আযাদের ফাঁসির আদেশ

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সদস্য (রুকন) আবুল কালাম আযাদের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। আযাদ পলাতক থাকায় তাঁর অনুপস্থিতিতে এ মামলা রায় ঘোষণা করা হয়।
আজ সোমবার বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ রায় দেন। এটি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় করা মামলার প্রথম রায়।
আজ বেলা পৌনে ১১টায় রায় পড়া শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল-২-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। ১১টা পাঁচ মিনিটে রায় পড়া শেষ হয়। এ সময় ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম ছিলেন।
স্থানসংকুলান না হওয়ায় আজ ট্রাইব্যুনাল-২-এর কার্যক্রম ট্রাইব্যুনাল-১-এ বসে। শুরুতে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বলেন, এটা ১১২ পৃষ্ঠার একটি রায় এবং এখানে ১৩৪টি অনুচ্ছেদ রয়েছে।
আযাদের বিরুদ্ধে মামলায় গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়। আযাদের বিরুদ্ধে মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি ছিলেন সাহিদুর রহমান। এ মামলায় রাষ্ট্রনিযুক্ত আসামিপক্ষের আইনজীবী ছিলেন আবদুস শুকুর খান।

ট্রাইব্যুনাল ঘিরে কড়া নিরাপত্তা
রায় ঘোষণা উপলক্ষে পুরাতন হাইকোর্ট ভবন এলাকায় স্থাপিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ঘিরে আজ কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়।
ট্রাইব্যুনালের পশ্চিম দিকের গেট (মাজারসংলগ্ন) সকাল নয়টা পর্যন্ত আটকানো ছিল। পূর্ব দিকের গেটটি (শিশু একাডেমিসংলগ্ন) বন্ধ বন্ধ করে দেওয়া হয়। দুই দিকে বিপুলসংখ্যক দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করা হয়। সকাল সোয়া আটটার দিকে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিট ট্রাইব্যুনাল এলাকায় অবস্থান নেয়।
পুলিশের রমনা জোনের ডিসি সৈয়দ নুরুল ইসলাম প্রথম আলো ডটকমকে বলেন, রায় ঘোষণা উপলক্ষে ট্রাইব্যুনাল এলাকায় কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

মামলা ও বিচার কার্যক্রম:
আযাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের তদন্ত শুরু হয় ২০১১ সালের ১০ এপ্রিল। এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নূর হোসেন।
গত বছরের ২৫ মার্চ রাষ্ট্রপক্ষ তদন্তের বিষয়টি ট্রাইব্যুনাল-২-এ আনে এবং ‘সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে’ আযাদকে গ্রেপ্তারের আবেদন করে।
৩ এপ্রিল ট্রাইব্যুনাল আযাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। কিন্তু সেদিন রাজধানীর উত্তরখানে আযাদের বাসভবন ‘আযাদ ভিলা’য় গিয়ে পুলিশ তাঁকে পায়নি। তিনি এর আগেই পালিয়ে যান।
২৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে তাঁকে সাত দিনের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে বলা হয়। তিনি হাজির না হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল তাঁকে পলাতক ঘোষণা করে তাঁর অনুপস্থিতিতে বিচারকাজ শুরু করেন। ট্রাইব্যুনাল ৭ অক্টোবর তাঁর পক্ষে আইনজীবী হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. আবদুস শুকুর খানকে নিয়োগ দেন।
গত বছরের ৪ নভেম্বর আযাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের আটটি অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। ২৬ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়, চলে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত। তদন্ত কর্মকর্তাসহ রাষ্ট্রপক্ষের ২২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়। তবে আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী কোনো সাক্ষী হাজির করতে পারেননি।
২৩ ডিসেম্বর দুই পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয়। ২৬ ডিসেম্বর যুক্তি উপস্থাপন শেষে ট্রাইব্যুনাল মামলার রায় অপেক্ষমাণ রাখেন।

আযাদের বিরুদ্ধে আট অভিযোগ:
ট্রাইব্যুনাল আযাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর ৩(২) ধারায় আট ধরনের অভিযোগ গঠন করেন।
প্রথম অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে আযাদ ও তাঁর সহযোগীরা ফরিদপুর শহরের খাবাশপুর থেকে রণজিত্ নাথ ওরফে বাবু নাথকে ধরে নির্যাতন করেন। তবে রাত দুইটা-আড়াইটার দিকে তিনি পালাতে সক্ষম হন।
দ্বিতীয় অভিযোগ, ২৬ জুলাই আলফাডাঙ্গা থেকে আবু ইউসুফ পাখিকে ধরে এনে ফরিদপুর স্টেডিয়ামে আটক রাখা হয়। আযাদ পাকিস্তানি মেজর আকরামের সঙ্গে আলোচনা করে পাখিকে আটক রাখেন এবং অমানবিক নির্যাতন করেন।
তৃতীয় অভিযোগ অনুসারে, ১৪ মে আযাদ ফরিদপুরের বোয়ালমারী থানার কলারন গ্রামের জমিদার সুধাংশু মোহন রায় ও তাঁর বড় ছেলে মণিময় রায়কে বাড়ির পাশের রাস্তায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বাড়ি ফিরতে বলেন। তাঁরা বাড়ির দিকে রওনা হলে আযাদ পেছন থেকে রাইফেল দিয়ে গুলি করেন। এতে সুধাংশু নিহত ও মণিময় গুরুতর আহত হন।
চতুর্থ অভিযোগ, ১৬ মে আযাদ রাজাকারদের নিয়ে সালথা থানার (সাবেক নগরকান্দা) পুরুরা নমপাড়া গ্রামে মাধবচন্দ্র বিশ্বাসের বাড়িতে লুটপাট করেন। মাধবকে বাড়ি থেকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে আযাদ গুলি করে হত্যা করেন।
পঞ্চম অভিযোগ অনুসারে, ৮ জুন আযাদ ও তাঁর চার-পাঁচজন সহযোগী বোয়ালমারীর নতিবদিয়া গ্রামের এক হিন্দু বাড়িতে দুই নারীকে গণধর্ষণ করেন।
ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়, ৩ জুন আযাদ ও তাঁর সহযোগীরা সালথা থানার ফুলবাড়িয়া গ্রামের হিন্দুপাড়ায় লুটপাট শেষে চিত্তরঞ্জন দাসকে গুলি করে হত্যা করেন।
সপ্তম অভিযোগ অনুসারে, ১৭ মে আযাদ ৩০-৩৫ জন রাজাকারকে নিয়ে বোয়ালমারীর হাসামদিয়া গ্রামের হিন্দুপাড়ায় নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শরত্চন্দ্র পোদ্দার, সুরেশ পোদ্দার, শ্যামাপদ পোদ্দার, জতীন্দ্র মোহন সাহা, নীল রতন সমাদ্দার, সুবল কয়াল এবং মল্লিক চক্রবর্তীকে হত্যা করেন। সেখান থেকে হরিপদ সাহা ও প্রবীর কুমার সাহা ওরফে পুইট্যাকে অপহরণ করে ময়েনদিয়া বাজারের নদীর ঘাটে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
অষ্টম অভিযোগ অনুসারে, ১৮ মে আযাদ সাত-আটজন রাজাকারকে নিয়ে সালথা থানার উজিরপুর বাজারপাড়া গ্রামের এক সংখ্যালঘু তরুণীকে অপহরণ করে খাড়দিয়া গ্রামের চান কাজীর বাড়িতে আটকে রেখে নির্যাতন করেন। সাত-আট দিন পর ওই তরুণী মুক্তি পান।

No comments

Powered by Blogger.