দেখা হয়েছে চক্ষু মেলিয়া by রাশেদুল বারী

আমাদের দেশে ভ্রমণবিষয়ক বই পাওয়া খুব দুষ্কর। কারণ খুব সহজ, ভ্রমণ কাহিনীর লেখক নেই। ভ্রমণ কাহিনী লেখার লোক নেই কারণ এই লেখা লিখে টাকাপয়সা খুব বেশি আয় করা যায় না।
এর পাঠক কম। তা ছাড়া ভ্রমণ কাহিনী লিখতে হলে আর কিছু না হোক, যে স্থান সম্পর্কে লিখতে হবে, সে স্থান চোখ ভরে দেখতে তো হবে। এই মন্দার বাজারে যখন নুন আনতে পানত্মা ফুরায়, তখন ভ্রমণ তো নিছক বিলাসিতা। কিন্তু তাই বলে যে কেউই ভ্রমণ করেন না, তা নয়। অনেকেই আছেন মনের কৌতূহল মিটাতে ভ্রমণ করেন কিন্তু তারা সবাই তো আর লেখক নন। সব মিলিয়ে মোদ্দা কথা ভ্রমণ কাহিনী লেখা হচ্ছে না। সেই সৈয়দ মুজতবা আলী কতগুলো বই লিখেছিলেন তার পর তেমন কোন লেখক এই বিষয়টার প্রতি তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তবে আশার কথা, কিছুদিন যাবত বাজারে কিছু বই দেখা যাচ্ছে। যেমন_ কালাপানি, সক্রেটিসের বাড়ি, হো চি মিনের দেশে, পাবলো নেরম্নদার দেশে, আমেরিকা কাছের মানুষ দূরের মানুষ। সব বইয়ের লেখক এক। শাকুর মজিদ। নামগুলোই বলে দেয় এগুলো কি ধরনের বই। আমার খুব ভ্রমণের শখ কিন্তু অর্থনৈতিক দৈন্যের জন্য শখটা কল্পনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হয়, অথবা অন্যের চোখ দিয়ে দেখতে হয়। তাঁর বইগুলো পড়ে আমি বুঝতে পারলাম শাকুর মজিদ আমার সেই চোখ।
স্কুলে পড়ার সময় যখন কালাপানি বা আন্দামান সেলুলার জেল সম্পর্কে জানি তখন স্বপ্ন দেখতাম, আমি একদিন আন্দামান যাব, দেখব সেখানে বিপস্নবীরা কেমনভাবে নির্যাতিত হতেন, কতটা ভয়ঙ্কর সে স্থান। বলা বাহুল্য, সুযোগ হয়নি। কিন্তু আমার সে সুযোগ করে দিলেন শাকুর মজিদ। তাঁর কালাপানি বইটি পড়ে আমি রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আমার কল্পনার আন্দামান মুহূর্তের মধ্যে তার রূপ পরিবর্তন করল। এত চমৎকারভাবে তিনি আন্দামান এবং সেলুলার জেল সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন যে, যে কেউ আন্দামান না গিয়েও একে দেখতে পারেন শাকুর মজিদের চোখ দিয়ে। কোন স্বপ্নের স্থান প্রথম দেখার যে অনুভূতি, তা পাওয়া গেছে তার 'কালাপানি' বইটিতে। মনের গভীরের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো উপলব্ধি করা এবং তাকে শব্দের শেকলে খুব সহজে বেঁধে ফেলার মতা খুব কম মানুষের আছে। এই কম মানুষের একজন প্রিয় শাকুর মজিদ।
আন্দামান সেলুলার জেলের কথা সবাই জানলেও সেখানে যে 'ভাইপার চেইন গ্যাং জেল' নামে আরও একটি ভয়ঙ্কর কয়েদখানা ছিল, সেটির কথা জানেন_ এমন লোক আমি অনত্মত আমার জীবনে দেখিনি। শাকুর মজিদ আমাকে সেই জেলখানাটাও দেখিয়েছেন। ভাইপার জেলে কতটা ভয়ঙ্করভাবে বিপস্নবীদের শাসত্মি দেয়া হতো তা জেনে আমার শরীরে কাঁটা দিয়েছে। এখানে শাসত্মিপ্রাপ্ত কয়েদিদের জঙ্গলে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হতো, যাতে সাপ আর বিচ্ছুতে কাটে। ভাইপার আইল্যান্ডের জঙ্গলে বাস করত বিষাক্ত 'রাসেল ভাইপার কে'। তাদের খাদ্য করা হতো বিপস্নবীদের। কালাপানি বইটির বিশেষত্ব এই যে, বইটিতে সব বিখ্যাত স্থানগুলোর ছবিও আছে অপূর্ব প্রকাশভঙ্গি নিয়ে। শাকুর মজিদ বাংলাদেশের একজন প্রথম সারির আলোকচিত্রী। কাজেই তাঁর তোলা ছবিতে গল্পটা অনেক বেশি থাকবে_ এটাই স্বাভাবিক। আমি দু'চোখ ভরে ছবিগুলো দেখেছি এবং প্রাণভরে লেখাগুলো পড়েছি। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত রস আইল্যান্ড যে ছিল ইংরেজ শাসন আমলে আন্দামানের প্রশাসনিক রাজধানী তাও জেনেছি এ বই থেকে। জেনেছি অত্যাচারী ইংরেজরা সেই সময়ে এখানে কতটা আয়েসী জীবন যাপন করত। তাদের জন্য এখানে ছিল মিনারেল পানির পস্নান্ট, ছিল বেকারি, ছিলা চার্চ, কাব, বিদু্যৎ ব্যবস্থা ইত্যাদি সভ্যজীবনের যাবতীয় অনুষঙ্গ। শাকুর মজিদের লেখার অন্যতম বিশেষত্ব সমৃদ্ধ তথ্যভা-ার। তাঁর বইগুলোতে যে পরিমাণ তথ্য সনি্নবেশিত থাকে, আমি নিশ্চিত এই পরিমাণ তথ্য যদি কেউ শুধু তথ্য হিসেবে মনে রাখতে চায় তবে তা হবে খুবই কঠিন একটি কাজ। কিন্তু এত চমৎকারভাবে তিনি গল্পের সঙ্গে তথ্যকে মিলিয়েছেন যে পড়তে গেলে সেটা গল্পই হয়ে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমাদের অন্যতম পাঠ্য ছিল গ্রীক নাটক এবং নন্দন তত্ত্ব। যে কারণে সক্রেটিস, পেস্নটো, এ্যারিস্টটল এরা ঘুরে ফিরে প্রতিদিনই আমাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতেন। সক্রেটিসের সে সময়ের প্রচলিত ধারণার বিরম্নদ্ধে বিদ্রোহ এবং পরিণতিতে কারাবরণ এবং শেষ পর্যনত্ম হ্যামলক পানে মৃতু্য_ এসবই ছিল সে আলোচনার বিষয়বস্তু। তখন আমরা কিছু বন্ধু ঠিক করেছিলাম, যদি টাকাপয়সার ব্যবস্থা হয় আমরা গ্রীস দেখতে যাব। গণতন্ত্রের আবিষ্কারকের কারাগারটি দেখব, যেখানে বসে তিনি হ্যামলক পান করেছেন, যেখানে বসে তিনি বক্তৃতা দিতেন। সেই এ্যাগোরায় বসে দুর্দ- সক্রেটিসকে ভাবব, যেখান থেকে এ্যারিস্টটল, পেস্নটো, আলেকজান্ডারা জন্ম নিয়েছেন সে স্থান তো আমাদের কাছে তীর্থতুল্য। সেই তীর্থ ভ্রমণ করে দেখব থিয়েটার অব হিরোডিস এটিকাস, ডায়ানেসিস থিয়েটার, যেখানে সফোকিস, এ্যাস্কিলাস, এ্যারিস্টোফেনিসদের নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। কিন্তু মানুষ চাইলেই তো আর সব হয়ে ওঠে না। নিজের চোখে দেখতে পারিনি এ সকল স্থান। কিন্তু দেখেছি। শাকুর মজিদের চোখ দিয়ে দেখেছি স্বপ্নের এ স্থানগুলো। কি অসাধারণ বর্ণনা। প্রাচীন গ্রীসের নানা ঘটনার বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি দেখিয়েছেন, যে কারাগারে সক্রেটিস বন্দী ছিলেন সেই কারাগার। আমি হলফ করে বলতে পারি কারাগারের ছবিটি দেখার পর আমি শিহরিত হয়ে উঠেছিলাম। নাটক গল্পে যে স্থানের কথা পড়েছি তার ছবি এই সাতসমুদ্র তেরো নদীর পারে বসে দেখতে পারা তাইবা কম কিসে। কই এতগুলো বছর তো কেউ এসব স্থানের ওপর সচিত্র কোন লেখা লেখেননি। জয়তু শাকুর মজিদ।
এই বইয়েই আছে নেপোলিয়নের স্মৃতিবিজরিত শহর প্যারিস এবং লুভ্যর মিউজিয়ামের বর্ণনা। আছে জার্মানি এবং জুডিস মিউজিয়ামের কথা। যেমন গোগ্রাসে তিনি প্যারিসকে গিলেছেন তার চেয়ে গোগ্রাসে তিনি গিলিয়েছেন। একজন আর্কিটেক্ট হওয়ার পরও প্যারিসের আইফেল টাওয়ার তাঁর বইয়ের একটি পাতায় কোনভাবে স্থান করে নেয় আর তিনি বিসত্মৃত হন নেপোলিয়নের মাজারের খোঁজে, লুভ্যর মিউজিয়ামের বর্ণনায়। এখানেই শিল্পী শাকুর মজিদের জয়ী হয়ে ওঠা। তাঁর তোলা ছবিগুলো শুধু ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারে চোখ রেখে তাঁর নিজের দেখা নয়, আমার মতো হাজার হাজার কাঙ্গালের চোখ হয়ে ওঠা। ছোটবেলায় বইয়ে পড়েছি ইবনে বতুতার নাম। বিখ্যাত পরিব্রাজক। তার কাছ থেকে জেনেছি প্রাচীন বাংলার ইতিহাস। তাঁর সময়ের পৃথিবীর ইতিহাস। তার পরে দু' একজনের নাম শুনলেও তার মতো আর কোন পরিব্রাজকের নাম তেমনভাবে শুনিনি। আর আমার মতো কোন ভীতু বাঙালী যে বিশ্ব ভ্রমণ করেন এবং তার দেখাটাকে সকলের দেখার জন্য বাজারে ছেড়ে দেন আমি কল্পনাই করিনি। হয়ত আমার কল্পনার জগত বা চেনা জানার জগতটা খুব বিসত্মৃত নয়। কিন্তু এই সীমিত জগতেই অসীম হয়ে উঠতে দেখছি শ্রদ্ধেয় শাকুর মজিদকে। আপনার চোখ দুটো আপনার নয় ও দুটো চোখ আমার, আমাদের। আজকের বাংলাদেশ আপনাকে যতটুকু জানে তার চেয়ে বেশি জানবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ। শাকুর মজিদ, আপনি আমাদের কালের ইবনে বতুতা। বাংলাদেশের ভ্রমণ সাহিত্যের পথিকৃৎ। আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভালবাসার নিবেদন_
'শাপলা ফোটা ঝিলের জলে/ কুড়িয়ে পাওয়া শেষ বিকেলে,/রং ছড়ানো আলোর ধনু/মন মাতালে একোন নীলে।/জিজ্ঞাসিবে সহস্র প্রাণ/দখিন হাওয়ায় তোমারই নাম।' ম

No comments

Powered by Blogger.