শ্রদ্ধাঞ্জলি- ‘তাঁকে নিয়েই মগ্ন হয়ে থাকি’ by সুচিত্রা সরকার

‘জন্মদিনটা তিনি বিশেষভাবে পালন করতে চাইতেন। “আগুনের পরশমণি” গানটি খুব পছন্দ করতেন। নিয়ম করে প্রতি জন্মদিনে এই গানটি তিনি শুনতে চাইতেন। প্রিয়জনদের সঙ্গে গল্প করতেন।


‘নিজের লেখা কবিতার মধ্যে “কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি”, “আমার কিশোরী মা”, “সময়ের স্মৃতি” এই কবিতাগুলো তাঁর ভীষণ পছন্দ ছিল। কবিতাগুলোর আবৃত্তি শুনতে চাইতেন।’
মাহবুবুল আলম চৌধুরীর জন্মদিন পালনের স্মৃতিকথা বলছিলেন জওশন আরা রহমান। ৭ নভেম্বর কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরীর ৮৬তম জন্মদিন। তাই ক্ষণে ক্ষণে যেন সেই দিনগুলোই ভেসে আসছে জীবনসঙ্গীর চোখে। বেদনাভরা কণ্ঠে বলেন, ‘তাঁকে নিয়ে শেষ জন্মদিন পালন করেছি ২০০৭ সালে। সেবার তাঁর ভীষণ শরীর খারাপ ছিল। এর মধ্যে চট্টগ্রামের লোকজন বলেছিল, কবির জন্মদিনে তাঁকে চট্টগ্রামে নিয়ে যেতে চাই। তিনিও গোঁ ধরলেন। বললেন, ট্রেনে শুয়ে শুয়ে যাবেন।
‘তিনি তো সারা জীবনই কাটিয়েছেন চট্টগ্রামে। সেখানকার নেতা ছিলেন তিনি। সেখানে বসেই তো “কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি” কবিতাটি লিখেছেন। সেখানেই তো তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া হয়েছিল। তাঁর পুরো রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জীবন তো সেখানেই কাটিয়েছেন। শুধু কি তাই! সেই চট্টগ্রামে বসেই তো বিখ্যাতসীমান্ত পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। চট্টগ্রামের মানুষ তো চাইতেই পারে, তাদের প্রিয় নেতাকে, কবিকে—এক দিনের জন্য।
‘তাঁর শরীরের কথা ভেবে আমরা যেতে দিইনি। একটু মন খারাপ করেছিলেন। পরে তারা ঢাকায় এসে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছিল।’
কবির জন্মদিন কি পারিবারিকভাবেই পালন করা হতো?
‘না, প্রতিবার ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী জন্মদিনের আয়োজন করে। সেবারও করেছিল। সেদিন তাঁর বন্ধুরা সবাই এসেছিল। সন্ধ্যাজুড়ে কবিতা পাঠ, গান, আড্ডা আর কত যে গল্প। সেদিন শরীর এত খারাপ ছিল, তবু ভোলেননি। নিজের রচিত কবিতা শুনতে চাইলেন।’
এটুকু বলে খানিকটা থামেন জওশন আরা। সারাক্ষণ নাড়াচাড়া করা স্মৃতি যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
প্রশ্ন করি, মাহবুবুল আলম চৌধুরীর কোন জন্মদিনটা আজও আপনার মনে পড়ে?
মুহূর্তে চোখ আনন্দে নেচে ওঠে তাঁর। বলেন, ‘২০০৬ সালে তাঁর ৮০তম জন্মদিন ছিল। জাতীয়ভাবে জন্মদিন উদ্যাপন কমিটি হয়েছিল। জাতীয় জাদুঘরে সেদিন এত মানুষ এসেছিল! এখনো তাঁর জন্মদিনের তারিখটা এগিয়ে এলেই, ওই জন্মদিনের স্মৃতিটা আমায় তাড়িয়ে বেড়ায়।’
খানিকটা সামলে ওঠেন নিজের মধ্যেই। বলেন, ‘তাঁর স্মৃতি রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছি। তাঁর মৃত্যুর পর প্রতিটি জন্মদিনে কোনো না কোনো বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেছি। গত বছর জন্মদিনে সেলিনা হোসেনের সম্পাদনায় স্মারকগ্রন্থ স্মরণে বরণে বের হয়েছে।’
কবির সঙ্গে প্রথম আলাপ কবে?
প্রশ্নটা শুনেই যেন ঠাকুরমার ঝুলির ভেতর থেকে গল্প বের করে আনলেন।
উচ্ছ্বাসভরা চোখে জানান, ‘সে সময় তিনি অনেক বড় নেতা। আমাদের বিয়ের কথাবার্তা তখন খানিকটা এগিয়েছে। একদিন আমাদের বাসায় এলেন। আমার কাছে একটা স্লিপ পাঠালেন। আমি সেটা না পড়েই মাকে দিয়ে দিলাম। মা বললেন, “ও তোর সঙ্গে কথা বলতে চায়। যা কথা বল!” সেজো ভাইকে সঙ্গে নিয়ে বাইরের ঘরে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তিনি এ-কথা সে-কথা বলে আসল কথা শুরু করলেন। বললেন, “আমি রাজনীতি করি। আমার জীবনে ঝুঁকি আছে। তুমি আমাকে বিয়ে করতে রাজি আছো কি না, তাই জানতে এসেছি।”’
সেই দিনটা যেন তাঁর সামনে আজও স্পষ্ট। বলেন, ‘আমি তখন অনেক ছোট। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেব। তবু বুঝলাম, মানুষটা সর‌্যা, সরল আর ভালো মানুষ। আমার কবিদের প্রতি এমনিতেই আকর্ষণ ছিল। আমি রাজি হলাম। তিনি আমার হাতটা টেনে নিয়ে একটা গোলাপি রঙের রুবির আংটি পরিয়ে দিলেন।’
এতটুকু বলেই ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতটা চেপে ধরলেন। তারপর দেখালেন সেই আংটিটা। বললেন, ‘৬০ বছর ধরে এই আংটিটা আমার সঙ্গী।’ রুবির আংটিটা তখনো হাতে আলতো করে ধরে রেখেছেন। বললেন, ‘মাঝে হয়তো কিছুদিনের জন্য আংটিটা খুলে রেখেছিলাম। তিনি আমায় ছেড়ে চলে যাওয়ার পর এক দিনের জন্যও এটা হাত থেকে খুলিনি।’
তারপর আর আবেগের বাঁধ মানে না। কেঁদে ফেলেন। কাঁদতে কাঁদতেই স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘তিনি রাজনীতিতে ভীষণভাবে জড়িত ছিলেন। রাতদিন ব্যস্ত থাকতেন। আমি কোনো দিন বাধা দিইনি। আমার আইএ পরীক্ষার সময় তিনি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেলেন। আমার মেয়েও তখন ছোট।’
আবার শুরু করলেন, ‘চুয়ান্ন সালের কথা। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের পরপরই পূর্ব পাকিস্তানে ৯২-ক ধারা প্রবর্তন করে জারি করা হয়েছিল কেন্দ্রীয় শাসন। শুরু হলো রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর নির্যাতন। মাহবুব সে সময় আবার আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেলেন। সে সময় আমি বিএ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তখন আমি সত্যিই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম।
‘তাঁর টেবিলের এক কোণে গীতাঞ্জলি থাকত। প্রায়ই সেটা বের করে পড়তেন। এখন আমি তাঁর সেই বইটা পড়ি।’
স্মৃতির জল চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল খানিকটা। সেটুকু মুছতে মুছতে বলেন, ‘তাঁকে নিয়েই মগ্ন হয়ে থাকি।’
সুচিত্রা সরকার

No comments

Powered by Blogger.