স্বেচ্ছাশ্রম- বৃত্তাকার পথ-নৌপথ উন্নয়নের কল্পকাহিনি by মোহাম্মদ কায়কোবাদ

বিখ্যাত সাময়িকী ইকোনমিস্ট-এর অতি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী অকার্যকর রাজনীতি সত্ত্বেও বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে। এমন খবরের পর আমাদের নেতা-নেত্রীরা নিশ্চয়ই আনন্দে আটখানা হবেন, গর্বে তাঁদের পা দুটি মাটিতে পড়বে না।


সুতরাং অদূরভবিষ্যতে সরকারি উদ্যোগে জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। অবশ্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যদি হয়েই থাকে, তা কিন্তু খেটে খাওয়া পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের শ্রমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ও বিদেশ-বিভুঁইয়ে অবহেলিত, অশিক্ষিত শ্রমজীবী মানুষের রেমিট্যান্সের পয়সায় হচ্ছে, যদিও এই উভয় শ্রেণীর ত্যাগী নাগরিকদের কল্যাণে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কি না সন্দেহ। এমতাবস্থায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দেখতে হলে তা কল্পনার রাজ্যে চলে যেতে হবে। তাই চলুন, আমরা কল্পনার জগতে চলে যাই, যেখানে যা খুশি তাই করা সম্ভব। প্রকৃতপক্ষে আমার এক সজ্জন বন্ধু, যিনি চার দশক আগে ভালো লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন এবং যিনি এখন একেবারেই অকারণে লেখা থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলেছেন, তিনি আমার নিম্নবর্ণিত পরিকল্পনাকে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি শিরোনামে চালাতে বলেছিলেন। তবে বিজ্ঞানের কিছু নেই বলে শিরোনামটিতে বিজ্ঞান শব্দটি ব্যবহার করা হলো না।
যে অভূতপূর্ব আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রাম শুরু এবং তার সফল পরিসমাপ্তি হয়েছিল, তা নিয়ে যেকোনো জাতিই গর্ববোধ করতে পারে। তবে স্বাধীনতা অর্জনের এই বীরত্বগাথা থেকে আমাদের সবার মধ্যে যে দেশাত্মবোধ জাগ্রত হওয়া উচিত ছিল, তা কিন্তু হয়নি। দেশের জন্য নাগরিকদের, বিশেষ করে তরুণ সম্প্রদায়কে, দায়িত্ব পালনের কোনো পরিকল্পিত কর্মসূচিও আমরা তৈরি করিনি, যা শুধু সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতেই নয়, পুঁজিবাদী দেশগুলোতেও প্রচলিত আছে। আমেরিকা-কানাডার মতো সম্পদশালী দেশগুলোতেও স্কুল পাস করার সময় সমাজসেবামূলক কাজের সনদ না পেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যায় না। দেশের প্রতি মমত্ববোধ, ভালোবাসা গড়তে হলে তার জন্য ত্যাগ ও কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমরা এমন কোনো কর্মসূচি এখনো গ্রহণ করতে পারিনি।
বিগত ঈদে আমাদের সড়কপথের অপর্যাপ্ততা আবারও ফুটে উঠেছে। সংবাদে প্রকাশ, ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত যানজট বিস্তৃত। নিশ্চয়ই ঈদে ঘরমুখী যাত্রীদের জন্য এই যানজট চরম হতাশার বিষয় ছিল। সড়কপথের পাশাপাশি নৌপথ, রেলপথকেও পর্যাপ্তভাবে ব্যবহার না করলে এই ঘনবসতিপূর্ণ দেশের যাতায়াতব্যবস্থাকে গ্রহণযোগ্য করা যাবে না। উল্লেখ করা যায়, যাত্রী ও মালামাল উভয় পরিবহনেই নৌ ও রেলপথ সড়কপথের তুলনায় সাশ্রয়ী। অথচ দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই উভয় পরিবহনব্যবস্থাই আমাদের দেশে বেশ অবহেলিত। আমাদের রাজধানীর চারপাশে প্রাকৃতিকভাবেই জলপথ রয়েছে, যার নাব্যতা রক্ষায় কিছু পদক্ষেপ নিলেই এই নৌপথ শুধু যাতায়াতের জন্যই নয়, একাধারে ভ্রমণবিলাস এবং রাজধানীর শ্রেয়তর প্রাকৃতিক পরিবেশ তৈরিতে অবদান রাখতে পারে। অনেক দিন ধরেই রাজধানী উন্নয়ন ও সম্ভাব্য বন্যা থেকে একে রক্ষার জন্য বেড়িবাঁধ নির্মাণসহ নানা প্রকল্পের কথা শোনা যাচ্ছিল, যাতে রাজধানীর চারপাশে বৃত্তাকার রাস্তা ও জলপথের সুযোগ থাকবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার বাস্তবায়ন লক্ষ করা যাচ্ছে না।
ঢাকার চারপাশে যে নৌপথ রয়েছে, তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে এবং নাব্যতা নিশ্চিত করতে নদী-খাল খনন করতে হবে। সেই মাটি ব্যবহার করে তার পাশ দিয়ে চার লেনের বৃত্তাকার রাস্তা তৈরি করলে আন্তনগর বাস, ট্রাক ও অন্যান্য যানবাহন দিব্যি ঢাকা শহরকে পাশ কাটিয়ে গন্তব্যে যেতে পারবে। নৌপথে শহরের সৌন্দর্য উপভোগ করার পাশাপাশি যাত্রীদের একাংশ জলপথে যানজটহীন ভ্রমণ উপভোগ করতে পারবে। উপরন্তু বৃত্তাকার জলপথ শহরের প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় সাহায্য করবে।
তবে এই কর্মযজ্ঞ করতে নিশ্চয়ই বিশ্বব্যাংকের শরণাপন্ন হওয়া, বৈদেশিক ঋণে দেশকে ঋণগ্রস্ত করা কিংবা বিদেশি দাতা সংস্থাগুলো থেকে দুর্নীতির কলঙ্ক দেশের ললাটে লেপন করা ঠিক হবে না। বরং এই গোটা কাজ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে করার জন্য আমাদের তরুণসমাজকে অনুপ্রাণিত করা যেতে পারে। আমাদের প্রজন্ম কিংবা তার আগের প্রজন্মের জীবনে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে বিশাল অবদান রাখার সুযোগ হয়েছিল। এখন যারা তরুণ, তাদের জন্য সেই সুযোগ আর নেই। তবে আমাদের দেশের উন্নয়নে তারা অবশ্যই এই কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণ করে নিজেদের গর্বিত নাগরিক হিসেবে সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারে। ঢাকা শহরের চারপাশে বৃত্তাকার নদীপথ ও রাস্তার সীমানা নির্ধারণ করে সব কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ছুটির দিনে উৎসব করে খাল-নদী খনন এবং সেই মাটি দিয়ে পাশের রাস্তা প্রশস্তকরণের কাজ করা যেতে পারে। এর জন্য কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ছাত্রসংখ্যার অনুপাতে লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেওয়া যেতে পারে এবং পারফরম্যান্স অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে পুরস্কৃতও করা যেতে পারে। আমাদের সুশৃঙ্খল দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ এই কর্মযজ্ঞকে নিশ্চিত সাফল্যে নিতে প্রশংসনীয় মাত্রায় উদ্বুদ্ধ করতে পারে। এ জন্য যে সামান্য যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন, তার জোগান স্থানীয় সরকার দিতে পারে। শীতকালীন ছুটিকে এই কাজের জন্য উপযুক্ত সময় হিসেবে বেছে নেওয়া যেতে পারে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ ও ছাত্রদের এই কাজে উৎসাহিত করতে জনপ্রতিনিধিরা প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করতে পারেন এবং তাই-ই হবে নেতাদের জন্য মানানসই কাজ। এ ধরনের কাজ নিঃসন্দেহে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে।
স্বাধীনতার পর আর আমরা দারুণভাবে জেগে উঠতে পারছি না, যাও করছি তা তিন কদম পেছানোর পর দুই কদম এগোনোর মতো। প্রয়োজন আমাদের সামনে যাওয়া। এ ধরনের একটি কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে দেশ এগিয়ে যেতে পারে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর অনুষ্ঠানে কিংবা নেতা-নেত্রীদের শুভাগমনে দূরদূরান্ত থেকে আবালবৃদ্ধবনিতা যে কষ্ট স্বীকার করে, সময় ব্যয় করে একত্রে মিলিত হয়, একই রকম আগ্রহ নিয়ে এই কাজটি করলে দেশের লাভ হবে, নিজেরাও রাজধানীর যানজট থেকে পরিত্রাণ পাবে, রাজধানীতে শ্রেয়তর প্রাকৃতিক পরিবেশে জীবনযাপন করতে পারবে। পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মকে দেশপ্রেমের আনন্দেও গর্বিত করা যাবে।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।

No comments

Powered by Blogger.