অনাদরে আ মরি বাংলাভাষা by বিধান চন্দ্র দাস

পৃথিবীর নানা ভাষায় প্রকাশিত সাময়িকীর জন্য আন্তর্জাতিক মানের ক্রমিক নম্বর (ওঝঝঘ) প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের কাছে বাংলা ভাষার নাম সম্ভবত অজানা। পৃথিবীর যে কোনো ভাষায় প্রকাশিত সাময়িকীর জন্য আন্তর্জাতিক মানের ক্রমিক নম্বর এই সংস্থা দিয়ে থাকে।
যেসব দেশে এই সংস্থার কোনো অফিস নেই সেসব দেশে এই সংস্থা সরাসরি প্যারিস থেকে এই নম্বর দেওয়ার কাজ করে থাকে। এই নম্বর পেতে হলে ইন্টারনেটে একটি ছক পূরণ করার ব্যবস্থা আছে। এই ছকের এক জায়গায় কোন ভাষায় পত্রিকা প্রকাশ হতে যাচ্ছে সেটি নির্বাচন করতে হয়। এই নির্বাচনের জন্য সেখানে ৩১টি ভাষার নাম থাকলেও দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এই যে, সেখানে বাংলা ভাষার নাম গত ১৫ নভেম্বর ২০১২ সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিল না। যেসব ভাষার নাম সেখানে ছিল তার অনেকগুলোরই সেসব ভাষায় পৃথিবীতে কথা বলা লোকের সংখ্যা বাংলা ভাষায় কথা বলা লোকসংখ্যার ধারেকাছেও না। যেমন ড্যানিশ (অর্ধকোটির কিছু বেশি), স্লোভাক (অর্ধকোটি), থাই (দুই কোটি), কোরিয়ান (৮ কোটি), ভিয়েতনামিজ (৮ কোটি) প্রভৃতি। প্রায় ২৩ কোটি লোক বর্তমানে সারা পৃথিবীতে বাংলা ভাষায় কথা বলে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলা ভাষার অবস্থান পৃথিবীতে ষষ্ঠ। যে শহরে আন্তর্জাতিক মানের ক্রমিক নম্বর প্রদানকারী এই সংস্থার সদর দফতর অবস্থিত, সেই প্যারিসেই আছে ইউনেস্কোর সদর দফতরও। গত ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ও ভারত বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার জন্য ভোট প্রদান করে। গত ২৬ সেপ্টেম্বর ২০০৯ তারিখে জাতিসংঘের ৬৪তম সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের সরকারি ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন।
এত কিছুর পরও আন্তর্জাতিক মানের ক্রমিক নম্বর প্রদানকারী এই সংস্থার লোকজনের কাছে বাংলা ভাষা কেন এত গুরুত্বহীন তা আমাদের বিস্মিত করে। তবে এসব ক্ষেত্রে আমাদেরও কোনো অবহেলা-অনাদর আছে কি-না তাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
এই বিষয়টি আমার প্রথম নজরে আসে ২০০০ সালে, যখন একটি বাংলা বিজ্ঞান পত্রিকার আন্তর্জাতিক মানের ক্রমিক নম্বর পাওয়ার জন্য সংস্থাটির নির্ধারিত ছক পূরণ করতে যাই। দেখা যায় যে, সেখানে অনেক ভাষার নাম থাকলেও বাংলা ভাষার নাম নেই। আমি সঙ্গে সঙ্গে কর্তৃপক্ষকে (প্যারিসে) একটি মেইল করে বাংলা ভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত করি। অনুরোধ করি যেন অবিলম্বে বাংলা ভাষাকেও সেখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সংস্থা আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করে মেইল পাঠায় এবং অতিদ্রুত বাংলাকেও তাদের নির্ধারিত ছকে অন্তর্ভুক্ত করে। বিষয়টি নিয়ে সেসময় দু'একটি কাগজে লেখাও হয়।
এ ঘটনার প্রায় এক যুগ পর হঠাৎ গত ১৫ নভেম্বর ২০১২ বিকেলে আমার এক সহকর্মী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সভাপতি প্রফেসর আবুল কাশেমের অনুরোধ পাই_ তাদের বিভাগের একটি সাময়িকীর জন্য আন্তর্জাতিক মানের সেই ক্রমিক নম্বর কীভাবে পাওয়া যাবে সে ব্যাপারে সাহায্য করার। আমি সংস্থাটির ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখি যে, ওয়েব পেজটির চেহারায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। নির্ধারিত ওয়েবছকটির ভাষা নির্বাচনের জায়গায় অবাক হয়ে লক্ষ্য করি যে, সেখানে ৩১টি ভাষার নাম থাকলেও দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সেখানে বাংলা ভাষার নাম নেই। আমি সঙ্গে সঙ্গে ২০০০ সালের মতো বাংলা ভাষার নাম কেন সেখানে থাকা প্রয়োজন তা ব্যাখ্যা করে সংস্থাটির সদর দফতরে একটি মেইল পাঠাই। এর ১০ মিনিট পরেই প্যারিসে সংস্থাটির সদর দফতরে টেলিফোন করি এবং বিষয়টি টেলিফোন গ্রহণকারী কর্মকর্তাকে অবহিত করি। প্রথমে অবশ্য সেই কর্মকর্তা আমাকে বুঝাতে চেয়েছিলেন যে, বাংলা ভাষার নাম সেখানে না থাকলেও 'অন্য ভাষা' লিখে দিলেও হবে। তার উত্তরে আমি অত্যন্ত আবেগ সহকারে বলি, 'আমি জানি তা হবে। কিন্তু বিষয়টি তো হওয়া না হওয়া সংক্রান্ত নয়। যে ভাষার জন্য আমার দেশের লোক আত্মাহুতি দিল, যে ভাষায় পৃথিবীর প্রায় ২৩ কোটি লোক কথা বলে, যে ভাষার আন্দোলনকে মর্যাদা দিতে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা দিল; সেই ভাষার নাম সেখানে না থাকায় তাকে অবমাননা করা হয়েছে বলে আমি মনে করি।' এরপর কর্মকর্তা আমাকে মেইলটি যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পেঁৗছে দেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করলেন। আমাদের সেই কথোপকথনের কয়েক ঘণ্টা পর ১৫ নভেম্বর ২০১২ রাতেই সংস্থার গ্রন্থপঞ্জি শাখার প্রধান ফ্রাংকোইস জেভিয়ার পেলেগ্রিন আমাকে মেইল করে জানালেন, বাংলা ভাষাকে ওয়েবছকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এবারে অবশ্য কোনো দুঃখ প্রকাশ করা হয়নি।
আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ২০০০ সালের পরে যখন (?) থেকে তাদের ওয়েবছকটি বাংলা ভাষাশূন্য করা হলো, তারপর বাংলাদেশের কোনো সাময়িকীর পক্ষ থেকে কি আন্তর্জাতিক মানের ক্রমিক নম্বরের জন্য ছক পূরণ করা হয়নি? যদি করা হয়ে থাকে, তাহলে কেন তিনি বা তারা এই প্রশ্নগুলো সংস্থার কর্তৃপক্ষকে করেননি?

ড, বিধান চন্দ্র দাস :অধ্যাপক প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.