পবিত্র কোরআনের আলো-সুরা ইউনুস -হেদায়াতের জন্য মানুষের মধ্য থেকে একজন নবী পাঠানো বিস্ময়কর কিছু নয়

১. আলিফ লা-ম রা-; তিলকা আ-ইয়া-তুল কিতা-বিল হাকীম। ২. আকা-না লিন্না-ছি আ'জাবান আন আওহাইনা- ইলা রাজুলিম্ মিনহুম আন আনযিরিন না-ছা ওয়াবাশ্শিরিল লাযীনা আ-মানূ আন্না লাহুম ক্বাদামা সিদকি্বন ই'নদা রাবি্বহিম; ক্বা-লাল কা-ফিরূনা ইন্না হা-যা লাছা-হিরুম্ মুবীন।
৩. ইন্না রাব্বাকুমুল্লা-হুল্লাযী খালাক্বাস সামা-ওয়াতি ওয়ালআরদ্বা ফী ছিত্তাতি আইয়্যা-মিন ছুম্মাছ্ তাওয়া আ'লাল আ'রশি ইউদাবি্বরুল আমরা; মা মিন শাফীয়ি'ন ইল্লা মিম্ বা'দি ইয্নিহী; যা-লিকুমুল্লা-হু রাব্বুকুম ফা'বুদূহু আফালা তাযাক্কারূন।
[সুরা : ইউনুস, আয়াত : ১-৩]
অনুবাদ : ১. আলিফ লা-ম রা। এগুলো হচ্ছে একটি জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থের আয়াত।
২. মানুষের জন্য এটা কি আসলেই কোনো আশ্চর্যের বিষয় যে, আমি তাদের মধ্য থেকে একজন মানুষকে (নবী মনোনীত করে) ওহি পাঠালাম? এটা করলাম এ জন্য, যেন তিনি মানুষকে (ভবিষ্যতের অকল্যাণ সম্পর্কে সতর্ক করে দিতে পারেন এবং যারা ইমান এনেছে, তাদের জন্য (কল্যাণের বিষয়) সুসংবাদ দিতে পারেন আর এ সুসংবাদও দিতে পারেন যে তাদের জন্য তাদের প্রভুর কাছে উঁচু মর্যাদা রয়েছে। (অথচ এরই পরিপ্রেক্ষিতে) কাফিররা বলে, অবশ্যই এ ব্যক্তি একজন আস্ত জাদুকর। ৩. (হে মানুষ!) নিঃসন্দেহে তোমাদের প্রভু হচ্ছেন আল্লাহ তায়ালা, যিনি আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। এরপর তিনি আরশে সমাসীন হলেন, জগতের সব গতি-প্রকৃতি তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁর অনুমোদন ছাড়া কেউ কোনো সুপারিশকারীও হতে পারে না। এই হচ্ছে তোমাদের প্রভু আল্লাহ, তোমরা তাঁরই ইবাদত করো। এর পরও কি তোমরা চিন্তা করবে না?
ব্যাখ্যা : এই সুরাটি হিজরতের আগে নাজিল হয়েছে। হজরত ইউনুস (আ.)-এর নামে এ সুরার নামকরণ করা হয়েছে। ৯৮ নম্বর আয়াতে হজরত ইউনুস (আ.) সম্পর্কে আলোচনা আছে। তাঁর জীবন ও হেদায়াতের সংগ্রাম প্রসঙ্গে এ সুরায় খুব সরাসরি বিস্তারিত আলোচনা না থাকলেও হজরত রাসুলে মকবুল (সা.)-এর হেদায়াতের সংগ্রামের সঙ্গে অনেক মিল আছে। বিশেষ করে হজরত ইউনুস (আ.)-এর জীবনের শেষের দিকের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে মিল যথেষ্ট। কোরআন মজিদে পূর্ববর্তী নবীদের সত্য ও ন্যায়ের পথে সংগ্রামের কাহিনী প্রসঙ্গক্রমে বহু জায়গায় নানাভাবে বিবৃত হয়েছে। এ সুরায়ও হজরত ইউনুস (আ.)সহ হজরত মুসা ও হজরত নূহ (আ.)-এর সংগ্রামের কাহিনী সংক্ষিপ্ত আকারে এসেছে। এসব ঘটনার মধ্যে মানবসভ্যতার জন্য চিরায়ত শিক্ষা রয়েছে।
হিজরতের আগে নবী করিম (সা.)-এর সামনে সবচেয়ে বড় দায়িত্বটা ছিল ইসলামের আকিদা-বিশ্বাস ও চিন্তাচেতনার তাত্ত্বিক বিষয়গুলো জোরালোভাবে উপস্থাপন ও প্রতিষ্ঠিত করা। এ কারণেই মক্কি সুরাগুলোতে তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাতসহ ইসলামের চিরায়ত মূল্যবোধগুলোর প্রসঙ্গ সহজবোধ্যভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এ সুরার কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু এগুলোই। সেই সঙ্গে তৎকালীন আরব মুশরিক, বিশেষ করে নেতৃস্থানীয় কোরাইশ সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে ইসলামের চিন্তা-বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যেসব কথা তোলা হতো, এ সুরায় তার জবাবও দেওয়া হয়েছে। মানবজাতিকে সতর্ক করা হয়েছে, তারা যেন জেদ ও হঠকারিতা পরিত্যাগ করে সত্য, ন্যায়, সাম্য ও শান্তির পথে আসে। অন্যথায় তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে কঠিন শাস্তি ও অকল্যাণ রয়েছে।
এ সুরার প্রথম আয়াতে সুরা বাক্বারার মতোই কয়েকটি 'হরুফুল মুকাত্তাওয়াত' বা অজ্ঞাত তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ উচ্চারিত হয়েছে। এর প্রকৃত অর্থ আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানেন না। ২ নম্বর আয়াতে জোরালো যুক্তি দিয়ে বোঝানো হয়েছে, মানবজাতির কাছে তাদের ভেতর থেকে কোনো মানুষকে নবী মনোনীত করে তার মাধ্যমে ওহি পাঠানো মোটেও বিস্ময়কর ব্যাপার নয়। নবী-রাসুলরা মানুষকে কল্যাণের পথ দেখান এবং অকল্যাণের পথ থেকে বারণ করেন। এ আয়াতে 'কদম' বা 'পা' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে 'মর্যাদা' অর্থে। অর্থাৎ মানুষ কিভাবে মানবিক উচ্চমর্যাদায় উপনীত হবে সে পথই নবী-রাসুলদের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। ৩ নম্বর আয়াতে যে 'ইসতিওয়া' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, এর অর্থ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা বা সমাসীন হওয়া। আল্লাহর এই বিশ্বজগৎ যে আল্লাহর একক কর্তৃত্বে শাশ্বত গতিশীল প্রকৃতির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার অখণ্ডতা ও চিরজাগ্রত নিয়ন্ত্রণের কথাই এখানে বলা হয়েছে। এর চূড়ান্ত রহস্য মানুষের অবোধগম্য এবং আল্লাহর একক নিয়ন্ত্রণাধীন।
গ্রন্থনা : মাওলানা হোসেন আলী

No comments

Powered by Blogger.