৭ নভেম্বর-পুনরুজ্জীবনের দিন by আ স ম হান্নান শাহ

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর আমাদের বিজয় আসে। জন্ম হয় স্বাধীন বাংলাদেশের। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম থেকেই আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়।


দেশ পরিচালনায় তারা তখন সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। চারদিকে দলীয় নেতাকর্মীরা লুটপাট চালায়। সরকারি সম্পত্তি এমনকি রিলিফের মালও লুটপাট থেকে রেহাই পায়নি। শেখ মুজিবুর রহমান তখন একটি অনুষ্ঠানে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, 'সবাই পায় সোনার খনি, আমি পেলাম চোরের খনি' অর্থাৎ এসব লুটপাটকারীকে তিনি 'চোর' বলে আখ্যায়িত করেন। এরই ফল হিসেবে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ১৯৭৪ সালের সেই দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ মানুষ মারা যায়।
অবস্থা সামাল দিতে ব্যর্থ হয়ে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে প্রচলিত সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা বাতিল করে বাকশাল ব্যবস্থা চালু করেন। আসলে এই বাকশালের নাম দিয়ে এ দেশে একদলীয় শাসন কায়েম করেন। এর মাধ্যমে দেশের মানুষ তার বাকস্বাধীনতা হারায়। শান্তিতে তাদের ধর্ম-কর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারেনি। আর রাজনৈতিক অধিকার তো এমনিতেই লুপ্ত হয়। সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সমর্থকদের নিয়ে গঠিত জাতীয় রক্ষীবাহিনীর সহায়তায় মুজিব বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করেন এবং সারাদেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর কড়া নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন। রক্ষীবাহিনী এবং পুলিশের বিরুদ্ধে অত্যাচার ও রাজনৈতিক হত্যার অভিযোগ ওঠে। দেশ এক শাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্যে পড়ে।
এরপর তদনীন্তন শাসকগোষ্ঠীর কোন্দলের জের ধরে কর্নেল ফারুক ও তার সহকর্মীরা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান। সেই ঘটনায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের অনেকে নিহত হন। এরপর বঙ্গবন্ধুর একসময়ের দীর্ঘদিনের সহচর মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। মোশতাকের মন্ত্রিসভায় অধিকাংশই ছিলেন তখনকার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। দেশের বিরুদ্ধে তখন দেশি-বিদেশি নানা চক্রান্ত চলতে থাকে।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর বিদেশি মদদে এবং আওয়ামী লীগের প্রচ্ছন্ন (?) সমর্থনে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ সামরিক ক্যু করে ক্ষমতা দখল করে নেন। তারা সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করেন, বঙ্গভবন অবরোধ করে রাখেন এবং নিজেদের বাংলাদেশের শাসক বলে ঘোষণা দেন। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ এবং সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা ওই ক্যুকে সমর্থন করেনি। দু'দিন অর্থাৎ ৩ ও ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের রেডিও-টেলিভিশনসহ সব সংবাদমাধ্যম বন্ধ থাকে। দেশে এক বিভীষিকা সৃষ্টি হয়। সামরিক বাহিনীর সদস্যরা তদানীন্তন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করেন। তারা খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ৭ নভেম্বর অস্ত্র-গোলাবারুদ ও সামরিক যান নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসেন।
দেশের সাধারণ মানুষ এই বিপ্লবকে স্বাগত জানায় এবং তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে একে সাফল্যমণ্ডিত করে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং তার অনুচররা তাদের ক্যু চালিয়ে যেতে চেষ্টা করলে উত্তেজিত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা কয়েকজনকে হত্যা করেন। সিপাহি-জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লবে অপশক্তির ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। সিপাহি-জনতার মিলিত প্রতিরোধের নেতৃত্বে এসে দাঁড়ান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনি ক্ষিপ্রতা ও দ্রুততার সঙ্গে সেনা ছাউনিগুলোতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। রক্ষা করেন দেশের সশস্ত্র বাহিনীকে। সবাই তার গতিশীল নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। তিনিও সাফল্যের সঙ্গে তার সেই দায়িত্ব সম্পাদন করেছিলেন।
এরপর সবাই জিয়াউর রহমানকে দেশের কল্যাণে ক্ষমতায় বসান। ১৯৭৭ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার ভাষণে দেশের কল্যাণে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি দেশের শান্তি, সমৃদ্ধি অর্জনে কাজ করে যান। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করেন। তার শাসনামলেই দেশের বিচার বিভাগ নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে সমর্থ হয়। প্রশাসনে গতিশীলতা আসে। মিল-কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। শিক্ষাঙ্গনে শান্তি ফিরে আসে। জিয়াউর রহমানের শাসনামল ছিল মাত্র সাড়ে ৩ বছরের। এই অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি বাংলাদেশকে একটি ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছিলেন। তার শাসনামল ছিল সব দিক দিয়েই উল্লেখযোগ্য। কৃষি উন্নয়নে তিনি খাল কাটা কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। এক কথায় দেশ একটা পুনর্জীবন পায়।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরে জাসদের একটি বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা প্রায় ৪০ জন সেনা অফিসারকে হত্যা করে। তারা ৭ নভেম্বরের এই সাফল্যকে অন্য খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য দিকনির্দেশনার গৌরবোজ্জ্বল দিন হয়ে রয়েছে। বহুদিন পর এ দেশের ছাত্র-জনতা ও সশস্ত্র বাহিনীর ঐক্য গড়ে তোলা ছিল দিনটির একটি বড় অবদান। এ ঐক্যের মধ্য দিয়ে আরও একবার প্রমাণিত হয়েছিল, দেশ ও জাতির যে কোনো দুঃসময়ে দেশপ্রেমিকরা ঐক্যবদ্ধ হন এবং দেশবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এ জন্য তারা রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা অন্য কোনো মহলের সিদ্ধান্ত বা আহ্বানের অপেক্ষা করেন না।
এই দিনটিকে বিশদভাবে জানা উচিত, যাতে কোনো কুচক্রীমহল অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখল করতে না পারে। দেশে যাতে সত্যিকারার্থে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম হয় এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। ৭ নভেম্বর আমাদের শিক্ষা দিয়েছে_ যেখানে সিপাহি-জনতার ঐক্য আছে, সেখানে অপশক্তি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না, রাষ্ট্র ও জনগণ সেখানে নিরাপদে থাকবে।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য

No comments

Powered by Blogger.