নায়কের নাম হোক 'মাকসুদুল আলম' by শাহনেওয়াজ বিপ্লব

জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম দেশ। ভাষার দিক থেকেও বাংলাদেশ পৃথিবীতে পঞ্চম স্থানের অধিকারী। কিন্তু পৃথিবীর আধুনিক অগ্রযাত্রায় শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি অথবা মৌলিক গবেষণায় বাংলাদেশিদের অবদান বিবেচনা করলে ক্রম-আধুনিকতার পথে আমাদের উল্লেখযোগ্য কোনো অবদান নেই বললেই চলে।


একমাত্র যে নোবেল পুরস্কারটি বাংলাদেশ অর্জন করেছে তার এ ৪০ বছরের জীবনে; তাও মৌলিক কোনো গবেষণায় নয়, বরং শান্তিতে। পৃথিবীর অগ্রযাত্রায় আমাদের ভূমিকা তাই শেষ পর্যন্ত কেবলই শ্রমিকের।
১৬ কোটি মানুষের দেশ হয়েও সব সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা কেন বিজ্ঞান, প্রযুক্তি অথবা গবেষণায় নায়ক হয়ে উঠতে পারে না, সেটি এক প্রশ্ন বটে। আর এ প্রশ্নের উত্তরও নিহিত আছে আমাদের রাজনৈতিক সমস্যা ও সংস্কৃতির মধ্যে। বিএনপির আমলে যে ছেলে উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে গেছে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে; উচ্চশিক্ষা অর্জন শেষে দেশে ফিরে এসে দেখে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সেই বিমানবন্দরের নাম পাল্টে রেখেছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। আওয়ামী লীগ পাঠ্যপুস্তকে এম এ হান্নানকে স্বাধীনতার ঘোষক লিখেছে আর বিএনপি ক্ষমতায় এসে সেই পাঠ্যপুস্তক রদবদল করে দিয়ে লিখছে মেজর জিয়াই স্বাধীনতার ঘোষক। ফলে পাল্টাপাল্টি রাজনৈতিক বিদ্বেষ আর ঘৃণার ভেতর বড় হয়ে ওঠে আমাদের শিশু-কিশোররা। রাজনীতির স্বার্থে পাঠ্যপুস্তক আর ইতিহাস পাল্টে দেওয়ার ফলে আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রকৃত নায়কদের খুঁজে পাওয়া হয়ে ওঠে না ছাত্রছাত্রীদের। পাঠ্যপুস্তকে যা পড়ে, সেসব তারা আর বিশ্বাসও করে উঠতে পারে না। সে জন্য দেখা যায়, সদা সত্য কথা বলবে, মিথ্যা বলা মহাপাপ- এসব সদুপদেশ কোনো আলোড়ন জাগায় না আমাদের ছাত্রছাত্রীদের মনে। কেননা তারা দেখে দেশের অনেক মন্ত্রী থেকে শুরু করে উপদেষ্টা, ব্যবসায়ী, পুলিশ সদস্য- নিজেরাও সেসব আপ্তবাক্য মানেন না।
অন্যদিকে উচ্চশিক্ষা অর্জন শেষে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক হওয়ার জন্য চাকরিপ্রার্থীর উচ্চশিক্ষা বা গবেষণার চেয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে তিনি আওয়ামী লীগ, না বিএনপির সমর্থক সেই পরিচয়। ফলে হতোদ্যম হয়ে পড়েন আমাদের গবেষক, আমাদের বিজ্ঞানীরা। এরপর কেউ আবার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেলেও সাদা দল, নীল দল, গোলাপি দল অথবা ডাক্তার হলে ড্যাব অথবা স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ; রাজনীতির এসব টালবাহানা সামলাতে সামলাতে নতুন চিন্তা অথবা গবেষণার কাজে আর মনোযোগ দেওয়া হয়ে ওঠে না অনেকের পক্ষেই। আর এ সংস্কৃতির কারণেই আমাদের দেশে পৃথিবীর অগ্রযাত্রায় অবদান রাখার জন্য কোনো নায়কের জন্ম হয় না; বরং খলনায়করাই আমাদের দিনযাপনের অংশ। দেশের প্রধান দৈনিকগুলো খুললে তা-ই দেখা যায়; প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহে কোনো না কোনো খলনায়কের ছবি। মন্ত্রীর বাসায় ৭০ লাখ টাকা পৌঁছে দিতে গিয়ে কেউ ধরা পড়ছে, সেটার রেশ শেষ হতে না হতেই হলমার্ক কেলেঙ্কারি, সেটার রেশ শেষ হতে না হতেই ডেসটিনি কেলেঙ্কারি, ডেসটিনি কেলেঙ্কারি চলতে চলতে মন্ত্রী হয়তো একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে টেলিভিশনের টক শোতে ডাকছেন বেয়াদবের হাড্ডি ইত্যাদি। আমাদের দেশে হচ্ছে, যে যত ইতর সে তত বড় নায়ক! আর এসব নায়কের ইন্টারভিউ ও ছবি নেওয়ার জন্য সাংবাদিকদের ক্যামেরা আর কলম নিয়ে নিত্য চলছে দৌড়ঝাঁপ।
আমার আপত্তিটা এখানেই। পত্রিকার প্রথম পাতা থেকে সরিয়ে দিতে হবে এসব খলনায়কের চেহারা ও খবর। আর এসব জায়গায় নিয়ে আসতে হবে মাকসুদুলের মতো আমাদের সত্যিকারের নায়কদের ছবি। আমাদের জাতির সত্যিকারের নায়ক মাকসুদুল আলম ক্ষতিকর ছত্রাকের প্রাণভোমরা চিহ্নিত করেছেন। তাঁর এ গবেষণা আমাদের কৃষকদের জন্য এক নতুন শুভবার্তা। তাঁর গবেষণা ও যুগান্তকারী এই আবিষ্কার বদলে দেবে আমাদের ফসল উৎপাদনের আগামী ইতিহাসও।
তাই মাকসুদুলের মতো বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ আর গবেষকদের আমাদের পাঠ্যপুস্তকে আরো বেশি করে নিয়ে আসতে হবে। পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতায় এবং পাঠ্যপুস্তকে শিশুদের আগ্রহের কেন্দ্রে নিয়ে আসতে হবে বিজ্ঞানী, গবেষক আর সৎ মানুষের ছবি। উপদেষ্টা, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ, আমলা- যাঁরা দুর্নীতি অথবা অসভ্য আচরণের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের ছবি আর খবরগুলো স্থানান্তরিত করে দিতে হবে তৃতীয়, চতুর্থ অথবা পত্রিকার ভেতরের পৃষ্ঠাগুলোয়, যাতে প্রতিদিন সকালে আমাদের শিশুরা নাশতার টেবিলে বসে এসব কুৎসিত মুখ দেখতে না পায়।
যদি এটা করা হয়, গত ৪০ বছরে আমাদের বাংলাদেশ তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো অর্জন করতে পারেনি তো কী হয়েছে? আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ঠিকই একদিন বাংলাদেশকে ধীরে ধীরে তুলে নিয়ে আসবে পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর তালিকায়। আর এই স্বপ্নের বীজ তাদের বুকে এখনই বুনে দিয়ে যেতে হবে আমাদের।

লেখক : গল্পকার, ভিয়েনা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত
shahnewazbiplob@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.