বঙ্গবন্ধুর আগরতলা যাত্রা by মুনতাসীর মামুন

বাংলাদেশে স্বাধীনতার আন্দোলন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দু’ভাবে করেছিলেন। একটি প্রকাশ্য, পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন। অন্যটি অপ্রকাশ্য, স্বাধীনতা আন্দোলনের বন্ধু খোঁজা।
স্বাধীনতার বন্ধু খুঁজতে গিয়ে তিনি ভারতকে বেছে নিয়েছিলেন এবং সেটাই স্বাভাবিক; কারণÑ বাংলাদেশের প্রায় চার দিকেই ভারত। অপ্রকাশ্য এই দিক দিয়ে বঙ্গবন্ধু কখনও কিছু বলেননি; কারণ, বাঙালীদের মনোজগতেও পাকিস্তানী সেই ধারণা অধিপত্য বিস্তার করেছিল যে, ভারত আমাদের শত্রু। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর সবাই অনুধাবন করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত বন্ধু ভারত। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানীদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে এ দেশের সহযোগীরা বার বার বলেছে, ভারতই হচ্ছে আমাদের শত্রু।
বঙ্গবন্ধু অপ্রকাশ্য এ যোগাযোগ সম্পর্কে কিছু না বললেও সম্প্রতি প্রকাশিত কিছু স্মৃতিকথায় এ প্রসঙ্গগুলো উঠে এসেছে। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আছে শশাঙ্ক ব্যানার্জির গ্রন্থে। জনকণ্ঠে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত একটি লেখায় আমি তার বর্ণনা দিয়েছি। ওই বর্ণনায় বঙ্গবন্ধুর আগরতলা যাত্রা নিয়ে একটি অধ্যায় ছিল। নতুন তথ্যের আলোকে বিষয়টি সংশোধন করে নতুন বয়ান তুলে ধরছি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরিকল্পনার জন্য বঙ্গবন্ধু আগরতলা গিয়েছিলেন সুতরাং সেই বিষয়টি নিয়ে তর্ক করার কিছু নেই। কিন্তু তিনি কখন গিয়েছিলন, কার সঙ্গে কী আলাপ হয়েছিলÑ সেগুলো নিয়ে বিতর্ক আছে। সমস্যা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু কখনও আগরতলা নিয়ে একটি বাক্যও উচ্চারণ করেননি। বরং তিনি একে ‘ইসলামাবাদ ষড়যন্ত্র মামলা’ বলেছেন। পাকিস্তান আমলে তিনি আগরতলা গিয়েছিলেনÑ এ কথা বলার উপায় ছিল না। আমরাও এক সময় বিশ্বাস করতাম সত্যি সত্যিই তা ষড়যন্ত্র মামলা।
আগরতলা যাত্রা নিয়ে আমরা কয়েকটি বয়ান পাই। মমিনুল হকের বর্ণনায় পাই কিভাবে তিনি আগরতলা গিয়েছিলেন। সেটি সঠিক বলেই ধরে নিচ্ছি। শশাঙ্ক ব্যানার্জি আগরতলা নিয়ে কিছু উল্লেখ করেননি; তার মানে, তিনি এ সম্পর্কে কিছু জানতেন না বা ১৯৬২ সালের পর মুজিব সেদিকে আর পা বাড়াননি। আমি পুরনো এক লেখায় লিখেছিলাম, শচীন্দ্রলাল সিংহ বলেছেন ১৯৬৩ সাল। সাংবাদিক মানস পাল বেঙ্গল নিউজে এক প্রবন্ধ লিখেছেন। সেখানে তিনি এই সময়টির প্রশ্ন তুলেছেন নতুন এক তথ্যের ভিত্তিতে। সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে তিনিও উপসংহারে পৌঁছেছেন, তথ্য মানলে মুজিব আগরতলা যান ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২ সালে। এটি উপেক্ষা করলে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হয়Ñ তিনি আগরতলা গেছেন ১৯৬৩ সালে। অন্যদিকে, শেখ হাসিনা সম্পাদিত জাতির জনক গ্রন্থে আছে, বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২ সালে। রেজা আলী জানিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু আগরতলা ছিলেন একদিন। এ সমস্ত তথ্য বিবেচনা করে আমি নতুন একটি বয়ান তৈরি করেছি।
প্রথমেই বলে নিই, বঙ্গবন্ধু আচমকা আগরতলা যাননি। মমিনুল হকের স্মৃতিচারণা ও অন্যান্য তথ্য, বিশেষ করে খোয়াইর এসডিওর নোট পর্যালোচনা করে বলা যায়, শেখ মুজিবের আগরতলা যাওয়ার পরিকল্পনা ভারত সরকারকে আগেই জানানো হয়েছিল। বাংলাদেশ প্রান্তে যোগাযোগ রক্ষা করেছিলেন জনাব রুহুল কুদ্দুস। ত্রিপুরা তখনও স্বশাসিত রাজ্য হয়নিÑ আঞ্চলিক পরিষদ ছিল। ১৯৬৩ সালের ১ জুলাই ত্রিপুরা কেন্দ্রশাসিত রাজ্যে পরিণত হয় এবং তারপর শচীন্দ্রলাল সিংহকে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। তিনি ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর ঘনিষ্ঠ।
দিল্লী থেকে সবুজ সঙ্কেত পাওয়ার পর রুহুল কুদ্দুস জানালেন, এবার শেখ মুজিব রওনা হতে পারেন আগরতলা। সরকারী নির্দেশ অনুযায়ী তখন তাঁকে ঢাকার বাইরে যেতে হলে পুলিশের অনুমতি নিতে হতো। সে কারণে, তিনি গা-ঢাকা দিয়ে একদিনের জন্য আগরতলা যেতে পেরেছিলেন। মমিনুল হক খোকা, আলী রেজা কীভাবে তাকে আগরতলা পৌঁছে দিয়েছিলেন, মমিনুল হকের গ্রন্থে তা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখন আগরতলা অংশটুকু উল্লেখ করছি।
মানস পাল তার প্রবন্ধে ১৯৬২ সালে খোয়াইর এসডিও সমরজিৎ চক্রবর্তীর ডায়েরির উল্লেখ করেছেন। সেই সব তথ্য থেকে অনুমান করছি, মুজিব যে আগরতলা আসবেন তা আগরতলা প্রশাসন জানত অর্থাৎ দিল্লী থেকে তা জানানো হয়েছিল। এবং সেখানে মুজিব, নেহেরুর ঘনিষ্ঠ শচীন্দ্রলাল সিংহের সঙ্গে দেখা করবেন তাও নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছিল। শচীন্দ্রলাল যে মুখ্যমন্ত্রী হবেন তাও বোধ হয় নেহেরু ঠিক করে রেখেছিলেন। কারণ, মুজিব যাওয়ার চার মাস পর ত্রিপুরা রাজ্য হিসেবে ঘোষিত হলে শচীন্দ্রলাল তার মুখ্যমন্ত্রী হন।
শেখ মুজিব ঢাকা থেকে লুকিয়ে কুলাউড়া পৌঁছলেন। কুলাউড়ার উল্টো দিকে ত্রিপুরার খোয়াই মাহকুমা। তার এসডিও বা মহকুমা প্রশাসক ছিলেন সমরজিৎ চক্রবর্তী। মানস পাল, এসডিওর ডায়েরিটি খুঁজে পেয়েছেন। এসডিওরা দৈনন্দিন তথ্যাবলি সেখানে টুকে রাখতেন। এই ডায়েরি নির্ভরযোগ্য। ওই আমলে আইএএস অফিসাররা এসব রুটিন কাজে দক্ষ ছিলেন। মানস পাল উল্লেখ করেছেন, ১৯৬৩ সালের ঘটনা হয়ত তিনি ১৯৬২ সালের ডায়েরিতে লিখে গেছেন। সেটি সম্ভব নয় আইএএস অফিসাররা তা করবেন না।
সমরজিতের ডায়েরির পাতাটি ৫ ফেব্রুয়ারি, সোমবার, ১৯৬২ সালের। তিনি ওই পাতায় লিখেছেন, ‘টুডে অ্যাট অ্যাবাউট ১৩০০ আওয়ার্স ওয়ান মি. মুজিবুর রহমান, আমীর হোসেন অ্যান্ড টি চৌধুরী অ্যারাইভড থ্রু আশ্রম বাড়ি। দে হ্যাভ বিন সেন্ট টু তেলিয়ামুড়া আন্ডার ইনস্ট্রাকশন ফ্রম ডি. এম।’ অর্থাৎ ডি. এম বিষয়টি জানতেন এবং এসডিওকে সেভাবে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন।
সমরজিৎ উল্লেখিত, মুজিবুর রহমান হচ্ছেন শেখ মুজিবুর রহমান। তারেক চৌধুরী প্রায়ত অভিনেতা সোহেল চৌধুরীর পিতা। আমীর হোসেনের পরিচয় উদঘাটিত করতে পারেননি মানস পাল। লিখেছেন, হতে পারে তা ছদ্মনাম। আমীর হোসেন নামে একজন আগরতলা আমলার উল্লেখযোগ্য আসামি ছিলেন যিনি বিমান বাহিনীতে চাকরি করতেন। ১৯৬২ সালে তিনি চাকরিতেই ছিলেন, তিনি কি গিয়েছিলেন? কারণ, মুজিবুর রহমান বা তারেক চৌধুরীÑকেউ ছদ্মনাম ব্যবহার করেননি। সে ক্ষেত্রে শুধু আমীর হোসেন কেন ছদ্মনাম ব্যবহার করবেন? অবশ্য, আগরতলা মামলার কাগজপত্রে দেখা যায়, মুজিব ও আমীর দু’জনেরই ছদ্মনাম ছিল।
মানস পাল এ বিষয়ে ত্রিপুরার কয়েকজনের সাক্ষাতকার নিয়েছেন। তারা যে সব তথ্য দিয়েছেন তা পরস্পরবিরোধী নয়।
সমরজিতের অফিসের কর্মচারী ছিলেন সত্য দেব। তার বয়স এখন ৮৬। তিনি জানিয়েছেন, ‘শেখ মুজিব খোয়াই দিয়ে যখন এসেছিলেন তখন আমি তাকে দেখেছি। তবে তা অনেক আগে, খুব সম্ভব ৫০ বছর আগের কথা। আমি তখন এসডিও অফিসের কর্মচারী। আমি শেখ সাহেবকে দেখেছি এসডিও সাহেবের বাসায় ঢুকতে।’ এসডিওর বাসায়ও একটি অফিস থাকে।
এসডিও অফিসের কেরানি অরুণ ভট্টাচার্য মানস পালকে বলেছেন, ‘দুপুরের পর শেখ মুজিব সীমান্ত অতিক্রম করেন। আগে থেকেই এ ব্যাপারে যেসব সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছিল ও ফিসফাস কথাবার্তা হচ্ছিল তাতে অনুমান করে নিয়েছিলাম যে, বিষয়টি গোপনীয়। এসডিও ছিলেন সমরজিৎ চক্রবর্তী এবং বোঝা যাচ্ছিল ওপর থেকে তাকে এ ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। দুপুরের পর আশ্রমবাড়ির কাছে চা বাগানের মধ্যে দিয়ে তিনি সীমান্ত পার হন। তার সঙ্গে আরও তিনজন ছিলেন। তখন আমাদের দু’টি জিপ ছিলÑএকটি এসডিওর এবং আরেকটি বিডিওর।’
‘আমার মনে আছে’, বলেছেন অরুণ ভট্টাচার্য, ‘এসডিও স্যার তখনকার খোয়াই থানার ওসি সুদর্শন করকে বলেছিলেন সর্তক থাকতে এবং নিজেই কাউকে কিছু না বলে সীমান্তে গিয়েছিলেন। আধঘণ্টার মধ্যে জিপে [নং টি আর ১৫৪] তিনজনকে নিয়ে তিনি ফিরে এলেন।’ এদের মধ্যে একজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
জিপটি সরাসরি এসডিওর অফিসে থামে। তারা এসডিওর অফিসে ঢোকেন, তারপর তার ভেতর দিয়ে এসডিওর ড্রইংরুমে আসেন। “এই সময় তাকে আমি দেখি। তার পরনে ছিল পাজামা-পাঞ্জাবী, গায়ে জড়ানো শাল। বেশ লম্বা তিনি। বাকি তিন জনকে আমি চিনি না।” জানিয়েছেন সত্য দেব। সমরজিতের পুত্রের নাম অভিজিৎ, তিনি মানসকে জানিয়েছেন, “আমার মা রমা চক্রবর্তী আমাকে বলেছিলেনÑ তিনি তাদের জন্য কফি তৈরি করেছিলেন।” এর কিছুক্ষণ পর, জানিয়েছেন মানস, শচীন্দ্রলালের ছোট ভাই উমেশচন্দ্র সিং আসেন এবং তারা সবাই এসডিও ও বিডিওর জিপে চড়ে আগরতলা রওনা হন।
শচীন্দ্রলাল এ বিষয়ে একটি সাক্ষাতকার দিয়েছিলেন যা উদ্ধৃত করেছেন সাহিদা বেগম তার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র [ঢাকা, ২০০০] গ্রন্থে।
শচীন্দ্রলাল বলেছনÑ
“১৯৬৩ ইং আমার ভাই এমএলএ শ্রী উমেশলাল সিং সমভিব্যাহারে শেখ মুজিবুর রহমান ১০ জন ত্রিপুরার পানম জিনাই খোয়াই মহকুমা দিয়া আগরতলায় আমার বাংলোয় রাত্র ১২ ঘটিকায় আগমন করেন। প্রাথমিক আলাপ-আলোচনার পর আমার বাংলো হইতে মাইল দেড়েক দূরে ভগ্নী হেমাঙ্গিনী দেবীর বাড়িতে শেখ সাহেব আসেন। সেখানেই থাকা-খাওয়া ব্যবস্থা করা হয়। তারপর মুজিবুর ভাইয়ের প্রস্তাব অনুযায়ী আমি আমাদের প্রধানমন্ত্রী প-িত জওহরলাল নেহেরুর সাথে দেখা করি। আমার সাথে ছিলেন শ্রী রমণ চিফ সেক্রেটারি, তাকে শ্রী ভা-ারিয়া বিদেশ সচিবের কক্ষে রাখিয়া প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করি। তিনি মুজিবুর রহমানকে ত্রিপুরায় থাকিয়া প্রচার করিতে দিতে সম্মত হন নাই। কারণ চীনের সাথে লড়াইয়ের পর এতো বড় ঝুঁকি নিতে রাজি হন নাই। তাই ১৫ দিন থাকার পর তিনি ত্রিপুরা ত্যাগ করেন। সোনামুড়া পশ্চিম ত্রিপুরার এক মহকুমা কুমিল্লার সাথে সংলগ্ন। শেখ মুজিবুর রহমানকে সর্ব প্রকার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়।”
শচীন্দ্রলালের সাক্ষাতকারটি যখন নেয়া হয় তখন তাঁর বয়স অনেক। তাঁর স্মৃতিতে অনেক ফাঁক রয়ে গেছে। খুব সম্ভব আগের পরের কথা তিনি গুলিয়ে ফেলেছেন। তাঁর ভাই উমেশ সিং মুজিবকে নিয়ে আসেন তা ঠিক আছে। তবে সেটি ১৯৬৩ সালে নয়। মুজিব রাতে তাঁর বোনের বাসায় ছিলেন। এটি ঠিক আছে; কারণ, অতি সর্তকতার দরকার ছিল। অরুণ ভট্টাচার্য মানস পালকে জানিয়েছিলেন, মুজিব সীমান্ত অতিক্রমের পর, সীমান্তজুড়ে দেখা গেল পাকিস্তানীরা জিপ নিয়ে ছোটাছুটি করছে। হয়ত, তারা খবর পেয়েছিল শেখ মুজিব সীমান্ত অতিক্রম করেছেন, বা করতে পারেন।
শচীন্দ্রলাল বলেছেন, মুজিব ১০ জনকে নিয়ে দেখা করতে এসেছিলেনÑ তা সম্ভব নয়। হয়ত উমেশের সঙ্গে লোকজন ছিল। তাই সংখ্যাটি তিনি গুলিয়ে ফেলেছেন। কোন অবস্থাতেই মুজিবের পক্ষে আগরতলা ১৫ দিন থাকা সম্ভব ছিল না। সুতরাং, স্মৃতিচারণার এই অংশটুকু সঠিক নয়। আমার অনুমান, বঙ্গবন্ধু আলাপ করেছিলেন সাহায্য-সহায়তা সম্পর্কে। কিন্তু শচীন্দ্রলালের পক্ষে কোন আশ্বাস দেয়া সম্ভব হয়নি; কারণÑ তখন তিনি ক্ষমতায় নন। কিন্তু প্রাথমিক যোগাযোগ হয়েছিল। তিনি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর নেহেরুর সঙ্গে দেখা করেন। এবং খুব সম্ভব তা চীন-ভারত যুদ্ধের [নবেম্বর ১৯৬২] পর। এবং সেখানে মুজিব ও বাংলাদেশ ব্যাপারে আলোচনা করে নেহেরু তাকে যথাযথ নির্দেশ দেন। খুব সম্ভব, এর আগে ডিসেম্বরে তিনি মুজিবের চিঠি পেয়েছিলেন। এভাবে বিষয়টি দেখলে আমাদের বয়ানটি অনেকখানি যৌক্তিক মনে হবে।
এবার ফেরার পালা। এখানেও মানস পাল যে দুটি সাক্ষাতকারের উল্লেখ করেছেন তাতেও খানিকটা বিভ্রম আছে। এবার কেপি চক্রবর্তীর সাক্ষাতকার দেখা যাক। তিনি জানিয়েছেন মানসকেÑ “আমি তখন আগরতলা সদরের এসডিও। চিফ মিনিস্টার ও চিফ সেক্রেটারির নির্দেশে শেখ মুজিবকে শহরের এক জায়গা থেকে তুলে নিই এবং তাকে আগরতলা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাই। মুজিবের বিরুদ্ধে অনুপ্রেবেশর চার্জ আনা হলো। ডিএম এবং এসপি শেখ মুজিবের সঙ্গে জেলে দেখা করেন।”
গৌহাটি হাইকোর্টের আইনজীবী মনিশঙ্কর ভৌমিক মানসকে জানিছেন, তার বাবা ননী গোপাল কর ভৌমিক ছিলেন জেলের তত্ত্বাবধায়ক। ডিএম, এসপি, যখন মুজিবের সঙ্গে দেখা করেন তখন তিনিও বৈঠকে ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী দেখা করতে এসেছিলেন মুজিবের সঙ্গে। কিন্তু ননী গোপাল তখন ছিলেন না। মুজিব আগরতলা জেলে একরাত থেকেছিলেন। আবু তাহের নামে এক সেন্ট্রি তার পাহারায় ছিল।”
এই দুই সাক্ষাতকার বিভ্রান্তিকর। কারণ, তিনি যখন খোয়াইয়ে ঢোকেন তখন তাঁকে খাতির করে এনে আলাপ-আলোচনার পর জেলে রেখে পুশব্যাক করা হবেÑ এটি মেনে নেয়া কষ্টকর। আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য, শচীন্দ্রলাল তখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন না, কিন্তু সবাই তাকে মুখ্যমন্ত্রী উল্লেখ করছেন। কারণ তিনি মুখ্যমন্ত্রী ছিলেনÑ এটিই বড় হয়ে তাদের মনে গেঁথে আছে।
এই দুইজনের সাক্ষাতকার মেনে নিলে আমাদের বয়ানটি এ রকম হবে। সকালেই মুজিবকে জেলে নেয়া হয়। তারা হয়ত একটি রেকর্ড রাখতে চেয়েছিলেন যে, তিনি এখানে এসেছিলেন। আমলারা যা করে আর কী! স্বাভাবিকভাবে ডিএম, এসপি এসেছিলেন পরে শচীন্দ্রলাল তাঁকে বিদায় জানাতে এসেছিলেন। পুরো রাত তিনি থাকেননি। তারপর তিনি ফেরত আসেন। এদের সাক্ষাতকার আমলে না নিলে বয়ানটি হবে এ রকমÑ রাতে অরুন্ধতী হেমাঙ্গিনী দেবীর বাসায় কাটানোর পর সকালে তার দুই সঙ্গী নিয়ে ডিএম, এসপির সহায়তায় কমলা সাগর সীমান্ত দিয়ে শালদা নদী অতিক্রম করে, রাতে ঢাকায় ফিরে আসেন।
মমিনুল উল্লেখ করেছেন, যেদিন রাতে ফিরলেন তিনি, তার পরদিন তাকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ জানতে পারেনি যে, তিনি দেড়দিন ঢাকায় ছিলেন না। এক্ষেত্রে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে প্রায় সব জায়গায় উল্লিখিত ৬ ফেব্রুয়ারি তারিখটি। তারিখটি ৭ হলে আমি যে বয়ানের উল্লেখ করলাম তার সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকে। এবং পরে দেখলাম তারিখটি ৭ ফেব্রুয়ারি খবরের কাগজের খবরেও সেরকম আছে।
এসবি বা স্পেশাল ব্রাঞ্চের রিপোর্টে আছেÑ ৭ ফেব্রুয়ারি জননিরাপত্ত আইনে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী, সরকারী প্রেস নোট অনুযায়ী মঙ্গলবার রাতে ১৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এখানে একটু বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে। ৬ তারিখ রাত ১২টার পর ৭ তারিখ। এসবি রিপোর্টও উল্লেখ করছে ৭ তারিখ। সেদিন হয় সরকারীভাবে বুধবার। ওইদিন শেখ মুজিবসহ আবুল মনসুর আহমদ, কফিনউদ্দিন চৌধুরী, মানিক মিয়া, রণেশ দাসগুপ্তসহ ১৭ জনকে জননিরাপত্তা আইনে আটক করা হয়। [বাংলাদেশ অবজার্ভার, ৮.২.১৯৬২]
বঙ্গবন্ধু মুক্তি পাওয়ার পর পুরো বিষয়টি একবার খতিয়ে দেখেছিলেন এবং তারপর মনস্থ করেছিলেন, নেহেরুর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করবেন। সে কারণেই তিনি এবং মানিক মিয়া ১৯৬২ সালের ডিসেম্বরে শশাঙ্ক ব্যানার্জিকে একটি চিঠি দিয়েছিলেন নেহেরেুকে পৌঁছে দেয়ার জন্য। সেই একবারই তিনি আগরতলা গিয়েছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.