ওকরাইত- চরাঞ্চলের মানুষের অভিনব জীবনযাত্রা

সত্তরোর্ধ জাকির হোসেন গেদু একজন কৃষক। কিন্তু নিজের একরত্তি জমি নেই। অন্যের জমি বর্গা চাষ করেন। যে কুঁড়ে ঘরখানায় ৫০ বছর ধরে বৃদ্ধা মা, স্ত্রী আর দুটি সনত্মান নিয়ে বাস করছেন, সেটির মালিকও তিনি নন।
মহাজনের জমিতে ঘর তুলে বাস করছেন। পটুয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চলে জাকির হোসেন গেদুর মতো অসংখ্য মানুষ রয়েছে, যারা যুগের পর যুগ ধরে অন্যের জমিতে ঘর তুলে বসবাস করছেন। এ অঞ্চলের মানুষের কাছে তারা এক শব্দে 'ওকরাইত' হিসেবে পরিচিত।
ওকরাইত শব্দটির আভিধানিক কোন অর্থ নেই। অভিধানেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ এ শব্দটির সঙ্গে মিশে আছে এ অঞ্চলের একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর নিত্যদিনের করম্নণতর জীবনধারা। এটি একটি আঞ্চলিক শব্দ। প্রবীণরা ধারণা করছেন, এ অঞ্চলের মানুষ 'রাত্র' বা 'রাত'কে 'রাইত' উচ্চারণ করে করে থাকে। আর 'ক' মানে কয়েকটি। অর্থাৎ অন্যের বাড়িতে 'কয়েকটি রাত কাটানো' থেকেই শব্দটির উৎপত্তি ঘটে থাকতে পারে। ওকরাইত মানেই অন্যের জমিতে ঘর তুলে বাস করা। এ অঞ্চলের যে কোন গ্রাম কিংবা চর-দ্বীপে গেলেই দেখা মিলবে এমন অনেক মানুষের সঙ্গে, যারা ওকরাইত হিসেবেই সবচেয়ে বেশি পরিচিত। তাদের নাম এবং অন্যান্য পরিচয়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে ওকরাইত শব্দটি।
দেখা গেছে, পরিবার পরিজন নিয়ে নানা কারণে মানুষ ওকরাইত হিসেবে জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নদী ভাঙ্গন। প্রতিবছর উপকূলীয় অঞ্চলে একটা বড় জনগোষ্ঠী নদী ভাঙ্গনে সর্বস্ব হারিয়ে পথের ভিখারিতে পরিণত হচ্ছে। এদের একটি অংশ যেমন ওকরাইত হচ্ছে, তেমনি মামলা-মোকর্দ্দমা কিংবা দায়দেনা মেটাতে বাড়িঘর বিক্রি করেও অনেকে ওকরাইত হচ্ছে। এছাড়া, ঝড়-বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং ফসলহানির কারণেও অনেকে ওকরাইত হচ্ছে। অন্যদিকে, এলাকায় এক শ্রেণীর প্রভাবশালী ভূস্বামী রয়েছে, যাদের হাতে রয়েছে প্রচুর জমিজমাসহ অন্যান্য স্থায়ী সহায় সম্পদ। অথচ দেখাশোনা বা রণাবেণ করার মতো লোকবল নেই। তারাই বেশিরভাগ েেত্র মানুষকে ওকরাইত হিসেবে রাখে। এতে সম্পদ রণাবেণে যথেষ্ট সুবিধা হয়। ওকরাইতরা শুধু বাড়িঘর জমিজমা পাহারা দিয়ে রাখে। তাই নয়, তারা সব ধরনের ফসল উৎপাদনে সহায়তা করে। এর পাশাপাশি তারা বাড়ির জমিতে উৎপাদিত কলা-মুলা থেকে শুরম্ন করে পুকুরের মাছ, গরম্ন-মোষের দুধ পর্যনত্ম সবকিছু শহরে মালিকের বাড়িতে নিয়মিত পেঁৗছে দেয়।
ওকরাইত হিসেবে বাস করা বেশিরভাগ মানুষ 'ওকরাইত' শব্দটি যথেষ্ট অমর্যাদাকর মনে করে। শোষণ আর শাসনের যাঁতাকলে বাঁধা তাদের জীবন। নূর মোহাম্মদ গাজী (৬৫) ৩০ বছর আগে নদী ভাঙ্গনে সবকিছু হারিয়ে পিরোজপুর থেকে ৬ সদস্যের সংসার নিয়ে আগুনমুখার চরে ওকরাইত হিসেবে বসবাস শুরম্ন করেন। আজও ওকরাইত জীবনের সমাপ্তি ঘটেনি। নূর মোহাম্মদ জানান, 'মালিকরা হইল জমিদার। হ্যারা মোগো মানুষ বইলা মনে করে না। যহন তহন আইয়া গালাগালি করে। পান থাইকা চুন খসলেই চর থাপ্পর মারেন।' একই চরের এক নারী (৪৭) জানালেন, 'মহাজন আসার কথা শুনলেই তিনি তার বড় মেয়ে আর ছেলের বউটিকে অন্যের বাড়ি পাঠিয়ে দেন।' অপর একজন জানান, 'অনেক মহাজনের বউঝিদের ওপর নজর পড়ে। একবার নজর পড়লে আর রা পাওয়ার উপায় থাকে না। মালিকরা শহর থেকে মাঝে মধ্যে সহায় সম্পদ দেখার নামে চরে এলেও তাদের উদ্দেশ্য থাকে একটাই, আর তা হচ্ছে ওকরাইতের বউঝি নিয়ে ফুর্তি করা। আবার বহু ওকরাইত পেটের টানে বউঝিদের মহাজনের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়।'
সাগর পাড়ের টং চরের জয়নাল গাজী (৫৫) জানান, তার মালিকের এখানে প্রচুর সম্পত্তি রয়েছে। আছে অনেকগুলো গরম্ন, মোষ, গাছপালা ও পুকুর। সবকিছু তাকে সারা বছর দেখে শুনে রাখতে হয়। এর বিনিময়ে মালিকের তুলে দেয়া ঘরে বাস করা ছাড়াও জোটে সারা বছরের প্রয়োজনীয় ধান-চাল-ডাল। সংসারের অন্যান্য খরচ মেটাতে সময় সুযোগ পেলেই সাগরে মাছ ধরতে নামেন। এভাবেই ৫ জনের সংসার নিয়ে তার প্রায় ৪০ বছরের ওকরাইত জীবন কাটছে। সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, চরটিতে সবমিলিয়ে ৪০টির মতো পরিবারের বাস। এর মধ্যে ২৮টি পরিবারই জয়নাল গাজীর মতো ওকরাইত হিসেবে বাস করছে। যার ২৩টি পরিবারই এসেছে ভোলা থেকে। নদী ভাঙ্গনে তারা বিভিন্ন সময়ে সব হারিয়ে এখানে এসে ওকরাইত জীবন বেছে নিয়েছে। মাত্র ৪টি পরিবারের সারা বছরের প্রয়োজনীয় ধান-চাল মহাজনরা দিয়ে থাকে। বাকিরা কিছুই পায় না। চর বেষ্টিনের মিলন গাজী (৪৬) জানান, 'অন্যের বাড়িতে বিনা পয়সায় থাকতে পারছি, এটুকুই লাভ।'
সরকারী উদ্যোগে সারাদেশে আদর্শগ্রাম, আবাসন ও আশ্রয়ণসহ কিছু প্রকল্পের মাধ্যমে নিরাশ্রয় ভূমিহীনদের পুনর্বাসন কাজ চলছে। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে বহু মানুষ পেয়েছে নিজস্ব ঠিকানা। কিন্তু তারপরেও গলাচিপার চরাঞ্চলে এখনও অসংখ্য পরিবার ওকরাইত হিসেবে বাস করছে। এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, অধিকাংশ আবাসন প্রকল্পে কর্মসংস্থানের কোন সুযোগ নেই। প্রকল্পের স্থান নির্ধারণে কর্মসংস্থানের বিষয়টি গুরম্নত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়নি। যেখানে-সেখানে আশ্রয়ণ প্রকল্প নির্মাণ করায় সেগুলোর একটা উলেস্নখযোগ্য অংশ খালি পড়ে আছে। বরাদ্দ দেয়ার পরেও সেগুলোতে কেউ বাস করছে না। বহু আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকার প্রভাবশালীদের দখলে চলে গেছে। অনেকে গোয়ালঘর হিসেবে ব্যবহার করছে। পরিবেশও তেমন সুখকর নয়। ফলে প্রকল্পগুলো শতভাগ সফল হতে পারছে না। মানুষ ওকরাইত হিসেবে বাস করতে বাধ্য হচ্ছে।
_শংকর লাল দাশ, গলাচিপা

No comments

Powered by Blogger.