সময়ের কথা-রঙে রঙিন ক্যানভাস by অজয় দাশগুপ্ত

সত্যের অনুসারী হলে ঝগড়া-ফ্যাসাদ হয় না_ এমন চিরন্তন মন্তব্য ফের শোনালেন এক প্রবীণ-প্রাজ্ঞজন। একটি গল্প দিয়ে বিষয়টি বোঝাতে চাইলেন। গল্পটি এইরূপ_ এক মৃৎশিল্পী মাটির পুতুল বানালেন। পাশে বসে তা দেখলেন আরেক লোক। তিনি কেবল শিল্পীর সাধনা দেখছেন অবাক হয়ে।
এক সময়ে পুতুল বানানোর কাজ শেষ হলো। রোদে শুকানো হলো। পরের দিন রঙের সময়ও ওই লোক হাজির। দু'দিন কেন তিনি শিল্পীর পাশে বসে থাকলেন, তার ব্যাখ্যা নেই। রঙ করা শেষ হলে শিল্পী বলেন, পুতুলটি আমি বানিয়েছি এবং এর মালিক আমি, অন্য কেউ নয়। পাশে দু'দিন ধরে কাজ দেখা লোকটি বললেন, ঠিকই বলেছেন। আমি দেখেছি যে আপনিই এটা বানিয়েছেন এবং সুন্দর রঙ করেছেন। এটা বানাতে যা যা প্রয়োজন, যা যা খরচা সবই আপনি দিয়েছেন। তাই এর মালিক আপনিই। অন্য কারও তা দাবি করার প্রশ্ন আসে না।
এমন অবস্থানে ঝগড়া-ফ্যাসাদের অবকাশ থাকে না। শিল্পী চলে গেলেন বাজারে তার পুতুল বিক্রি করতে। অন্যজন চলে গেলেন নিজের কাজে। সত্যের পক্ষে বলাই তার কাজ।
একটি ঘটনার একমাত্র সাক্ষী যিনি, তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন_ যা দেখেছি, সেটাই বলেছি।
এত সহজে মিটমাট হলে তো আর জমে না! অন্যায়-অনিয়ম যারা করে, তারা কোদালকে কোদাল বলতে চায় না। নানা ছলছুতা করে।
বরিশাল জেলা প্রশাসকের সভাকক্ষে শনিবার জেলা সদরের কিছু প্রবীণ ব্যক্তির সমাবেশ ঘটেছিল। তারা নানা পেশায় যুক্ত ছিলেন। নিজ কর্মগুণেই প্রাচ্যের ভেনিস বরিশাল শহরে তারা প্রিয়-পরিচিত মুখ। এ কারণে তাদের অনেকেই জোর গলায় বলতে পারেন, রিটায়ার্ড বাট নট টায়ার্ড। জেলা প্রশাসক মো. শহীদুল আলম তাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। নাম দিয়েছিলেন_ 'প্রাজ্ঞ সভা'। সভা চলাকালেই একজন বললেন, 'প্রাজ্ঞজন সভা' হলে ভালো হয়। এমন আয়োজন বরিশালে নিকট অতীতে ঘটেনি। অতি প্রবীণ যারা, তাদের স্মৃতিতেও নেই। ব্যতিক্রমী এ আয়োজনে অনেকে কথা বলেন মন খুলে। কেউ কেউ বেশি সময় নিয়েই বলতে চেয়েছেন। তখন বলা হলো_ আপনার এসব কথা আমরা জানি। যারা জানে না কিন্তু জানলে ভালো হয়_ তাদের এসব জানাতে হবে। কীভাবে? তার সমাধান মিলল সভায় উপস্থিত কয়েকজন কলেজ অধ্যক্ষের প্রস্তাবে_ তারা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে এসব গুণী ব্যক্তিকে নিয়ে সভার আয়োজন করতে ইচ্ছুক। প্রবীণরা বলবেন পুরনো দিনের কথা। উপজেলা পর্যায়েও এমন আয়োজন হতে পারে। শালীনতা, মূল্যবোধ, চরিত্র গঠন_ এসব বিষয়ে বলবেন। কিন্তু এই কলি যুগে এসবের কি কোনো চাহিদা আছে? ছাত্রছাত্রীরা কেন শুনবে 'সদা সত্য কথা বলিবে' নীতিকথা? তাদের চারপাশে যে নিত্যদিন অসত্যের জয়ধ্বনি। দেশে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হচ্ছে রাজনৈতিক দল। এক সময়ে সামরিক শাসকরা বন্দুকের নলের জোরে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিত। তাদের চারপাশে গড়ে উঠত একদল উচ্ছিষ্টভোগী ও স্তাবকের দল। জনগণের মতামত নিয়ে তারা মাথা ঘামাত না। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সরকারের তহবিল থেকে তারা সুবিধা বিলাত। প্রতিবাদ থামাতে লাঠি-গুলি-টিয়ার গ্যাসের বেপরোয়া ব্যবহার করত। বহু সংগ্রাম করে বাংলাদেশের জনগণ সামরিক শাসন হটিয়েছে। দুই দশকের বেশি সময় ধরে দেশের ক্ষমতায় পালাক্রমে রয়েছে গণভিত্তিসম্পন্ন রাজনৈতিক দল। তারাও কেন দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে সরকারের সম্পদ বিলি-বণ্টন করবে?
নিজের অভিজ্ঞতা বলি। স্বাধীনতার আগের বছরে জন্ম নেওয়া এক অনুজ একদিন এসে বলল, আমার জন্য একটি সুখবর নিয়ে এসেছে। সে বিবাহিত এবং দুই সন্তানের জনক। সে জানাল, সে যে দল করে তার ছাত্র সংগঠনের উপজেলা কমিটির বিভিন্ন পদে যে তালিকা গেছে 'লিডারের কাছে অনুমোদনের জন্য' তাতে তার নাম আছে সহ-সভাপতি হিসেবে। তবে তাকে বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্র রয়েছে এবং তার বদলে যাকে ওই পদ দিতে চায় সে স্কুল ছেড়েছে অনেক বছর এবং এখন ব্যবসা করছে।
শহর ও গ্রামে এমন হতাশার কথা শোনার জন্য আমাদের কাউকেই বেশি দূর যেতে হবে না। বরিশালের জেলা প্রশাসকের অফিসে সভা চলাকালেই ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা জানতে পারি। ছাত্রলীগের দুই পক্ষের টানা কয়েকদিনের সশস্ত্র সংঘর্ষে উভয় পক্ষে আহত হয়েছে শ'খানেক। আর 'ক্রস ফায়ারে' পড়ে মারা গেছে রাব্বী নামের এক শিশু। এর জের ধরে গ্রামবাসীরা একাধিক ছাত্রাবাস জ্বালিয়ে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি 'সাফ জানিয়ে দিয়েছে'_ তাদের সংগঠনের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা বাতিল করা হয়েছে। ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় অপরাধকর্ম চাপা পড়বে, এমন শঙ্কা রয়েছে। পুলিশ অপরাধীদের সবাইকে খুঁজে পাবে না। মামলা হবে লোক দেখানো এবং তাতে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীদের বাদ রাখার ষড়যন্ত্র হবে। আবার সেশনজটে পড়বে হাজার শিক্ষার্থী।
ছাত্র সংগঠনের নামে এই সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বছরের পর বছর ধরে দেখে অভ্যস্ত আমরা। তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যে প্রতিষ্ঠানে 'বাণিজ্যের সম্ভাবনা' যত বেশি সেখানে সমস্যা তত বেশি। এ ধরনের দাপট-দৌরাত্ম্য যারা দেখায়, তাদের কাছে শিক্ষার্থীদের ভালো-মন্দের কানাকড়িও মূল্য নেই। ক্যাম্পাসকে তারা মনে করে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের মাধ্যম। এ জন্য প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের কাছ থেকে বাধা পাওয়ার কারণ নেই। তাদের বিতাড়ন করা হয়েছে ক্যাম্পাস থেকে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের রায় নেওয়ারও দরকার নেই। কারণ, এ পাট চুকে গেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে সত্য-সুন্দর-ন্যায়ের কথা প্রচার হলে কিছু লোকের ভালো লাগার তো কথা নয়। অথচ বরিশালে জেলা প্রশাসকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে যেসব প্রাজ্ঞজন এসেছেন তারা এসবই বলতে চান এবং মনে করেন যে, এর প্রয়োজন অপরিসীম। তারা কি সফল হবেন? নির্বিঘ্নে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে তারা কি মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা শোনাতে পারবেন? দীর্ঘ কর্মজীবনে তাদের সাফল্য আছে, ব্যর্থতা আছে, ভুলত্রুটি-অনিয়ম আছে। নবীন প্রজন্মের জন্য তার সবকিছুই শিক্ষণীয় হতে পারে। বরিশাল শহরে নিখিল সেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। কী করে পুরনো খবরের কাগজের ওপর আলতা দিয়ে পোস্টার লিখতেন এবং এ জন্য তুলি হিসেবে ব্যবহার করতেন খেজুর গাছের ডগা_ তার বলা এ গল্প (আসলে সত্য ঘটনা) এখনকার প্রধান প্রধান ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের কাছে মোটেই আকর্ষণীয় হওয়ার কথা নয়। হাতের লেখা পোস্টারের আর চল নেই। ছাপানো রঙিন পোস্টারেও আর চলছে না। তার স্থান নিচ্ছে ডিজিটাল পোস্টার-ব্যানার-ফেস্টুন। ঢাকা থেকে যে কোনো জেলা-উপজেলায় সড়কপথে চলতে চলতে দেখবেন ডিজিটাল পোস্টার-ব্যানারে ছেয়ে আছে দুই পাশ। এর অর্থ আসে কোত্থেকে? সরকারি দলের সঙ্গে যুক্তরা এ জন্য সরকারকেই উৎস করে। তারা টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি কিংবা অন্যভাবে জোর খাটিয়ে যে অর্থ উপার্জন করে তার একটি অংশ এ জন্য ব্যয় করে। বিরোধী দলে যারা রয়েছে, তারাও পিছিয়ে থাকে না। তারা ভরসায় থাকে, দল ক্ষমতায় এলে সব পুষিয়ে নেওয়া যাবে। এ জন্য আগাম বিনিয়োগ করে। বিএনপি আগেরবার ক্ষমতায় থাকার সময় অনেকে প্রচুর কামিয়েছে। হাওয়া ভবনকে কেন্দ্র করে দুর্নীতি হয়েছে। তার বাইরেও হয়েছে। এভাবে যারা অনিয়ম করে উপার্জন করেছে, তার একটি অংশ বিনিয়োগ করা নতুন লাভের আশায়।
এই যদি রাজনীতি হয়, তাহলে সুনীতির স্থান কোথায়? বরিশালের প্রাজ্ঞজন সভায় একজন বললেন, যারা জীবনে অনেক সফলতা অর্জন করেছেন তাদের জ্ঞানে ও অভিজ্ঞতায় হক আছে তরুণ প্রজন্মের। রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব এ হক যাদের পাওয়া উচিত, তাদের কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার আয়োজন করা। সমাজেরও এগিয়ে আসা কর্তব্য। বরিশালের ১৯ জানুয়ারির সভাকে আমরা সেই লক্ষ্যে একটি ভালো পদক্ষেপ হিসেবে ধরে নিতে পারি। তারা রাষ্ট্র বা সমাজের সব দায়িত্ব নিয়ে নিতে পারবেন না। কিন্তু প্রতীক ধরনের কিছু কাজ নিশ্চয়ই করতে পারেন। জেলায় বা উপজেলায় কোনো বড় ধরনের অন্যায়-অনিয়ম ঘটতে দেখলে তার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা যায় এ ফোরামের মাধ্যমে। এ কাজ সহজ হয়ে যায়, যদি প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব তাদের কাজকে ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করে। সন্দেহের দৃষ্টিতে না দেখে। এই প্রবীণ বয়সে তাদের রাজনৈতিক অভিলাষ থাকার কথা নয়। কেবল সমাজের মঙ্গলের জন্য তারা একত্র হতে চান। যদি কোনো ন্যায্য কথা তাদের কাছ থেকে আসে, তার প্রতি একটু মনোযোগ দিলে ক্ষতি কী?
অবসর জীবনে যারা ক্লান্ত হয়ে পড়েননি, মনেপ্রাণে রয়ে গেছেন সজীব ও প্রাণবন্ত, দৌড়ঝাঁপে তেমন হাঁপিয়ে পড়েন না_ তাদের কিছু লোক হাত মেলালে সমাজের যদি একটু উপকার হয় তা নিতে তো আপত্তি থাকার কথা নয়। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো কেন্দ্র ও জেলা পর্যায়ে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেছে। বরিশালের এ উদ্যোগকে আমরা সে ধরনের কিছু মনে করতে পারি। উপজেলা পর্যায়েও এমন কিছু করা সম্ভব। অন্য জেলাগুলোও এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। বরিশালের আলোচনায় অংশ নিয়ে বিশিষ্ট শিল্পোদ্যোক্তা বিজয় কৃষ্ণ দে সৎ চরিত্রের আন্দোলনের কথা বলেন। ঘরে ঘরে ভালো মানুষ গড়ে তোলার আকুতি জানিয়েছেন। যেসব বিষয় আমাদের সবাইকে উদ্বিগ্ন করে তা থেকে মুক্তিলাভের জন্য কাজ করার তাগিদ দিয়েছেন। তার ভাবনায় রয়েছে_ রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সব বিভাগীয় শহরের সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপন। বিভাগীয় শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার সবচেয়ে কাছের হচ্ছে বরিশাল। কিন্তু লঞ্চে যেতে প্রায় সারারাত লেগে যায়। সড়কপথে পাটুরিয়া-আরিচায় কিংবা মাওয়ায় ফেরি। পদ্মায় সেতু হলে মাত্র তিন ঘণ্টাতেই চলে যাওয়া যাবে বরিশাল শহরে। সেতুতে রেললাইন হলে শুধু বরিশাল নয়_ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আরও অনেক জেলার সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ জলভাত হয়ে যাবে। এর ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের সুষম উন্নয়ন হবে, রাজধানীর ওপর মানুষের চাপ কমবে। একজন সাদামনের মানুষের এ পরামর্শের প্রতি আমাদের প্রশাসন এবং রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনে যুক্তরা কি গুরুত্ব দেবেন? এ ভাবনা কিন্তু আরও অনেক মানুষের। সরকারের কি তাতে টনক নড়বে?

অজয় দাশগুপ্ত :সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.