গণরায়- পার্পল স্টেটের গাড্ডায় ওবামা-রমনি by শান্তনু মজুমদার

দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাধর মানুষ হিসেবে এই দুনিয়ার মঙ্গলচিন্তার পরিবর্তে নিজ দেশের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র অব্যাহত রাখার বিষয়টি মাথায় রেখেও বারাক ওবামার পুনর্বার জয় কামনা করে এই লেখাটি শুরু হলো।


কারণ, বারাক ওবামা যেমন-তেমন, কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য, পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষা, ভবিষ্যৎবান্ধব প্রযুক্তি, জ্বালানি শক্তির ব্যবহার, ইরানের পরমাণু প্রকল্প, জায়নাবাদী ইসরায়েলের প্রতি সমর্থনের মতো বিষয়গুলোতে মিট রমনি একেবারে রাখঢাকহীন রগরগে, ‘র’। ওয়াইল্ড ওয়েস্ট আমল স্মরণ করিয়ে দেন। ইরানকে খেয়ে ফেলব, যেখানে যত জ্বালানি আছে সব আমেরিকার জন্য নিয়ে এসে উৎপাদন খরচ কমিয়ে দেব, বন্ধুত্বের স্মারকস্বরূপ জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী বলেই যাব। বেশ একটা ব্যাটাগিরি; বাহুবলে লুটে নেওয়ার মতো ব্যাপার আছে রমনিতে। আরেকজন জর্জ বুশের ভার বহন করার মতো অবস্থায় শান্তিকামী পৃথিবী নেই। এসব কারণে ভোটাধিকার থাকুক না থাকুক, সমর্থনে-বিরোধিতায় কিছু হোক না হোক, বিশ্বশান্তির প্রত্যাশায় দুজনের মধ্য একজনকে অবধারিত ধরে ওবামাকে সমর্থন। তবে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, প্রান্তিক বিশ্বের একজন কলাম লিখিয়ের আশা-আকাঙ্ক্ষার কোনটি সত্যে পরিণত হবে, তা এবার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যে স্পষ্ট হচ্ছে না। এর কারণ হাতেগোনা কয়েকটি পার্পল স্টেট! বলতে কি, ৫০টির মধ্যে মাত্র গোটা নয়েক পার্পল স্টেট মিলে মার্কিন নির্বাচনকে এবার জমাটি অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
পার্পল স্টেট কোনগুলো? রেড আর ব্লু মিলে হয় পার্পল। লাল-নীল-বেগুনি-ব্লু ডেমোক্র্যাটদের রং। রেড রিপাবলিকানদের। দুই রং মিলিয়ে দিলে যে রং হয়, তাকে বলে পার্পল। অর্থাৎ কিনা যে স্টেটগুলোতে ডেমোক্র্যাট আর রিপাবলিকানদের সমর্থনের ক্ষেত্রে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ব্যবধান নেই, লাল বা নীল—কোনো দিকেই বেশির ভাগ ভোটার হেলে থাকেন না, সেগুলোর আদুরে নাম হচ্ছে পার্পল স্টেট। এই স্টেটগুলো বহুল পরিচিত সুইং স্টেট নামে। এসব স্টেটে যেকোনো প্রার্থীর পক্ষে পাবলিকের একটুখানি সুইং অপর প্রার্থীর হোয়াইট হাউসের স্বপ্নকে হোয়াইটওয়াশ করে দিতে পারে।
ওবামা হোয়াইট হাউস ছাড়তে চান না আর রমনি সেখানে ঢুকতে চান। যুক্তরাষ্ট্রে তো আর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সামরিক শাসনের সুযোগ নেই, তাই ব্যাপারটা ফয়সালা হয় ভোটে; ৫০টি স্টেটজুড়ে ফয়সালা হয় ভোটে, এ কথাটি ঠিক। কিন্তু ৫০টি স্টেটজুড়ে কথাটি কিছু ব্যাখ্যার দাবি রাখে। এর কারণ হচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনব্যবস্থার বিশেষ বৈশিষ্ট্য তথা ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতির সুবাদে উল্লিখিত পার্পল স্টেটগুলো আশ্চর্য রকমের গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা, যা এবার ওবামা ও রমনির জান হাপিশ করে দিয়েছে। দেশজুড়ে ইলেকটোরাল কলেজের ভোট আছে ৫৩৮টি। সিনেট ও হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভসে নিজেদের যতজন প্রতিনিধি আছেন, ঠিক ততজন ইলেকটোরেট বরাদ্দ থাকেন প্রতি স্টেটের জন্য। আর ইলেকটোরেট মহোদয়েরা ভোট দেন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীকে। এটুকু ঠিক আছে। কিন্তু বিপুল বিভ্রাট কীভাবে জন্ম নেয়? জন্ম নেয় বিশেষ একটি নিয়মের কারণে। নিয়মটি হচ্ছে, নির্বাচনে একজন প্রার্থীর পক্ষে যদি অন্যদের তুলনায় একটি ভোটও বেশি পড়ে, তা হলে ওই প্রার্থী গোটা স্টেটের জন্য বরাদ্দ সব কটি ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে যাবেন, এটা হচ্ছে ‘উইনার টেক অল’ নীতি; তিন কার্ডের জুয়াড়ু এমনকি তিন খান সাহেব হাতে নিয়ে খেলতে থাকা খেলোয়াড়টি কিচ্ছু পাবে না, যদি আরেকজনের হাতে থাকে তিন টেক্কা! নেব্রাস্কা ও মেইন বাদে বাকি ৪৮টি স্টেট এবং ওয়াশিংটন ডিসিতে এই নিয়ম।
এতে সমস্যা কী? সমস্যা আছে। এবারের কথাই ধরা যাক। বাস্তব কারণে ভোট সেই অর্থে বলতে গেলে গোটা নয়েক পার্পল বা সুইং স্টেটে। ফ্লোরিডা, নর্থ ক্যারোলাইনা, কলোরাডো, নেভাদা, আইওয়া, নিউ হ্যাম্পশায়ার, ভার্জিনিয়া, উইসকনসিন ও ওহাইও। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলো ওবামা ও রমনির সব দৌড়ঝাঁপ মূলত এই স্টেটগুলোতে। সোমবার দিন নাগাদ এসে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ এই তালিকা মাত্র পাঁচটি স্টেট রেখেছেন ওহাইও, উইসকনসিন, নিউ হ্যাম্পশায়ার, ভার্জিনিয়া, ফ্লোরিডা। এদিকে বাকি ৪১টি স্টেটে ভোট বলতে গেলে ঠান্ডামারা। কারণ, এগুলোর বেশির ভাগই হচ্ছে সেইফ স্টেট। এগুলোর কোনটিতে ওবামা বা কোনটিতে রমনি ইলেকটোরাল ভোট জিতবেন, তা মোটামুটি স্পষ্ট। এ জন্য পাঁচ ভাগের চার ভাগ স্টেটে ভোটে স্পাইস নেই। প্রার্থীদের যাবতীয় প্রয়াস, মিডিয়ার মনোযোগ, ডলার খরচ—সবকিছু পার্পল স্টেটগুলোকে ঘিরে। সে জন্য আরকানসাস, আলবামা, সাউথ ক্যারোলাইনা, টেক্সাস, মিসিসিপিতে দেখা যায় না ওবামার তেমন কোনো নড়াচড়া। নিউইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া, হাওয়াই, ইলিনয়ে রমনি কোথায়? বুকে মাটি লাগিয়েও প্রথম তালিকার স্টেটগুলোতে ওবামা আর দ্বিতীয় তালিকার স্টেটগুলোতে রমনি জিততে পারবেন না।
এদিকে ব্যাপার হয়েছে কি, হোয়াইট হাউসের জন্য ইলেকটোরাল কলেজের ভোট লাগে ৫৩৮টির মধ্যে ২৭০টি। আর পার্পল স্টেটগুলোর হাতে আছে ১১০টি। তা হলে কমনসেন্স এ কথাই বলবে যে, যেসব স্টেটে জয় নিশ্চিত বা হার অবধারিত, সেগুলোর পরিবর্তে পার্পলদের দিকেই ঝাঁপাতে হবে। দুজনের হাতেই ২০০-এর বেশি ইলেকটোরাল ভোট নিশ্চিত। ওবামা ২২৫-এর মতো; রমনির ২১০-এর আশপাশে। তা হলে ২৭০ ছুঁতে হলে যে ভোটগুলো দরকার, তার জন্য কে যাবে পার্পল স্টেটগুলোর বাইরে শক্তি ক্ষয় করতে? এতে করে কী হচ্ছে? এতে করে দলীয় প্রার্থী নির্বাচন শেষ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই, উদারনীতিক গণতন্ত্রের সম্ভবত প্রধানতম অনুশীলন অর্থাৎ নির্বাচনী উৎসব থেকে বলতে গেলে এক অর্থে দূরে থাকছে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ স্টেট। ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতি আর পার্পল স্টেটগুলোর বদৌলতে অবস্থা এমন যে, সারা দেশে পপুলার ভোট কম পেয়েও স্টেটভিত্তিক ইলেকটোরাল কলেজের ভোট বেশি পেয়ে একজন প্রার্থী জিতে জেতে পারেন। এসব নিয়ে কথা যে হয়নি, তা নয়। দ্য ইউএস ন্যাশনাল আর্কাইভস অ্যান্ড রেকর্ডস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের তথ্য মোতাবেক গত ২০০ বছরে ইলেকটোরাল কলেজব্যবস্থা বাতিলের জন্য কংগ্রেসে ৭০০ বারের বেশি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে। সামনে কী হবে, তা আমরা ও বাইরের মানুষেরা কীভাবে জানব? সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমের সর্বশেষ বিশ্লেষণগুলোর দিকে নজর করে ওবামার জন্য ২৮০-২৯০ ভোটের আশপাশে বরাদ্দ করতে ইচ্ছে করছে আর রমনির জন্য ২৪০-২৫০-এর এদিক-ওদিক। দেখা যাক তেমন কিছু হয় কি না।
শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।

No comments

Powered by Blogger.