স্মৃতিতে-শ্রদ্ধায় এম এ সাঈদ by আবু আহমেদ

এম এ সাঈদকে বেশির ভাগ লোকে চেনে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে। কিন্তু আমি তাঁকে চিনতাম অন্যভাবে। তিনি যে এক সময়ে অতি গুরুত্বপূর্ণ কমিশন সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন তা বোধ করি অনেকে জানতেন না।
হ্যাঁ, তিনি শেয়ারবাজার রেগুলেটর SEC-এরও চেয়ারম্যান ছিলেন এবং বলব তিনিই ছিলেন SEC-এর প্রথম সফল চেয়ারম্যান, যাঁর আমলে শেয়ারবাজারে কোনোরকম কেলেঙ্কারি সংঘটিত হয়নি এবং যাঁর আমলে শেয়ারবাজারের অতি মৌলিক রেগুলেশনগুলো তৈরি হয়েছিল। তাঁর উদ্যোগে এবং দৃঢ় অবস্থানের কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনা কিছুটা হলেও ট্রেডিং বা শেয়ার বেচাকেনার কাজ থেকে পৃথক হয়। তিনি স্মরণমতে ১৯৯৭ সালে SEC-এর চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন। এর আগে, তাও স্মরণমতে, তিনি সরকারি রূপালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। এম এ সাঈদ ছিলেন পাকিস্তান প্রশাসন ক্যাডারের একজন প্রাক্তন সদস্য। বাংলাদেশ সময়ে তিনি অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদেও আসীন ছিলেন। আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে SEC-এর চেয়ারম্যান হিসেবে। ওই সময়ে এবং ওই সময়ের আগের বছরগুলোতে আমি আমাদের পুঁজিবাজার তথা শেয়ারবাজার নিয়ে অনেক লিখতাম, বাজারের প্রসার ও সংস্কার চেয়ে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে নিয়ে এক ধরনের আন্দোলনও করেছি। ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে SEC প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংস্থা যাতে তার সব ক্ষমতা ও মর্যাদা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, সে লক্ষ্যে অনেক লিখেছি, গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছি, সংবাদ সম্মেলনও করেছি। সেই থেকে লোকে আমাকে শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ বলে ভাবতে বসে। আমি কিন্তু বিশেষজ্ঞ হওয়ার জন্য ওই সব করিনি। আমি করতাম আমার বিশ্বাস ও শিক্ষাগত অবস্থান থেকে যে দেশে একটা বিকাশমান ও স্বচ্ছ পুঁজিবাজার না থাকলে যে স্তরে আমাদের শিল্প স্থাপনে স্থায়ী মূলধনের জোগান দেওয়া প্রয়োজন, সেই মূলধন ব্যাংকিং খাতের মাধ্যমে কখনো জোগান দেওয়া সম্ভব নয়। দুঃখজনক হলো, শেয়ারবাজারের প্রয়োজন এবং এই বাজারের স্বচ্ছতার জন্য যা যা করা দরকার, সে ব্যাপারে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোরও কোনো আগ্রহ লক্ষ করিনি। তাঁদের বেশির ভাগ সদস্য ব্যাংক থেকে অর্থ নিয়ে শিল্প স্থাপন করতে এবং সরকার থেকে দান-অনুদান-ভর্তুকি পেতে আগ্রহী ছিলেন। সে সংস্কৃতি এখন কিছুটা বদল হয়েছে বটে। তবে এ ক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো কোনো মনোভাব এখনো দেখি না। যেহেতু SEC হলো পুঁজিবাজার রেগুলেশনের ক্ষেত্রে একমাত্র সংস্থা, তাই SEC-তে আমার রীতিমতো যাতায়াত ছিল। আমি এ জন্যও বেশি যেতাম যে ১৯৯৭-২০০০ এ বছরগুলোয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ রেগুলেশনস তৈরি হচ্ছিল। একটা রেগুলেশন ছিল ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের CEO নিয়োগ নিয়ে। সাঈদ সাহেব আমাকে খসড়াটা দেখালেন এবং বললেন, এ ক্ষেত্রে আমার মতামত কী। আমি CEO-কে আরো ক্ষমতা দেওয়ার পক্ষে এবং CEO যাতে SEC-এর অনুমোদন নিয়ে নিয়োগ ও অপসারিত হয় সে ব্যবস্থাটা রাখতে বললাম। সাঈদ সাহেব আমার যুক্তির শক্তি বুঝতে পেরেছিলেন এবং স্টক এক্সচেঞ্জগুলো প্রশাসনের ক্ষেত্রে CEO-কে আজকে এত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সেটা সেই রেগুলেশনেরই ফল। তাঁর সময়ে স্টক এক্সচেঞ্জ বোর্ডগুলোয় অর্ধেক সদস্য নন-ব্রোকার (Non-Broker) হতে হবে বলে রেগুলেশন বা পরিপত্র জারি করা হয়। নন-ব্রোকারদের SEC নমিনেট করত এবং ভিন্নভাবে আজকে অনুমোদন দেয়। ১৯৯৮ সালে সাঈদ সাহেব আমাকে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের একজন নমিনেটেড সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেন, যে পদে আমি ২০১০ সাল পর্যন্ত ছিলাম। এর আগে মরহুম সাইফুর রহমান যখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন (১৯৯১-৯৫), তখন তিনি স্বেচ্ছায় এবং স্ব-উদ্যোগে অনেকের বিরোধিতা সত্ত্বেও আমাকে SEC পরামর্শ সভার সদস্য করেন। ওই Advisory বা পরামর্শ সভার সভাপতি ছিলেন স্বয়ং অর্থমন্ত্রী নিজে। সে পদেও আমি অনেক দিন ছিলাম। তবে SEC-এর সেই পরামর্শ কমিটি পরে অনেক দিন অকার্যকর হয়ে পড়ে থাকে। সাঈদ সাহেব ইংরেজি সাহিত্যের লোক ছিলেন বলে আমি জেনেছি। কিন্তু তিনি ছিলেন জ্ঞানের ভাণ্ডার। আমি তাঁর কক্ষে প্রবেশ করলে খুশি হতেন এই ভেবে যে অন্তত একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলাপ হবে। সাঈদ সাহেব লোক হিসেবে অত্যন্ত ভদ্র ও মিষ্টভাষী ছিলেন। লোকজনকে সম্মান দিয়ে কথা বলতেন। সাইদ সাহেব যে সময়ে SEC-এর চেয়ারম্যান হলেন, তখন ছিল ১৯৯৬ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারির পরের সময়। আমি তাঁকে বলতাম, যা হয়ে গেছে সেটার জন্য মন খারাপ করে লাভ নেই। দুঃখ হলো ১৯৯৬ সালে অর্থমন্ত্রী ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী এবং পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের প্রাক্তন সদস্য ও মুক্তিযোদ্ধা এস এ এম এস কিবরিয়া। তিনি ১৯৯৬ সালের শেয়ারবাজারের লোপাট ও পরের ধসকে সামাল দিতে পারেননি সত্য, তবে তা নিয়ে কিবরিয়া সাহেব অত্যন্ত অনুশোচনায় ভুগতেন। ১৯৯৭-২০০১ সময়ে সংস্কারের ক্ষেত্রগুলোয় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে প্রচণ্ড দ্বিমত ও বিরোধিতা ছিল। কিন্তু এম এ সাঈদ সাহেবের দৃঢ়তায় সেই বিরোধিতা টিকতে পারেনি। সম্পূর্ণ ব্রোকারশাসিত স্টক এক্সচেঞ্জ বিশ্বের কোথাও না থাকলেও DSE বা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ যেন ব্রোকারদের নিয়ন্ত্রণের শিথিলতার বিষয়টি হজম করতে সক্ষম হচ্ছিল না। অবশ্য ১৯৯৭-২০০১ সাল পর্যন্ত যে সংস্কারগুলো পুঁজিবাজারে আসে, তাতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ADB-এর একটা ঋণ শর্তের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে সেই প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো তখনো পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি। এম এ সাঈদ বাংলাদেশকে সততার সঙ্গে অনেক সেবা দিয়ে গেছেন। জনগণ তাঁকে অনেক দিন মনে রাখবে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.