ধরনের কাজে সহযোগিতার জন্য আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস অ্যাক্ট, ৭৩ অনুসারে আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হলো।

রায়ে ট্রাইব্যুনাল আরও বলেন, বাচ্চুর বিরুদ্ধে তৃতীয়, চর্তুথ, ষষ্ঠ এবং সপ্তম অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে প্রথম, পঞ্চম ও অষ্টম অভিযোগও প্রমাণিত হয়েছে। তবে ইতোমধ্যেই তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার কারণে এসব অভিযোগে তাকে আর আলাদা করে কারাদণ্ড দেওয়া হচ্ছে না।

দ্বিতীয় অভিযোগটি প্রমাণিত হয়নি। তাই দ্বিতীয় অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

আযাদের বিরুদ্ধে আট অভিযোগ:

প্রথম অভিযোগ, একাত্তরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে আযাদ ও তার সহযোগীরা ফরিদপুর শহরের খাবাশপুর থেকে রণজিৎ নাথ ওরফে বাবুনাথকে ধরে নির্যাতন করেন। তবে রাত দুইটা-আডাইটার দিকে তিনি পালাতে সক্ষম হন। এই অভিযোগের ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনাল বাচ্চুকে অপহরণ, আটক রাখা এবং নির্যাতনের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে তাকে আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট ৭৩ এর ৩ (২) ধারায় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করেন।

দ্বিতীয় অভিযোগ, ২৬ জুলাই আলফাডাঙ্গা থেকে আবু ইউসুফ পাখিকে ধরে এনে ফরিদপুর স্টেডিয়ামে আটক রাখা হয়। আজাদ পাকিস্তানি মেজর আকরামের সঙ্গে আলোচনা করে পাখিকে আটক রাখেন এবং অমানবিক নির্যাতন করেন। শুধু এই একটি অভিযোগ প্রমাণিত হয় নি বলে রায়ে বলেন ট্রাইব্যুনাল এবং তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেন।

তৃতীয় অভিযোগ, ১৪ মে আযাদ ফরিদপুরের বোয়ালমারী থানার কলারন গ্রামের জমিদার সুধাংশু মোহন রায় ও তাঁর বড় ছেলে মণিময় রায়কে বাড়ির পাশের রাস্তায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বাড়ি ফিরতে বলেন। তাঁরা বাড়ির দিকে রওনা হলে আজাদ পেছন থেকে রাইফেল দিয়ে গুলি করেন। এতে সুধাংশু নিহত ও মণিময় গুরুতর আহত হন। এই অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল বাচ্চুকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন।

চতুর্থ অভিযোগ, ১৬ মে আযাদ রাজাকারদের নিয়ে সালথা থানার (সাবেক নগরকান্দা) পুরুরা নমপাড়া     গ্রামের মাধবচন্দ্র বিশ্বাসের বাড়িতে লুটপাট করেন। মাধবকে বাড়ি থেকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে আযাদ গুলি করে হত্যা করেন। অভিযোগ প্রমানিত হওয়ায় এই অভিযোগেও তাকে মৃত্যুদন্ড দেন ট্রাইব্যুনাল।

পঞ্চম অভিযোগ, ৮ জুন আযাদ ও তাঁর চার-পাঁচজন সহযোগী বোয়ালমারীর নতিবদিয়া গ্রামের এক হিন্দু বাড়িতে দুই নারীকে গণধর্ষণ করেন। এই অভিযোগও সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হয়েছে বলে রায়ে বলেন ট্রাইব্যুনাল।

ষষ্ঠ অভিযোগ, ৩ জুন আযাদ ও তাঁর সহযোগীরা সালথা থানার ফুলবাড়িয়া গ্রামের হিন্দুপাড়ায় লুটপাট শেষে চিত্তরঞ্জন দাসকে গুলি করে হত্যা করেন। এই অভিযোগও প্রমাণিত হওয়ায় তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল।

সপ্তম অভিযোগ, ১৭ মে আযাদ ৩০-৩৫ জন রাজাকারকে নিয়ে বোয়ালমারীর হাসামদিয়া গ্রামের হিন্দুপাড়ায় নির্বিচারে গুলি ছুড়লে শরৎচন্দ্র পোদ্দার, সুরেশ পোদ্দার, শ্যামাপদ পোদ্দার, যতীন্দ্র মোহন সাহা, নীল রতন সমাদ্দার, সুবল কয়াল ও মল্লিক চক্রবর্তীকে হত্যা করেন। সেখান থেকে হরিপদ সাহা ও প্রবীর কুমার সাহা ওরফে পুইট্যাকে অপহরণ করে ময়েনদিয়া বাজারে নদীর ঘাটে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেন। এই অভিযোগও সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

অষ্টম অভিযোগ, ১৮ মে আযাদ সাত-আটজন রাজাকারকে নিয়ে সালথা থানার উজিরপুর বাজারপাড়া গ্রামের এক সংখ্যালঘু তরুণীকে অপহরণ করে খাড়দিয়া গ্রামের চান কাজীর বাড়িতে আটকে রেখে নির্যাতন করেন। সাত-আট দিন পর ওই তরুণী মুক্তি পান। এই অভিযোগও প্রমাণিত হয় আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে।

No comments

Powered by Blogger.