সাংবাদিক হত্যার বিচার যেসব সন্দেহভাজনের ডিএনএ’র সঙ্গে পরীক্ষায় মিল পাওয়া যায়নি, তাদের বিষয়ে সময়-শ্রম ব্যয় না করে অন্যদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা জরুরী

যে কোন হত্যাই বেদনাদায়ক, নিন্দনীয় ও কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। একটি হত্যাকা-ের মাধ্যমে শুধু ব্যক্তির জীবনহানি হয় না; তার সাথে একীভূত হয়ে যায় পরিবার-স্বজনদের হাহাকারও।
শুধু তাই নয়, একটি হত্যাকা- কিংবা অনেক হত্যাকা- মানুষের মানবিকতা, সামাজিক সুস্থিতি ও অগ্রসরমান সভ্যতার বুকে কলঙ্কের স্থায়ী চিহ্ন এঁকে দিয়ে যায়। এ যেন মানুষের আলোকিত সত্তায় ভয়ানক এক পশুর উপস্থিতি।
এমনি এক বেদনাদায়ক ও কলঙ্কজনক হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটে গত বছরের ১১ ফেব্রুয়ারিÑআলোঝলমল এই রাজধানীরই প্রাণকেন্দ্র রাজাবাজারে। সেদিন কয়েক দুর্বৃত্ত ফ্ল্যাট বাড়িতে ঢুকে নির্মমভাবে খুন করে সম্ভাবনাময় সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনীকে। এই হত্যাকা-ের একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী তাদের শিশুসন্তান মেঘ। সাগর-রুনীর হত্যাকা-ের ঘটনায় সারাদেশে, বিশেষ করে সাংবাদিক সমাজে প্রচ- তোলপাড় সৃষ্টি হয়। প্রবল দাবি ওঠে দায়ীদের গ্রেফতার ও শাস্তি প্রদানের জন্য। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দোষীদের শনাক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা সম্ভব হয়নি। তদন্ত চলতে থাকে। এদিকে বিভিন্ন মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ সমবেতভাবে এই হত্যাকা-ের বিচার চেয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন, যা এখনও অব্যাহত। ইতোমধ্যে দুই দফায় সন্দেহভাজন ১৩ জনের ডিএনএ টেস্ট করানো হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। কিন্তু অভিযুক্তরা এখনও সনাক্ত হয়নি। এদিকে দীর্ঘ ১১ মাসেও এই নৃশংস খুনের ক্লু উদ্ঘাটিত না হওয়ায় সাংবাদিক সমাজের মধ্যে ক্ষোভ যেমন বাড়ছে, তেমনি সাধারণ মহলেও আলোচিত হচ্ছে। সিআইডির কাছ থেকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ র‌্যাবের মতো এলিট ফোর্সের হাতে তদন্তভার দেয়ার পরও এখনও কোন কূল-কিনারা করা যাচ্ছে না কেন, এ প্রশ্নটি সামনে চলে আসছে এবং র‌্যাবের দক্ষতা নিয়েও মানুষের মনে সংশয় দানা বাঁধছে।
অবশ্য র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র‌্যাব ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। নানাজনকে গ্রেফতার, জিজ্ঞাসাবাদ, সুরতহাল পরীক্ষাসহ সন্দেহভাজনদের ডিএনএ টেস্ট ইত্যাদি নানা পন্থা অবলম্বন করেছে তারা, এখনও করছে। তাদের চেষ্টা ও আন্তরিকতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলা যায়, তদন্তের পরিসর আরও সম্প্রসারিত ও বহুমাত্রিক করা উচিত। যেসব সন্দেহভাজনের ডিএনএ’র সঙ্গে পরীক্ষায় মিল পাওয়া যায়নি, তাদের বিষয়ে সময়-শ্রম ব্যয় না করে অন্যদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা জরুরি। তদন্তের প্রথম দিকে সাংবাদিক দম্পতির একমাত্র সন্তান মেঘ বলেছিল, সে ‘আঙ্কেল’দের তাদের ঘরে ভাত খেতে দেখেছিল। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এতে স্পষ্ট হয় যে, খুনীরা এই পরিবারের পূর্বপরিচিত এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত। এ কারণে সাগর-রুনীর পেশাগত জগতের লোকদের বিষয়টিও এখানে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হওয়া উচিত। নিজেদের পেশা বা পেশা সংশ্লিষ্টদের বাইরে এত তদন্ত বা অনুসন্ধান চালিয়েও যখন কোন ফল পাওয়া যায়নি, তখন তদন্তের ক্ষেত্র পরিবর্তন করাই যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়। এক্ষেত্রে নিহত সাংবাদিক দম্পতির নিজেদের পেশা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যেও অনুসন্ধান চালানো উচিত বলে অভিজ্ঞমহল মনে করে।
অপরাধ তদন্তে ডিবি বা র‌্যাবের সাফল্যের পরিমাণ কিন্তু কম নয়। স্বল্পতম সময়ে অনেক চাঞ্চল্যকর মামলার রহস্য তারা ইতোপূর্বে উদ্ঘাটন করেছেন, এখনও করছেন। সাগর-রুনীর হত্যা রহস্যটিও একদিন উদ্ঘাটিত হবে বলে আশা করা যায়। সাংবাদিক সমাজ তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, আন্দোলন গড়ে তুলেছেন, যা খুবই স্বাভাবিক। তবে এখানে অধৈর্য বা অসহিষ্ণু হওয়ার অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। কারণ সব মামলার ধরন বা প্রকৃতি এক হয় না। তাই তদন্ত সংস্থাকে আরও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে তদন্ত চালিয়ে যেতে হবে এবং দায়ীদের শনাক্ত করে কঠোর শাস্তির প্রক্রিয়ায় আনতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.