ক্ষীরাইয়ের চর- ৪৫ এলাকার মানুষ বেঁচে থাকে ক্ষীরাই চাষ করে

মেঘনা, দাউদকান্দি, কুমিল্লার বুকে জেগে ওঠা ছোট- বড় অসংখ্য চর। এসব চরে কোন এক সময় পদচিহ্ন পড়েনি মানুষের। এখন প্রাণের ছোঁয়ায় সজীব হয়ে উঠেছে নরম মাটি।
ধু-ধু চরের বুকে রচিত হয় জীবন জয়ের অনেক গল্প। অবশেষে সাফল্যের সবুজ পতাকা একদিন হাতছানি দেয় এ চরের মানুষদের। এ রকম এক সাফল্যগাথা খুঁজে পাওয়া গেছে মেঘনা, দাউদকান্দি, কুমিলার রিাইর চরে। সব মৌসুমেই রিাইর সমারোহ ঘটে রিাই েেত। তবে শীতের শেষের দিকে রিাই উৎপাদন হয় একটু বেশি। বিশাল চরে রিাই চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন অনেক মানুষ। জানা গেছে, প্রায় ৬০ বছর আগে তললুটেরচরে রিাই চাষের এ নীরব বিপস্নব শুরম্ন হয়। এখন এ বিপস্নব তললুটেরচর ছাড়িয়ে মেঘনার ভাটিতে যেমন বিসতৃতি ঘটেছে, তেমনি বিপস্নবের এ ছোঁয়া লেগেছে আশপাশের জনপদেও। শীতে স্থানীয় চরগুলো হয়ে যায় রিাইর চর। মাইলের পর মাইল যদ্দুর চোখ যায় শুধু রিাই আর রিাই তে। দীর্ঘ ১৫ কিলোমিটার চরের ৫ হাজার ৪২০ হেক্টর জমিতে বছরে প্রায় ৮ হাজার মেট্রিক টনেরও বেশি রিাই উৎপন্ন হয়, যার বাজারমূল্য ২ কোটি টাকারও বেশি বলে জানা যায়। অনেকের মতে, গত শতাব্দীর চলিস্নশের দশকে ভূমিহীন কিছু লোক এ চরে রিাই বপন করে। উর্বর পলি মাটিতে ফলনও হয় অবিশ্বাস্য। পতিত জমি আবাদ করে আয়ের সুযোগ দেখে একে একে এলাকার অনেকেই চরে রিাই চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ে। চরে রিাই চাষ এভাবেই বাণিজ্যিক মাত্রা পায়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরম্ন থেকে মেঘনায় পলি জমা শুরম্ন হয়। পাশাপাশি চরও পড়তে থাকে। আনারচরের ষাটোর্ধ ইব্রাহীম বলেন, ৫০/৬০ বছর আগে কিছু মানুষ রিাই লাগানো শুরম্ন করে। এহনতো হাজার হাজার মানুষ চাষ করে। এইডা দিয়াই এই এলাকার মাইনষের আয় হয়, সংসার চলে। রিাই চাষের উপর নির্ভর করে প্রায় ৪৫টি গ্রামের মানুষ বেঁচে আছে। এখন তো এ এলাকার সিংহভাগ মানুষের জীবন-জীবিকাই রিাই চাষকেন্দ্রিক। গঙ্গাপ্রসেদ এলাকার গাফ্ফার মিয়া বলেন, এখানকার চরগুলোতে রিাই চাষ শুরম্ন হয় সম্ভবত ১৯৩৮ সালের দিকে। আমি তখন ছোট। বাবা চরে রিাই তে করে ভাটেরচর বাজারে নিয়ে বিক্রি করতেন। এখন আমরাও করি। দুধগাটা গ্রামের পরেশ আলী বাবার পেশার সূত্র ধরে চরে রিাই চাষে জড়িয়ে পড়েছেন। তিনি বলেন, চরে রিাই তে করে আমরা অভাবী মানুষেরা দুই বেলা খাবার জুটাতে পারছি। এইডা আমাগো সুখ। আরেক কৃষক চরবাউইস্যা গ্রামের বাচ্চু মিয়া বলেন, আমার বাবাও রিাই চাষ করতেন। আমি মনে করি রিাই চাষ আমাদের পূর্বপুরম্নষের ঐতিহ্য। আর যাই হোক তে করে দুই বেলা পেট ভরে খেতে পারছি। আর কী দরকার আছে! বড়লোক হওয়ার ইচ্ছা আমাদের নেই।
মেঘনা, দাউদকান্দি ও কুমিলস্নার একাংশের চরাঞ্চলে রিাই চাষ হয়। এসব চরাঞ্চলের প্রায় ৪৫টি এলাকার মানুষ রিাই চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। মেঘনার তললুটেরচর, বাটেরচর, আনারপুরা ও বড়াইকান্দি চরে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ধু-ধু চরের চারদিকে শুধু রিাই আর রিাই তে। নারী, পুরম্নষ, শিশু নির্বিশেষে রিাই েেত কাজে ব্যসত্ম। কেউবা রিাই তুলছে, কেউবা রিাই বাছাই করছে, আবার কেউবা বসত্মায় ভরছে। ভাটাইচরের রিাই েেত কথা হয় আমেনা বেগমের সাথে। তার কথা, "আমরা বাপ গরিব মানুষ। রিাই তে কইরা চারটা ডাল-ভাত পেটে দিবার পারি। এইডা আমাগো সুখ।" ভাটেরচরের মতো দাউদকান্দির গঙ্গাপ্রসেদ,বাহেরচর, হাসনাবাদ, গোলাপীরচর, চাঙ্গকান্দি, চরবাউইস্যা, পশ্চিমকান্দি, বকতারকান্দি, বড়কান্দি, মধ্যকান্দি, দণিকান্দি, ময়নারকান্দি, টেকপাড়া, শানত্মিনগর, নয়াকান্দি, ফরাজেকান্দি, নয়াহাসনাবাদ, দুধগাটা, কুমিলস্নার কোরারচর, গুয়াগাইচা, চৌদ্দআটিসহ বহু এলাকার প্রায় দেড় হাজার পরিবার রিাই চাষের সাথে জড়িত।
সাধারণত শীতকালের শেষদিক রিাই চাষের উপযুক্ত সময়। তাছাড়া সারা বছরই এর আবাদ করা যায়। গরমে রিাইর চাষ হলেও ফলন হয় কম। ফলে গরমে না লাভ না লোকসান_ এ হিসাব করেই চাষ করতে হয়। শুরম্নতে েেত মই দিয়ে বীজ বপন করতে হয়। অনেক চাষী বগুড়া থেকে ৭শ' হতে ১ হাজার টাকা কেজি দরে বীজ কিনে আনে। চারা গজানোর সাথে সাথেই পোকা থেকে রা পাবার জন্য চ্যাম্পিয়ন ও পিজিয়ন ওষুধ ছিটাতে হয়। এ ওষুধে গাছও ঠা-া থাকে। আবার অনেক চাষী নিজেই বীজ উৎপাদন করে চাষ করে। শীতকালে রিাইর উৎপাদন সবচেয়ে বেশি হয়। এ সময় কানিপ্রতি রিাই হয় ২০/২২ মণ। গরমে এর উৎপাদন কমে আসে। এ সময় কানিপ্রতি ৭/৮ মণ রিাই উৎপাদন করা যায় বলে স্থানীয় চাষীরা জানান।
লাভ-লোকসানের হিসাব নেই এ এলাকার রিাই চাষীদের। তাদের একটাই কথা , "আমরা চারটা ডাল -ভাত খাইতে পারতাছি। এইডাই সুখ। তাছাড়া আমাগো কষ্টের ফসল হারা দেশের মাইনসে খায়। এইত্তে সুখ আর কী আছে?" এই এলাকার করিম মিয়া বলেন, বাপ, আমনেগো দোয়ায় ভালোই আছি। বছরে এক কানিতে লাভ হয় ৩/৪ হাজার টাকা। সরেজমিন এলাকার চাষীদের সাথে কথা বলে বোঝা যায়, খুব বেশি কিছু পাবার আশা তাদের নেই। নেই অট্টালিকা আর প্রাচুর্যের স্বপ্ন। নেই রাজনীতি নিয়ে তাদের মাথাব্যথা। জানা যায়, বিঘাপ্রতি বছরে খরচ হয় ৩ হাজার টাকা। বছরসমেত খরচ গিয়ে লাভ হয় ৩/৪ হাজার টাকা। বসত্মাপ্রতি বিক্রি হয় ৩/৪শ' টাকা। রিাই বিক্রির স্থানীয় দু'টি বাজার ছাড়া আর তেমন কোন বাজার নেই। স্থানীয় বাটেরচর ও দণিকান্দি এলাকায় বিকেলে বসে বাজার। এখান থেকেই ট্রাক ও বিভিন্ন যানবাহনে ঢাকাসহ দেশের বাজারগুলোতে রিাই যায়।
এলাকার গাফ্ফার মিয়ার স্ত্রী আমেনা বেগম বলেন, "ভাইসাব, কী যে কন না! কাম করতে শরম কিসের? হেতানের লগে আইছি। হেতার উপকার অইতাছে না? চরবাউইস্যা গ্রামে কথা হয় কাদির মিয়ার স্ত্রী আকলিমা বেগমের সাথে। তিনি বলেন, আমাগো কাম আমরা করতাছি। মাইনসেরে পয়সা দেওন লাগে না। এন যদি একটা মানুষ খাডাইতো তয় হেরে পয়সা দিতে অইতো। এইডা তো বাইচ্যা গেলগা। তয় ভাই, আমাগো লাইগ্যা দোয়া কইরেন। আলস্নার রহমতে ভালোই আছি।" রিাইর চরের ৪৫টি গ্রামে প্রানত্মিক চাষীদের সংখ্যা অনেক। শুধু রিাই চাষ করে তাদের সংসার চলে না বলে তারা অন্যান্য কাজ ও চাষাবাদ করছে। শানত্মিনগর এলাকার প্রানত্মিক চাষী ইসমাইল বলেন, "ভাই কী করমু কন? ১০ জনের সংসার। আলস্নার মাল ৮ জন। এ্যাত্ত বড় সংসারডা কেমনে চলে কন? এক প্রশ্নের জবাবে ইসমাইল বলেন, ভাই ফ্যামিলি-ফুমিলি আমি বুঝি না। আমার বউও বোঝে না। পোলাপাইনগো রিাই কামে লাগাইছি। কাছে ভিত্তে স্কুল নাই। বড় কতা, পেট চালামু, না পোলাপানগো লেহাপড়া করামু? কন কী করতাম?" এই বলে ইসমাইল কেঁদে ফেলেন।
ভাল বলতে কোন কিছু নেই এ চরের মানুষদের। তবে তারা এতটুকু স্বীকার করে, খেয়েপরে কোনমতে বেঁচে আছে। সে বেঁচে থাকার স্বাদ সবার মাঝেই বিরাজমান। কারও বেঁচে থাকার স্বাদ অট্টালিকা ও গাড়িতে চড়ে, কারও বেঁচে থাকা চারটা ডাল-ভাত ও ছিন্নবস্ত্র পরে। সুখের তরে সব মন্দ কিছু ভুলে এই চরের মানুষ আজও বেঁচে আছে। বেঁচে আছে সবার তাগিদে।
_মীর আবদুল আলীম, রূপগঞ্জ

No comments

Powered by Blogger.