একুশের প্রথম কবি by নাসির আহমেদ

'ওরা চলি্লশজন কিংবা আরও বেশী/যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে রমনার রৌদ্রদগ্ধ/কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায়/ভাষার জন্য, মাতৃভাষার জন্য বাংলার জন্য/যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে/একটি দেশের মহান সংস্কৃতির মর্যাদার জন্য/আলাওলের ঐতিহ্য/রবীন্দ্রনাথ, কায়কোবাদ, নজরুলের সাহিত্য ও কবিতার জন্য।


...জালিমের গুলীতে যারা প্রাণ দিল/সেইসব মৃতদের নামে/আমি ফাঁসির দাবী করছি,/যারা আমার মাতৃভাষাকে নির্বাসন দিতে/চেয়েছে তাদের জন্য/আমি ফাঁসি দাবী করছি...' (কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি)_ এই স্তোত্রের মতো জলদগম্ভীর উচ্চারণে যিনি পাকিস্তানি শাসকদের নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রথম লিখিত কাব্যপ্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, তিনি কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী। রাজধানী থেকে অনেক দূরের চট্টগ্রামে বসে একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গুলির খবর পেয়েই প্রায় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি যে কবিতা রচনা করেন আজও তা আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। অসাম্প্রদায়িক সমাজের স্বপ্নে উজ্জীবিত এই কবিতার ছত্রে ছত্রে জীবন্ত হয়ে আছে ইতিহাস। আজ বাংলা ভাষার সেই কিংবদন্তি কবিতার কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর জন্মদিন। ১৯২৭ সালের ৭ নভেম্বর চট্টগ্রামের গহিরায় তার জন্ম। বেঁচে থাকলে নিশ্চিত আজ তার উত্তরার বাড়িতে দেশের কবি-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিকর্মীরা যথারীতি জড়ো হতেন। উৎসবে মুখর হতো বাড়িটি। কিন্তু আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই। রয়ে গেছে তার বিখ্যাত সৃষ্টিসহ অসংখ্য কবিতা, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য আর বিখ্যাত 'সীমান্ত'-এর ঐতিহাসিক সংগ্রহটিও।
'একুশে সংকলন' সম্পাদনার জন্য যেমন কবি হাসান হাফিজুর রহমান পথিকৃৎ হিসেবে চিরস্মরণীয়, তেমনি একুশের প্রথম কবিতা রচনার জন্য মাহবুব উল আলম চৌধুরীও ইতিহাস হয়ে আছেন। জলবসন্তে আক্রান্ত তরুণ কবি তখন চট্টগ্রামে। ঢাকায় গুলিতে ছাত্রহত্যার খবর পেয়ে রাতেই লিখলেন এবং সে রাতেই পুুস্তিকা আকারে মুদ্রিত হয় এই কবিতা। পরদিন চট্টগ্রামের প্রতিবাদ সভায় তা প্রচার আর পঠিত হয়। চলি্লশ ও পঞ্চাশ দশকের কবিদের মধ্যে মাহবুব উল আলম চৌধুরী বিখ্যাতও ছিলেন না, তবু পথিকৃৎ ভূমিকাটি পালন করলেন তিনিই। কারণ, সাহিত্যে তার ছিল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দৃপ্ত অঙ্গীকার। কৈশোর থেকে প্রগতিশীল আন্দোলনে ১৯৫২ পর্যন্ত তার যে সক্রিয় ভূমিকা, তাতে একুশের প্রথম কবিতা অনিবার্যভাবে তার হাতেই রচিত হলো।
সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানে প্রথম অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে ১৯৪৭ সালেই তিনি সম্পাদনা করেছিলেন অসাধারণ একটি সাহিত্য পত্রিকা 'সীমান্ত'। তার সহধর্মিণী জওশন আরা রহমান ও ড. ইসরাইল খানের সম্পাদনায় সীমান্তের সংখ্যাগুলো (১৯৪৭ থেকে ১৯৫২) গ্রন্থিত হয়েছে 'সীমান্ত সংগ্রহ' নামে। 'সীমান্তে'র যে দর্শন, তার মধ্যেই নিহিত ছিল বাঙালির জেগে ওঠার স্বপ্ন। ১৯৫২ সালে হুলিয়া মাথায় নিয়ে না পালাতে হলে সীমান্ত হয়তো বন্ধ হতো না। পত্রিকাটির ভূমিকা ঐতিহাসিক। কবিতা, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য, নাটকসহ বহু গ্রন্থের লেখক তিনি। স্মরণীয় তবু একুশের কবি হিসেবে।
শুধু সীমান্ত সম্পাদনা নয়, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনেও তিনি যুক্ত ছিলেন। '৪৭ সালে প্রকাশিত তার 'বিপ্লব' নামের দ্রোহী গদ্যরচনা নিষিদ্ধ করে সরকার। ১৯৫০ সালে চট্টগ্রামে যে দাঙ্গাবিরোধী আন্দোলন, তাতেও নেতৃত্ব দেন তিনি। পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সাংস্কৃতিক সম্মেলনেও (১৯৫১) ঢাকায় এসেছিলেন তিনি চট্টগ্রামের প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে। চট্টগ্রামে প্রান্তিক ও নবনাট্য সংঘ এবং কৃষ্টি কেন্দ্রেরও প্রাণপুরুষ তিনি। তাই তরুণ বয়সেই তিনি খ্যাতিমান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তত দিনে তিনটি কবিতার বইও প্রকাশ হয়ে গেছে।
সাহিত্যের ক্ষেত্রে যার ভূমিকা এমন প্রগতিশীল, ভাষাশহীদদের রক্ত তাকেই তো সবচেয়ে বেশি আন্দোলিত করবে। আজীবন প্রগতির পথেই হেঁটেছেন তিনি। ভাষা আন্দোলন থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম_ সর্বত্রই ছিলেন পুরোভাগে। তাই মুক্তিযুদ্ধের ফসল এই বাংলাদেশ তাকে পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে যুগ যুগ ধরে।
 

No comments

Powered by Blogger.