পলিনেশিয়ান আনন্দ সন্ধ্যা ও ঐক্য ভাবনা- সিডনির মেলব্যাগ থেকে ॥ অজয় দাঁশ গুপ্ত

বহুজাতিক দেশ অস্ট্রেলিয়া। এ দেশে বসবাস না করলে এত জাতির মানুষের দেখা পেতাম না। পাশের দেশ ভারতকে আমরা সে জাতীয় মনে করি বটে, তবে তার বৈচিত্র্য এখানকার মতো আন্তর্জাতিক নয়।
উপমহাদেশের আবহাওয়ায় লালিত ভারতের মানুষ মূলত আর্য ও দ্রাবিড় এই দুই ভাগে বিভক্ত। এখানে সত্যিকার অর্থে ছত্রিশ জাতি বারো রকমের মানুষ। সংস্কৃতি ও নানা মাপের নানা ধরনের। পলিনেশিয়ান নামে পরিচিত সাগর পারের দ্বীপ দেশগুলো নিয়ে আমাদের দেশের কৌতূহল খুব সীমিত। সত্যিকার অর্থে আমরা এদের খবর জানি না। আর জানলেও আগ্রহ প্রকাশ করি না। ধারণা করি, ভৌগোলিক দূরত্ব এবং দুর্গম যোগাযোগ যেমন কারণ তেমনই মুখ্য কারণ এই দেশগুলোর আন্তর্জাতিক শক্তিভিত্তিক অবস্থান। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এদের চেয়ে আরও দূরের দেশগুলো আমাদের মিডিয়ার শিরোনামজুড়ে থাকে। সেসব দূরগামী দেশের ফ্যাশন, জীবনযাপন, শিক্ষা-সংস্কৃতি এমন কি শাসন ব্যবস্থাও আমাদের নখদর্পণে। আমরা প্রয়োজন মতো অনুসরণ বা তাদের আত্মস্থ করতেও অভ্যস্ত কিছু নই। ইতিহাস নির্মাণ অথবা নিয়ন্ত্রণে পারদর্শী আমেরিকা ইউরোপ তাই সুদূর বঙ্গদেশেও প্রবল প্রতাপে বিরাজমান। অথচ প্রশান্ত পারের ছোট দেশগুলো নিজেদের শিল্প-সংস্কৃতি জীবনের উপাদানে আকর্ষণীয় আমাদের সমগোত্রীয় হবার পরও উপেক্ষিত। কথায় বলে বীরভোগ্যা বসুন্ধরা। অত যে দূরের দেশ পর্তুগাল, পৃথিবীর মানচিত্রে আরও দূরের রাষ্ট্র আর্জেন্টিনা, তারপরও পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কোদাগামাকে জানি আমরা। চিনি অন্তরের প্রতীক বিল্পবী চে’ গুয়েভারাকে, কারণ তাঁরা বীর ছিলেন। দুনিয়া জয়ের নেশায় পৌঁছে গিয়েছিলেন দেশ থেকে দেশান্তরে। এমন কোন উজ্জ্বলতা নেই এই দেশগুলোর। সত্যি বলতে কি, অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসী না হলে অনেকগুলোর নামও জানতাম না। জেনে অবাক হবার মতো অনেক তথ্য আর বিস্ময় এদেরকে আপন করে তোলে। দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর একটি দুটিতে স্থানীয় মুদ্রার নাম টাকা, কেউ কেউ ‘ভাত’ও বলে। কি অদ্ভুত মিল। মিল আছে দেশ শাসনের ঐতিহ্যেও। সবচেয়ে বেশি মিলে যায় আদবকায়দা। আমাদের মতো পরিবার প্রীতি আর যৌথ পরিবারে আস্থাশীল পলিনেশিয়ান দ্বীপের মানুষ। তাঁদের জীবনবোধও অনেকাংশে আমাদের সমার্থক। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাঁদের, এখনও বাস্তবে পরনির্ভরশীল আর প্রকৃতিগত কারণে কোণঠাসা তাঁরা। শ্বেতাঙ্গ শক্তির চেহারা বরাবরই দ্বৈত। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডের প্রতাপে এরা রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বাধীন হবার পরও অনেক ক্ষেত্রে এদের কাছেই জিম্মি হয়ে আছে। এদের বহির্বিশ্ব বিষয়ক নীতি আন্তর্জাতিক মিত্রতা এমনকি অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষায় এরাই নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায়। দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোতে বাণিজ্য ব্যবসায় চায়নিজদের আধিপত্য আছে। আছে মালয়েশিয়ানরাও। কিছু দিন আগে এই নিয়ে মাহাথির ও জন হাওয়ার্ডের বাগ্যুদ্ধ দেখেছি আমরা। পাপুয়া নিউগিনির বিস্তৃত বনাঞ্চল আর কাঠের ব্যবসা নিয়ে এই লড়াই এখনও শেষ হয়নি। শেষ হয়নি অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তপেক্ষ। কিন্তু এটা মানতে হবে, এই রাষ্ট্রগুলোর উত্তেজনা বা উন্মাদনা আমাদের মতো তীব্র নয়। শীতল আত্মসমর্পণে এরা ভীরু হলেও শান্তিতে আছে। ভীরু হবার কারণ ছিল না এদের। দশাসই চেহারা আর প্রচ- সাহসী দ্বীপের পুরুষগুলোর বল ধ্বংসে মোক্ষম দাওয়াই ধরিয়ে দিয়েছে বিচক্ষণ প্রভুরা। নারী, সুরা আর যৌন উন্মাদনায় ভাষা সংস্কৃতি পরিচয় ভুলে এরা আজ এলভিস প্রিসলি, জ্যাকসন বা অন্য কেউ হতে ব্যগ্র। সংস্কৃতি ধ্বংসই যে একটি জাতির মেরুদ- ভেঙ্গে দেয়ার জন্য যথেষ্ট সে সত্য পলিনেশিয়ান দেশগুলোতে দিবালোকের মতো স্পষ্ট। বারান্তরে এদের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা বা অন্যান্য ব্যবসার কথা বলব। যে কারণে আজ এই প্রসঙ্গ তাতে ফিরে আসি। গত সপ্তাহে স্ত্রীর বান্ধবীর কল্যাণে দ্বীপ দেশ ‘কুক আইল্যান্ডের’ সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় গিয়েছিলাম। পোশাকে দ্বীপ আবহ, নারিকেল ছোবড়ার বিকিনি আর পুরুষের গলায় শামুকের মালা বটে। গানের ভাষা, যন্ত্রের ভাষা ও আমেজ কিন্তু ইউরোপীয়। হলিউডের ব্যর্থ অনুকরণে গীত গানগুলোর সঙ্গে ছিল অনবদ্য দ্বীপ দেশীয় নাচ। শুনতে শুনতে দেখতে দেখতে আমার মনে হচ্ছিল কত তুচ্ছ কারণে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হই আমরা। আমাদের অতীত জুড়ে বায়ান্ন, একাত্তর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বঙ্গবন্ধু তারপরও কলহে নিমজ্জিত বাঙালী। ভুলে যাই ঘাড়ের কাছে হিন্দীর নিশ্বাস আর চেপে বসা উর্দুর হাত থেকে পরিত্রাণ দিয়েছিল এরাই। ভাষা, গান, কবিতা, নাচ আমাদের একান্ত নিজস্ব। এই অর্জন এবং ভালবাসার ফসল বাংলাদেশ শক্তিশালী প্রতিবেশীর কাছে, পাশে থেকেও স্বতন্ত্র। এমনকি রবীন্দ্রনাথের মতো পূর্বাধিকারও সে তার নিজের করে নিয়ে ফেলেছে। পলিনেশিয়ানদের দুর্ভাগ্য, নিজের সংস্কৃতি বিলিয়ে তারা এখন দেউলিয়া। অনুষ্ঠানটির বিরতিতে স্ত্রীর বান্ধবী এসে দেখা করে গিয়েছিলেন। পোশাকে দ্বীপবাসিনী আদিবাসীদের ধাঁচ, কেতাদূরস্তে আবারও ইংরেজ। তার চিবুক চুম্বনে বিশ্ব কমল ফোটে কিনা জানি না। তবে এটুকু বুঝতে পারি, পলিনেশিয়ানরা মূলত আমাদের লোক। এই দেশগুলো বা জাতিসত্তার বিষয়ে আমাদের আগ্রহ বাড়লে লাভ বাদে ক্ষতি নেই। একদিকে ইউরোপীয় ইংরেজ আমেরিকার প্রতি দুর্বলতা ও নির্ভরতা কমবে, অন্যদিকে এদের সংস্কৃতি শিখবে আমাদের শুদ্ধতা, দেবে আর নেবে মেলাবে মিলিবে এই ভরসায় এশিয়ার বৃহত্তর ঐক্য প্রার্থিত এবং তা হলে সবারই মঙ্গল হবে।
ফধংমঁঢ়ঃধধলড়ু@যড়ঃসধরষ.পড়স

No comments

Powered by Blogger.