‘আল্লাহ পাকিস্তান কো হেফাজত করে’ by মহিউদ্দিন আহমদ

পাকিস্তান জামানায় পাকিস্তান নামের এই দেশটিতে আমি চার, চারটি বছর কাটিয়েছি। পাকিস্তানের করাচী ইউনিভার্সিটিতে এমএ পড়েছি ১৯৬৪-৬৫ সালে ‘ইন্টারউইং স্কলার’ হিসেবে।
একই বছর ভিন্ন একটি বৃত্তি নিয়ে তওফিকÑ ডক্টর তওফিক-ই এলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম গেল লাহোরে। পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি থেকেই তওফিকের এমএ ডিগ্রী। আমরা ঢাকা ইউনিভার্সিটির ইকোনমিকস ডিপার্টমেন্টে ৬১-৬৪ শিক্ষা বছরগুলোতে একই অনার্স ক্লাসের ছাত্র ছিলাম। আমাদের ইকোনমিকস ডিপার্টমেন্টের আর এক বন্ধু ফজলুল হকও একই বছর ১৯৬৫ সালে ‘ইন্টারউইং স্কলার’ হিসেবে এমএ করেছিল করাচী ইউনিভার্সিটিতে। ফজলুল হক, পরে পাকিস্তান ক্যান্টনমেন্ট এক্সিকিউটিভ সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা হিসেবে শেষ জীবনে ‘ইন্টারন্যাশনাল জুট অর্গানাইজেশন’-এ পাট বিশেষজ্ঞ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে; এখন তার অবসর জীবন, নিজ বাড়িতে, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে।
ফজলু এবং আমিÑআমাদের সঙ্গে আমাদের আরও এক সতীর্থ বন্ধু, কমার্সের আনোয়ারুল ইসলামও ছিল, পিআইএর একই ফ্লাইটে আমরা ২০ জনের একটি গ্রুপ প্রথমে লাহোর গিয়েছিলাম লাহোরেই পড়ব বলে। কিন্তু লাহোর গবর্নমেন্ট কলেজ হোস্টেলে আমাদের প্রথম অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না। বড় বড় আটার রুটি, সঙ্গে ডাল, ছোলা সিদ্ধ আমাদের খেতে দেয়া হয়েছিল। ভাত-মাছে অভ্যস্ত আমরা দুই বাঙালীÑ ফজলু এবং আমি সিদ্ধান্ত নিলাম করাচীতে অনেক বেশি বাঙালীর বাস, কাছে দূরের আত্মীয়স্বজনও আছে আমাদের। ওখানে, করাচী গেলে অন্তত মাঝেমধ্যে ভাত খাওয়া যাবে; সুতরাং আমরা দু’জন ‘হিজরত’ করলাম লাহোর থেকে করাচীতে, ‘খাইবার মেল’ নামের ট্রেনে। বোধ হয় ২৩ ঘণ্টা লেগেছিল। তবে দু’জন ছিলাম বলে ভালই লেগেছিল সেই ‘জার্নি বাই ট্রেন।’ এই ট্রেন জার্নিতেই ‘রুরাল‘ পাকিস্তানের সঙ্গে প্রথম পরিচিত হলাম।
১২ বছর আগে ২০০০ সালের নবেম্বরে ব্যক্তিগত এক সফরে পাকিস্তান গিয়েছিলাম বোধ হয় শেষবারের জন্য। ১৯৬৯-এ লন্ডনে পাকিস্তান হাইকমিশনে থার্ড সেক্রেটারি হিসেবে বদলি হয়ে ইসলামাবাদ ছাড়ার পর ৩১ বছর পর এই আবার পাকিস্তানে। এই সফরকালে কখনও কখনও খুব স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছিলাম। ১৯৯৮ সালে তেহরান থেকে এক সরকারী সফরশেষে ফিরতি পথে শুধু করাচীতে দুইদিন ছিলাম। করাচীতে তখন আমাদের ডেপুটি হাইকমিশনার আবদুর রহিম। তার এবং তার স্ত্রী শিপ্রার আপ্যায়ন-আতিথেয়তার সঙ্গে ‘বার্ড’Ñ কুমিল্লার ‘বাংলাদেশ একাডেমি অব রুরাল ডেভেলপমেন্ট’-এর প্রতিষ্ঠাতা কুমিল্লা তথা উপজিলা পদ্ধতির প্রবর্তনকারী ‘পাইওনিয়ার’, আখতার হামিদ খান; শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নাতনি আখতার সোলায়মান-আহমেদ সোলায়মান দম্পতির একমাত্র সন্তান মুন্নী, ব্যারিস্টার শাহিদা জামিলের সঙ্গেও তখন দেখা করার, কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম। দেখা করেছিলাম করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ইকোনমিকস-এর অধ্যাপক, পরে করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর এবং জর্ডানে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ডক্টর এহসান রশীদের সঙ্গে। করাচী বিশ্ববিদ্যালয়েও গেলাম ৩০ বছর পর আবার। আর গেলাম মুসা কলোনিতে। লাখ লাখ বাঙালীর বাস। রহিম আর শিপ্রাই নিয়ে গেল এই বাঙালী কলোনি দেখাতে। এদের প্রায় সকলেরই ওখানে অবৈধভাবে গমন এবং অবস্থান।
এই সফরকালে করাচী থেকে লাহোর যাই ট্রেনে, লাহোর থেকে ইসলামাবাদে,Ñ কয়েক শ’ কোটি টাকায় পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ কর্তৃক নির্মিত অতি আধুনিক হাইওয়েটি ধরে, বাসে। ইসলামাবাদ থেকে ফেরার পথে প্লেনে।
শিক্ষাজীবন শেষে, পরে ৬৬-৬৭ তে আরও একবছর করাচীতে। এবার গেলাম কাজ করতে, ‘পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস’-এ। ‘প্রফেশনাল ইকোনমিস্ট’ হবো বলে এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষানবিস ‘ট্রেইনি’ হিসেবে এখানে যোগদান। ওখানে থাকতেই পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগ দেয়ার সুযোগ পেয়ে প্রফেশনাল কূটনীতিবিদ হিসেবে প্রশিক্ষণ নিতে করাচী ছেড়ে গেলাম লাহোরে, পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে। এখানে সেই জামানায় সিএসপি এবং পিএফএস-এর নবীন কর্মকর্তাদের একাডেমিক প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। এখানে এক বছর কাটিয়ে গেলাম ইসলামাবাদ,Ñ পাকিস্তানের নির্মাণাধীন নতুন রাজধানীতে। পাকিস্তান ফরেন মিনিস্ট্রিতে এখানে আর এক বছরের হাতে কলমের প্রশিক্ষণ।
পাকিস্তানের তিনটি শহরে, তার মধ্যে করাচী এবং লাহোর পাকিস্তানের দুটি বৃহত্তম শহর, চার চারটি বছর কাটিয়েছি। সুতরাং পাকিস্তানের ঘটনাপ্রবাহ, ভাল-মন্দের খবরে আলোড়িত হই। বিচলিত হই মন্দ খবরে। পাকিস্তানের গত দুই সপ্তাহের ঘটনা প্রবাহেও খুব উদ্বেগ হচ্ছে। ভাবছি আর ভাবছি, দেশটি কোথায় চলেছে? কোথায় এর শেষ?

॥ দুই ॥

১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতার আগে পরে ১০ লাখ মানুষ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রাণ হারায়, আর বাস্তচ্যুত হয় আরও ৭০ লাখ মানুষ। জগত জুড়ে পরিচিত ভারতের এক বিশিষ্ট সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার তাঁর সদ্য প্রকাশিত ‘ইবুড়হফ ঃযব খরহবং’ বইয়ের ১১ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ভারত বিভাগের এই ভয়াবহতা বুঝতে পেরে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আফসোস করে বলেছিলেন আমি এই কি করেছি?
(পাকিস্তানের তৎকালীন পুনর্বাসন মন্ত্রী ইফতিখার উদ্দিন এবং ইংরেজী দৈনিক পাকিস্তান টাইমসের সম্পাদক মাজহার আলী খানের সঙ্গে আকাশ থেকে পূর্ব পাঞ্চাব ও পশ্চিম পাঞ্জাবের রাস্তায় লাখ লাখ মানুষের স্রোত দেখে জিন্নাহ সাহেব মাথায় হাত রেখে হতাশায় বলে উঠেছিলেন, ‘ডযধঃ যধাব ও ফড়হব’)
ভুল এবং হিংসা বিদ্বেষ শুরু থেকেই দুই দেশে। তারপর ভারত যদিও তা সামাল দিতে পারল, পাকিস্তানের যে সঙ্কট, দুর্যোগ, দুরবস্থা জন্ম থেকেই পিছু নিল, তা এখনও চলছে। তার যে কোন শেষ নেই। পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খানকে যখন ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডির এক জনসভায় সা’দ আকবর বাব্রাক নামের এক আততায়ী গুলি করে হত্যা করল, তখন লিয়াকত আলী খানের শেষ কথাগুলো ছিল, ‘আল্লাহ পাকিস্তান কো হেফাজত করে।’
কিন্তু গত ৬৫ বছরের ইতিহাসে দেখা যাচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা পাকিস্তানকে হেফাজত করছেন না। ১৯৪৭ সালে ভারতীয় মুসলমানদের জন্য প্রতিষ্ঠিত এই পাকিস্তানের মসজিদগুলোতে কয়েক দশক ধরে সুন্নিগোষ্ঠী হত্যা করে চলেছে শিয়াদের, আর শিয়ারা হত্যা করে চলেছে সুন্নিদের। তারা হত্যা করে যখন মুসল্লিরা রুকু বা সেজদারত অবস্থায়। যখন ধর্মপ্রাণ মুসলমান থাকে মহান আল্লাহ তায়ালার ধ্যান ধারণায় মশগুল, আল্লাহর কাছে পুরাপুরি সমর্পিত। যখন আর কিছু ভাবার কথা নয়, তখন এই একান্ত দুর্বলতা, অসহায়ত্বের সুযোগে এক পক্ষ নির্বিচারে হত্যা করে অন্য পক্ষকে। যুদ্ধের সময় অনুসরণীয় যে সব আন্তজার্তিক আইনকানুন আছে তাতে উপাসনালয়গুলোতে যে কোন ধরনের হামলা, আক্রমণ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ, ‘হারাম’। কিন্তু পাকিস্তানের মুসলমানরা মসজিদের ভিতর খুনোখুনীকেও হালাল মনে করে। মনে করে ধর্মের নামে!! আল্লাহর বান্দাদের এমন নির্বিচারে হত্যা আল্লাহ তায়ালা কি করে মাফ করেন।
মাত্র গত সপ্তাহে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের রাজধানী কোয়েটা শহরে উগ্র সুন্নিদের একটি জঙ্গী গ্রুপ হত্যা করেছে এক শ’র ওপর শিয়াকে। প্রতিবাদে শহরে অবরোধ চলেছে কয়েককদিন। লাশ দাফন করেনি তিন-চার দিন প্রতিবাদী শিয়া সম্প্রদায়। এমন দাবির মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ইসলামাবাদ থেকে ‘ফরমান’ জারি করে প্রাদেশিক সিভিলিয়ান মুখ্যমন্ত্রীকে বরখাস্ত করে ওখানে প্রাদেশিক গবর্নরের মাধ্যমে সরাসরি কেন্দ্রীয় শাসন চালু করেছে। শিয়ারা তখন সামরিক শাসনের দাবী তুলেছিল;কারণ তাদের ধারণা সামরিক সরকার তাদের বেশি নিরাপত্তা দিতে পারবে।
এই গুরুতর খবরটি চাপা পড়ে গেল দ্রুতই; কারণ, ইতোমধ্যে পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্টের প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী রাজা পারভেজ আশরাফকে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার করার আদেশ দিয়েছেন। এই চরম সঙ্কটকালে তাহিরুল কাদরী নামের দীর্ঘ সাত বছর ধরে কানাডা প্রবাসী এক পাকিস্তানী ইসলামাবাদে ‘নাজিল’ হয়েছেন। তিনি পুরো রাজধানী শহরটিকে কয়েকদিন অবরুদ্ধ রেখে গত বৃহস্পতিবার অবরোধ তুলে নিয়েছেন। এই অবরোধকালে প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি ‘আশ্রয়’ নিয়েছেন করাচী শহরে তার শ্বশুর জুলফিকার আলী ভুট্টোর ক্লিফটন রোডের বাড়িতে। ওদিকে ভারত-পাকিস্তানের কাশ্মীর সীমান্তে গুলিগোলা চলেছে কয়েক দিন, দু’পক্ষের দু’জন করে সৈন্য নিহতও হয়েছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের গুরুতর অভিযোগ. পাকিস্তানী সৈন্যরা এক ভারতীয় এক ভারতীয় সৈন্যের মাথা কেটে নিয়েছে। ঐ সীমান্তও এখন বেশ গরম।
এই বছরের শেষদিকে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা। নির্বাচন পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট জারদারি টিকে থাকতে পারলে, এই-ই প্রথম, পাকিস্তানের ৬৫ বছরের ইতিহাসে, কোন একটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার তার নির্ধারিত পাঁচ বছর মেয়াদ পূরণ করবে।
কিন্তু পূরণ করতে কি পারবে? তাহিরুল কাদরী ছাড়াও সাবেক ক্রিকেট তারকা ইমরান খানও সরকারটির দ্রুত পদত্যাগ দাবি করেছেন। শোনা যায়, এই দুই নেতা পাকিস্তানের দুর্ধর্ষ সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের নির্দেশ পরামর্শে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। তারপর সুপ্রীমকোর্টের প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরীর চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে ইতোমধ্যে এক প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা জিলানি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন কয়েক মাস আগে, এখন তারই স্থলাভিষিক্ত প্রধানমন্ত্রী রাজা পারভেজ আশরাফকে গ্রেফতারের হুকুম, প্রধানমন্ত্রী জিলানীকে অপসারনের মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল আশফাক পারভেজ কায়ানীও, ধরে নেয়া যায়, এখনও অপ্রকাশ্যে একজন তুখোড় খেলোয়াড় হিসেবে পর্দার পেছনে খেলছেন।
তাহলে দেশটি কোনদিকে যাচ্ছে?
পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থা হয়ত একটু ভাল বুঝতে পারব, তাই ব্যক্তিগত লাইব্রেরিটি থেকে খুঁজে বের করলাম ‘ফ্রম পলাশী টু পাকিস্তান’ বইটি। পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল ইস্কান্দর মীর্জার এক ছেলেÑ হুমায়ুন মীর্জা লিখিত এই বইটিতে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই যতসব ষড়যন্ত্র হয়েছে, তার ভাল বর্ণনা আছে। মধ্য ৫০-এর দশকে পাকিস্তানে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত হোরেস হিলড্রেথ-এর মেয়েজামাই হচ্ছেন এই হুমায়ুন মীর্জা। প্রেসিডেন্ট ইস্কিান্দার মির্জা এবং পাকিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হোরেস হিলড্রেথ এর মধ্যে বেয়াই-বেয়াই সম্পর্ক। মীরজাফরের বংশধর ইস্কান্দর মীর্জা কিভাবে আইউব খানের হাতে শাসন ক্ষমতা তুলে দিলে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ১৯৫৮-এর ২৭ অক্টোবর পরাজিত হয়ে দেশ থেকেই বিতাড়িত হলেন তার বর্ণনাও আছে এই বইতে। ইস্কান্দর মীর্জা যখন ১৯৫৮-এর ৭ অক্টোবর সামরিক বাহিনীপ্রধান জেনারেল আইউব খানের হাতে ক্ষমতা তুলে দেন, তার পরের মাস নবেম্বরে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনটি হওয়ার কথা ছিল। এই তারিখটি পরে ১৯৫৯-এর ফেব্রুয়ারিতে নেয়া হয়। সাধারণ নির্বাচনটি হয়ে গেলে পাকিস্তানের জেনারেলদের তখন আর সুযোগ থাকবে না, তাই মেজর জেনারেল মীর্জা এবং জেনারেল আইউব খান দু’জনই তখন চেয়েছিলেন পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা যখন নিজেরা ঝগড়া বিবাদ, ঠেলাঠেলি, খুনোখুনী করে নিজেদের কলঙ্কিত, কলুষিত করে ফেলবে, তখনই তাদের তাড়িয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করার উত্তম সময়। ঠিক হলোও তাই। নির্ধারিত সাধারণ নির্বাচনটির মাত্র চার মাস আগে।
পাকিস্তানে এখনও একই অবস্থা চলছে; বরং বলতে গেলে আরও গুরুতর অবনতি ঘটেছে এখন। পাকিস্তানে তখন ১৯৫৮তে প্রথম মার্শাল শাসন জারীর সময় জঙ্গী মৌলবাদের উত্থান ঘটেনি। ১৯৫৩ এর মার্চ-এপ্রিলে লাহোরে আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে মাওলানা মওদুদীর জামায়াতে ইসলামের উস্কানিতে দাঙ্গা হয়েছে, তবে কঠোর হাতে তা দমনও করা হয়েছিল। মাওলানা মওদুদীকে তখন ফাঁসির আদেশও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন পাকিস্তানে যে মহামারী আকারে জঙ্গীদের উত্থান ঘটেছে। পাকিস্তানে এখন ১৬৬টি জঙ্গী গ্রুপ সক্রিয় আছে বলে ইন্টারনেটে দেখলাম। পাকিস্তানকে দুনিয়ার সবচাইতে ‘ডেঞ্জারাস প্লেস’ হিসেবে বর্ণনা করে ইকোনমিস্ট, টাইম ম্যাগাজিন প্রচ্ছদ কাহিনী করেছে কয়েক বছর আগে। পাকিস্তান এখন আরও ‘ডেন্জারাস’। এই দেশে এখন বাইরের কোন দেশ নিরাপত্তার অভাবে ক্রিকেট খেলতে যায় না। বাংলাদেশও গত সপ্তাহে যায়নি।

॥ তিন ॥

করাচীতে রহিম-শিপ্রা দম্পতির বাসায় অবস্থানকালে পাকিস্তানের সবচাইতে প্রভাবশালী এবং প্রাচীন ইংরেজী দৈনিক ‘ডন’-এ প্রকাশিত একটি লেখায় আমি পাকিস্তানের তখনকার অবস্থা সম্পর্কে যে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা পাই, তা আজ ১২ বছর পরও পাকিস্তানের জন্য প্রায় সম্পূর্ণভাবেই প্রযোজ্য বলে মনে হয়। ২০০০ সালের ৭ নবেম্বর তারিখে দৈনিক ‘ডন‘-এ প্রকাশিত ‘ঐড়ি ঃড় রসঢ়ৎড়াব ড়ঁৎ রসধমব’ শিরোনামের উপসম্পাদকীয়টিতে লেখক শহীদ জাভেদ বার্কি পাকিস্তানের ভাবমূর্তি সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন। এর মাত্র কিছুদিন আগে ইসলামাবাদে সম্ভাব্য বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগকারীদের একটি সম্মেলন হয়েছে। শহীদ জাভেদ বার্কি প্রশ্নের উত্তরে তিনি নিজেই আবার বলছেন, ‘ওঃ রং ষরশবষু ঃড় ৎবধফ ধং ভড়ষষড়ংি : “চধশরংঃধহ ধিং পধৎাবফ ড়ঁঃ ড়ভ ইৎরঃরংয ওহফরধ সড়ৎব ঃযধহ যধষভ ধ পবহঃঁৎু ধমড় ঃড় ধঢ়ঢ়বধংব ধ মৎড়ঁঢ় ড়ভ ৎধফরপধষ সঁংষরসং যিড় বিৎব ধহীরড়ঁং ঃড় ঢ়ৎড়ঃবপঃ ঃযবরৎ ওংষধসরপ ধিুং. ঞযব ষবধফবৎংযরঢ় মৎড়ঁঢ়ং রহ ঃযব হবি পড়ঁহঃৎু ভধরষবফ ঃড় ংবঃ রঃ ড়হ ধ ংঃধনষব বপড়হড়সরপ ধহফ ঢ়ড়ষরঃরপধষ পড়ঁৎংব. ঞযবৎব বিৎব ভৎবয়ঁবহঃ পযধহমবং ড়ভ মড়াবৎহসবহঃ ধহফ ধ মৎবধঃ ফবধষ ড়ভ বীঢ়বৎরসবহঃধঃরড়হ রিঃয ফরভভবৎবহঃ ঢ়ড়ষরঃরপধষ ংঃৎঁপঃঁৎবং. ঘড় সধঃঃবৎ যিড় ধিং রহ ঢ়ড়বিৎ— ধহফ হড় সধঃঃবৎ যিরপয ঢ়ড়ষরঃরপধষ ংুংঃবস ধিং ঢ়ঁঃ রহ ঢ়ষধপব— ঃযব চধশরংঃধহর ংড়পরবঃু ধিং ফড়সরহধঃবফ নু ধ ংসধষষ, ংবষভরংয মৎড়ঁঢ় ড়ভ ঢ়বড়ঢ়ষব যিড় ংযড়বিফ ষরঃঃষব রহঃবৎবংঃ রহ রসঢ়ৎড়ারহম পড়সসড়হ বিষভধৎব.’
(তর্জমা : ইসলামী মূল্যবোধ এবং জীবন পদ্ধতি রক্ষার জন্য অর্ধ শতাব্দীরও আগে কিছু কট্টর মুসলমানের তোষণ করার লক্ষ্যে ব্রিটিশ ভারতের কিছু অংশ নিয়ে পাকিস্তানের সৃষ্টি। কিন্তু নতুন দেশটির নেতৃত্ব দেশটির জন্য স্থায়ী রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করতে ব্যর্থ হলো। বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক পদ্ধতির পরীক্ষা নিরীক্ষা চলতে থাকল দেশটিতে। চলতে থাকল ঘন ঘন সরকার পরিবর্তনও। সরকারে যারাই থাকুক না কেন, যে পদ্ধতিরই সরকার হোক না কেন, দেখা গেল একটি ক্ষুদ্র স্বার্থপর গোষ্ঠী পাকিস্তানের সমাজটিকে দখল করে রেখেছে, সাধারণ মানুষজনের কল্যাণে তাদের কোন আগ্রহ নেই।)
শহীদ জাভেদ বার্কি তারপর পাকিস্তানের প্রকৃত অবস্থা বর্ণনা করার জন্য বার্লিন ভিত্তিক ‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল’ রিপোর্ট থেকে একটি উদ্ধৃতি দেন। ‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল’ পাকিস্তানকে বার বার একটি চরম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বর্ণনা করে পাকিস্তান সম্পর্কে এই কথাগুলো লিখেছে, বলেছেন শহীদ জাভেদ বার্কি। তাঁর ‘ডন’এ আলোচ্য লেখায়।
“চধশরংঃধহ ফড়বং হড়ঃ ংববস রহঃবৎবংঃবফ রহ লড়রহরহম ঃযব সড়ফবৎহ ড়িৎষফ. ওঃ ংববসং হড়ঃ রহঃবৎবংঃবফ রহ ঢ়ঁৎংঁরহম ঃযব াধষঁবং ঃযধঃ যধাব মধরহবফ ঁহরাবৎংধষ ধপপবঢ়ঃধহপব. ওঃ যধং ড়হব ড়ভ ঃযব ষড়বিংঃ ৎধঃবং ড়ভ ষরঃবৎধপু রহ ঃযব ড়িৎষফ. ঞযব পড়ঁহঃৎু ঃৎবধঃং রঃং ড়িসবহ ঢ়ড়ড়ৎষু, ংযড়ংি ষরঃঃষব ৎবংঢ়বপঃ ভড়ৎ ঃযব ৎরমযঃং ড়ভ রঃং সরহড়ৎরঃরবং, ঢ়ঁঃং রঃং পযরষফৎবহ ঃড় ড়িৎশ রহ ভধপঃড়ৎরবং, ধহফ পধৎবং ষররঃষব ভড়ৎ ংধারহম রঃং ঢ়যুংরপধষ বহারৎড়হসবহঃ. ঝঁপয ধহ ঁহংঃধনষব ংড়পরবঃু, ধৎসবফ রিঃয হঁপষবধৎ বিধঢ়ড়হং, ংরঃঃরহম রহ ঃযব সরফফষব ড়ভ ধহ বয়ঁধষষু ঁহংঃধনষব ধৎবধ, ঢ়ৎবঢ়ধৎবফ ঃড় ঃড়ষবৎধঃব ওংষধসরপ ভঁহফধসবহঃধষরংঃ মৎড়ঁঢ়ং যিড় যধাব ৎঁহ ধসড়শ, ঢ়ড়ংবং ধ ৎবধষ ফরষবসসধ ভড়ৎ ঃযব ড়িৎষফ. ডযধঃ ঃড় ফড় রিঃয ঃযব পড়ঁহঃৎু? ঝযড়ঁষফ রঃ নব ধষষড়বিফ ঃড় পৎঁসনষব ধহফ ফবপড়সঢ়ড়ংব ড়ৎ ংযড়ঁষফ ঃযব ড়িৎষফ পড়সব ঃড় রঃং ধরফ?”
(বাংলা তর্জমা : আধুনিক জগতে পাকিস্তান যোগ দিতে আগ্রহী বলে মনে হয় না। সারা দুনিয়ায় সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে এমন আদর্শ মূল্যবোধগুলো গ্রহণেও পাকিস্তান আগ্রহী নয়। শিক্ষার হার পাকিস্তানে খুবই কম, মহিলাদের এই দেশটিতে খুবই অবহেলার সঙ্গে দেখা হয়। এই দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের অধিকারের তেমন কোন স্বীকৃতি সম্মান নেই। এই দেশের শিশুরা ফাক্টরিতে কাজ করে, পরিবেশ রক্ষাকে এই দেশে কোন গুরুত্ব দেয়া হয় না। আশপাশের দেশগুলোতে অস্থিতিশীলতা তার মাঝে এ্যাটমবোমায় সজ্জিত একটি দেশ, এই দেশটিতে আবার মৌলবাদকেও প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছেÑ এই দেশটিকে নিয়ে দুনিয়ার অন্য দেশগুলো কি করবে? দুনিয়াটা এই দুশ্চিন্তায় উদ্ধিগ্ন। আপনা আপনিই দেশটি ভেঙ্গে পড়ুক, পঁচতে থাকুক, এই দেশটির প্রতি দুনিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি এই-ই কি হওয়া উচিত? নাকি, এই দেশটি রক্ষায় দুনিয়াটার এগিয়ে আসা উচিত?)
শহীদ জাভেদ বার্কি এই উদ্ধৃতির শেষে নিজের একটি মন্তব্য যোগ করেছেন, বিদেশী মিডিয়ার এই চিত্র কিন্তু আমাদের সরকারের দেয়া চিত্র থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
আমার মনে পড়ল, আখতার হামিদ খানের কথা। ফরেন সার্ভিসের নবীন এক কর্মকর্তা হিসেবে লাহোরের এক বছর ‘ট্রেনিং-সময়কালের তিন সপ্তাহের মতো সময় আমাদের কাটাতে হয়েছিল আখতার হামিদ খানের প্রতিষ্ঠিত কুমিল্লা একাডেমিতে, বলতে গেলে তার ছাত্র হিসেবেই। ঐ তিন সপ্তাহ আখতার হামিদ খান অন্তত আমার জীবনকে যেমনভাবে প্রভাবিত করেছেন, তার বর্ণনা আর একদিন। আমার করাচী সফরকালে তিনি করাচীর ওরঙ্গী নামের মোহাজেরদের বড় এক উপশহরে তাদের জীবনধারার উন্নয়নে কাজ করছিলেন। এখানে তাঁর অফিসে তাঁর সঙ্গে আলোচনাকালে তিনি ডেপুটি হাইকমিশনার আবদুর রহিমের উপস্থিতিতে আমাকে বলেছিলেন, মহিউদ্দিন সাহেব,পকিস্তানটা বোধ হয় ভেঙ্গেই যাবে, কয়েক বছর আগে ভেঙ্গে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুগোসøাভিয়ার মতো।

॥ চার ॥

পাকিস্তানের দুর্যোগ দুরবস্থা জঙ্গীবাদের উত্থান, পাকিস্তান-ইরান সীমান্তের বেলুচিস্তানের বালুচদের স্বাধীনতার সংগ্রাম-আন্দোলন, প্রতিদিন কাটাকাটি, হানাহানি, আত্মঘাতী বোমা হামলা, লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহের “অপবাধে” মালালা ইউসুফজাইয়ের মতো নিষ্পাপ কিশোরীদের ওপর আক্রমণ, সারা দুনিয়ার নিন্দা, চলছে তো চলছেই। সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। সংকটের সাইজ এবং সংখ্যাও বাড়ছে। তারপরও পাকিস্তান ভেঙ্গে পড়লে তা কারো জন্য মঙ্গলজনক হবে বলে মনে হয় না।
এক পাকিস্তানী নাগরিক খালিদ মোহাম্মদ শেখকে আমেরিকান সরকার ৯/১১-এর হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে শনাক্ত করে তাকে পাকিস্তান থেকে ধরে নিয়ে এখন গুয়ান্তানামো বে’তে আটকে রেখে বিচার করছে। তো খালিদ মোহাম্মদ শেখ তো একশন।
১৮ কোটি মানুষ, তারা তো আরবসাগরে ডুবে যাবে না। তারপর পাকিস্তানের এ্যাটম বোমাগুলো যদি কোনভাবে জঙ্গী তালেবান, আল কায়েদার হাতে পড়ে, তার ব্যবহার কোথায় কিভাবে হবে এই দুশ্চিন্তায় পশ্চিমা দুনিয়া বিশেষভাবে আতঙ্কিত। তাদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। আতঙ্কিত থাকতে হবে ভারত বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোকেও। জঙ্গী গোষ্ঠীগুলো তো ভারতে হামলা চালিয়েছে, হামলা চালিয়েছে তারা বাংলাদেশেও বিএনপি-জমায়াতের দুঃশাসনকালে।
প্লেন দুর্ঘটনায় জেনারেল জিয়াউল হকের মৃত্যুর পর তার জন্য মোনাজাত করা হচ্ছিল গুলশানের আজাদ মসজিদে। তখন প্রতিবাদে আমাদের তওফিক, ড. তওফিক ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম ওয়াক আউট করেছিল, শুনেছিলাম।মুক্তিযুদ্ধে তওফিকের অসাধারণ ভূমিকা এবং তাঁর দেশ প্রেম সর্বজন স্বীকৃত। তবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের যতই ক্ষোভ আক্রোশ থাকুক না কেন, পাকিস্তানের মঙ্গল কামনা করা উচিত, আমাদেরই নিজ স্বার্থেই। দুনিয়ার মানুষ মনে হয় মেনে নিয়েছে, চধশরংঃধহ রিষষ হড়ঃ নব ধ ঝড়সধষরধ ড়ৎ ধ ঝবিফবহ. (পাকিস্তান সোমালিয়া হবে না, পাকিস্তান সুইডেনও হবে না।
পাকিস্তানের পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারদের তাড়াতে গিয়ে আমেরিকা-পাকিস্তান- সৌদি আরব ৮০‘র দশকে আল কায়েদা নামের যে দানব, ‘মনস্টার’ সৃষ্টি করে গেল, তার খেসারত এখন দিতে হচ্ছে এই আমেরিকা, সৌদি আরবকেই। অনেক, অনেক বেশি দিতে হচ্ছে পাকিস্তানকে। আমরা ভুলতে পারি না, মাওলানা ফজলুল হক আমিনীর সেই সেøাগান, ‘আমরা হব তালেবান, বাংলা হবে আফগান।’
পাকিস্তানে যা ঘটছে, সেখান থেকেও আমাদের শিক্ষা নেয়া ‘ফরজ।’

‘শিউলীতলা’, উত্তরা, ঢাকা;
শুক্রবার ১৮ জানুয়ারি ২০১৩
সড়যরঁফফরহধযসবফ১৯৪৪@ুধযড়ড়.পড়স

No comments

Powered by Blogger.